বাংলাদেশ দ্বিধা হও

এ ধরণের কোন ঘটনার পরিণতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাংবাদিকরা লিখেন ‘সমবেত জনতা’ এই করেছে সেই করেছে। জনতা তো আর সমবেত থাকে না। কোন রসাল ঘটনা ঘটলে রসাস্বাদনের প্রয়াসে তারা সমবেত হয়। ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে কি আর সবাই কর্মজীবি? সোয়া দুই কোটি মানুষের ঢাকায় না হয় কর্মজীবির হার একটু বেশি। আর দিনটা ছিল শুক্রবার, এ দিনে সবাইই কর্মহীন। অতএব জনতার সমবেত হতে সময় লাগে না।

জনতা সমবেত হয়ে শিশু দুটোকে পেটাতে আরম্ভ করল। পল্লীগ্রামে গৃহস্থ বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে যারা ধরা পড়ে, গ্রামবাসীর মার খেয়ে তাদের অবস্থা কি হয় তা আমরা জানি। শিশুগুলোর পরিণতি সেরকম হয়নি তা দেখাই যাচ্ছে। যারা মারছিল তারা হয়ত মেপেজোঁখেই মারছিল, যেন মরে না যায়। জনতার মাঝে পেটোয়ার পাশাপাশি বাঁচানেওয়ালাও হয়তো ছিল দু’চারজন। সব সমীকরণ মিলিয়ে শিশুগুলো মার খেয়ে মরে যায় নি। তবে বয়স তো অতটুকু, এরা মরে যাওয়া আর বেঁচে থাকার তফাৎ কদ্দূর বোঝে তাও ভাববার বিষয়।

সূত্র আরও একটি তথ্য যোগ করল, স্থানীয় এ শিশু দুটির পরিবারে তীব্র অভাবের কারণে তারা স্কুল ছেড়েছে আরও বহু আগে। অভাবী সময়ের ঘর্ষণে গায়ের ভদ্র আবরণটাও হয়তো খসে গিয়েছে। গৃহস্থ বাড়িতে ঢুকে চুরি করার ঘটনা হয়তো তাদের জন্য নতুন না। ধরা পড়ার অভিজ্ঞতাও নতুন না হতে পারে।

এই হচ্ছে ঘটনা।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সোয়া তেরো ফিট উঁচু ঢাকা মহানগরকে স্বিকৃতি দেনেওয়ালারা মেগাসিটি ডেকে থাকেন। তারা হিসেব কষে দেখিয়েছেন, মহানগরের বার্ষিক প্রসারের বিচারে ঢাকা শুধুমাত্র দিল্লি আর করাচির সাথে পেরে উঠেনি। এই দুটোকে বাদ দিলে আমাদের ঢাকা টোকিও, বেইজিং, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, জাকার্তা, ইস্তানবুল, মস্কো, ম্যানচেস্টার সহ তামাম মহারথীদের পেছনে ফেলে দিয়েছে। আর সিডনি বা ক্যানবেরাকে প্রতিযোগীতার যোগ্যই মনে করা হয়নি।

উপরের ছবিগুলোর পাত্রপাত্রী সেই মহানগরেরই কয়েকজন বাসিন্দা।

এই ছবির ঘটনাটির পক্ষে বলার মত কি যুক্তি থাকতে পারে? কি চুরি করেছে এরা? সংবাদদাতার তথ্য নির্ভুল হয়ে থাকলে তারা হানা দিয়েছিল খাবারের জন্য। খাবার চুরির অপরাধে দুটি শিশুকে এভাবে মারা হবে? আমরা কি জানি না শিশুরা বাংলাদেশের মত দেশে কোন বাস্তবতায় পতিত হয়ে তারপর চুরি করতে যায়? ছবির পেটোয়াদের পক্ষে বলার খাতিরেও না হয় মেনে নেয়া গেল যে এই দু’জন বহুদিন যাবতই এলাকার লোকজনকে জ্বালিয়ে মারছে। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে এভাবে মারা হবে?

এই দুর্মূল্যের বাজারে, যেখানে হাসি-আনন্দর মত ভালো ভালো সব জিনিষের দাম আকাশচুম্বী, সেই বাজারে দেখা গেল এই শিশু দুটোকে মারতে পেরেই বেশ কয়েকজন কান অবধি হাসি দিয়ে ফেলেছেন। মূল ফোকাসের পশ্চাৎভূমিতে একাধিক ব্যাক্তি ভীড় ঠেলে এগিয়ে আসতে চাইছেন শুধু এদেরকে মেরে একটু হাতের সুখ করতে। দু’একজন কোন মতে হাতটা বাড়িয়ে ক্ষুদে দুটার কোন একটির চুল ধরে টানতে পেরেও বেশ প্রসন্ন।

নানাবিধ কারণে পৃথিবীর যে ২৬টি মহানগর নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা ও গবেষণা হয়, ঢাকা তার একটি। জনসংখ্যার বিচারে আমাদের এই শহর ১৬তম, আর বার্ষিক প্রসারণের দিক থেকে আমরা তৃতীয়। হতে পারে আমাদের দেশ অর্থসম্পদে সমৃদ্ধ নয়, কিন্তু ঢাকা কোন সভ্যতাবিবর্জিত শহরও নয়। হতে পারে সভ্যতা এখানে দুধেভাতে প্রতিপালিত হয় না, কিন্তু সভ্যতাবিবর্জিত শহর হলে একে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন করার সুযোগ দেয়া হত না। সেই শহরে এমন ঘটনাকে আমরা কি করে ব্যাখ্যা করতে পারি। এটি কি শুধুই একটি মোমবাতির তলায় অন্ধকারের উদাহরণ? মোমবাতির আলো ততটা জোরালো নয় বলেই কি অন্ধকারটি এত ভয়াবহ, এত কদাকার?

প্রত্যেকটি দেশে, শহরে, সভ্যতায় কদাকার ঘটনা থাকে। লন্ডনে সম্প্রতি এক ধর্ষক ও চোর ধরা পড়েছে যার শিকাররা প্রায়ই সবাই সত্তরোর্ধ্ব প্রৌঢ়া। ১৯৯২ থেকে এই টানা উনিশ বছর সহস্রাধিক ব্যাক্তি তার শিকার হয়েছে বলে আশংকা করা হয়। দিল্লিতে কিছুদিন আগে একটি মামলার নিষ্পত্তি হল যেখানে এক ধনী শিখ ব্যবসায়ী তার গৃহপরিচারকের সহায়তায় দশ-বারো বছরের ছেলেমেয়েদের ধরে এনে ধর্ষণ করে লাশ টুকরো টুকরো করে কাছেই একটি কালভার্টের নীচে ফেলে দিত। লাহোরে এক সিরিয়াল কিলার ঐ একই বয়সী ছেলেমেয়েদের ধরে এনে এসিডভর্তি বাথটাবে ডুবিয়ে দ্রবীভূত করার চেষ্টা করত। প্রথম অপরাধীর বিচারের রায় এই মাসেই দেয়া হবে, দ্বিতীয় অপরাধী দীর্ঘমেয়াদে জেল খাটছে আর তৃতীয় অপরাধীকে জেলখানার অন্যান্য কয়েদিরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।

ঐ কদাকার ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে কদাকার মনস্কের নির্দ্দিষ্ট কিছু ব্যাক্তি। তারা একাই সেগুলো করতে চেষ্টা করেছে, অভাগারা নিজেদের অত আরও দু’একজনকে জুটিয়ে নিতে পেরেছে। কিন্তু লালবাগের ঐ ঘটনাটি কোন শ্রেণীতে পড়ে? ওখানে কি পেটোয়া সবারই টুকটাক মানসিক বিকার ঘটেছে, নাকি তাদের কর্মের পেছনে কিছু যুক্তি আছে যা আমরা কিংবা আমি দেখতে বা বুঝতে পারছি না?

এ ধরণের লেখার শেষ বলে কিছু নেই। তাও সবকিছুরই নাকি শেষ থাকে। এটার শেষে তাই যোগ করছি, এই লেখাটি ইংরেজিতেও লেখা যেত। লিখিনি শুধু এই কারণে, লেখাটিতে যে প্রশ্নটি করার চেষ্টা করা হয়েছে, তার জবাব দিতে হবে আমাদেরই। যারা বাংলা বোঝেননা বা পড়তে পারেন না, তারা সেই উত্তর খুঁজে পেলেও তা বাংলাদেশের উপকারে আসবে না। দেশের নারীশিক্ষার পরিস্থিতির উন্নতি হলে বা শিশুমৃত্যুর হার কমলে সে খবর বিবিসিতে আসেই না। অথচ কোন এক গ্রামে কোন এক অভাগিনীর দোররা খেয়ে অর্ধমৃত হওয়ার গল্প তাদের আরএসএস ফিডের ইন্টারন্যাশনাল ক্যাটগরিত থাকে প্রায় দু’দিন ব্যাপী। আমাদের ভালোগুলোকে নিয়ে বলার মানুষ তো বেশি নেই, খারাপগুলোর কথা ছড়াবার লোক আছে ঢের। আমি সেই ছড়াবার বাহিনীতে নাম নাই লেখালাম। আমার বাংলাই ভালো। যারা বুঝেছেন, ধরে নিন তাদের জন্যই লিখেছি। যারা বোঝেননি, তাদের জন্য, Have a nice day।

(ঘটনাটির সব ছবি দেখতে এখানে ক্লিক করুন)

Source : Priyo.com