উইপোকার পেটে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

সাধারণ মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যা হচ্ছে তাকে দুর্ভাগ্যজনক বললেও কম হবে। সুযোগ বুঝে ভুঁইফোঁড় কোনো কোনো ব্যক্তিও স্বাধীনতার মহান সৈনিকের তালিকায় নিজের নামটি ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এমনটা হয়েছে মূলত ইতিহাসচর্চায় পিছিয়ে থাকার কারণে। ইতিহাস নিয়ে গবেষণার, প্রমাণসাপেক্ষ প্রকৃত ইতিহাসকে তুলে আনার কাজে রয়েছে রাষ্ট্রের উদাসীনতা। ফলে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস প্রণয়ন হয়নি মুক্তিযুদ্ধের। বিচ্ছিন্নভাবে স্মৃতিকথা, কিছু গবেষণামূলক গ্রন্থ যদিও আছে, সেগুলো একান্তই ব্যক্তিপর্যায়ে। এই তো হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যপ্রীতির নমুনা।

কী দুর্বিষহ অবস্থা আমাদের। পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লিখতে গেলে যে উপাদান প্রয়োজন হয় সেই দলিল-দস্তাবেজগুলো অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জাতীয় জাদুঘরে এগুলো এমনভাবেই পড়ে আছে, যার তথ্য জানতে গেলেও বারবারই শুনতে হয়েছে দুটি শব্দ, 'মনে হয়'। সিনিয়র এক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের দলিলগুলো কি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সংরক্ষিত আছে? তাঁর জবাব, 'মনে হয়'। তাপানুকূল ব্যবস্থা আছে কি? তিনি জবাব দিলেন, 'মনে হয়'। জানতে চাওয়া হয়, কাগজপত্রগুলো যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য কোনো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে কি? এবারও তাঁর জবাব, 'মনে হয়'। এতগুলো 'মনে হয়' জবাবের পর একসময় তিনি বললেন, আসলে এখানে যেসব দলিলপত্র আছে সেগুলোর অধিকাংশই মনে হয় 'বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্র' ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত। তাহলে কি এর বাইরে কোনো দলিলই নেই সেখানে? আবারও সেই একই জবাব- 'মনে হয় না'। কী ভয়ংকর কথা!

বড় ভয় হয়। জাতীয় জাদুঘরের সংরক্ষণব্যবস্থা খুবই খারাপ? নিরাপত্তাব্যবস্থা কি প্রশ্নবিদ্ধ? সম্প্রতি সেখানকার কিছু দ্রব্যসামগ্রী চুরি হওয়ার সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। এ ব্যাপারে যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ আছে। কী কী দ্রব্য চুরি হয়েছে সেগুলোরও কোনো হিসাব নেই। এমনটাই জানা গেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরগুলোতে। তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের ভাগ্যও একই রকম হয়েছে? যদি এমন হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের কোনো আলামতই থাকবে না। হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন গবেষকদলটি সারা দেশ থেকে সাড়ে তিন লাখ পৃষ্ঠা দলিল সংগ্রহ করেছিল। এখন যদি শুধুই ১৫ খণ্ডের দলিল সেখানে থেকে থাকে, তাহলে মাত্র ১৫ হাজার পৃষ্ঠা দলিল সেখানে আছে। বাকি তিন লাখ ৩৫ হাজার পৃষ্ঠা দলিল কোথায় গেল? কেউ জানে না সেই প্রশ্নের জবাব। অন্তত জাতীয় জাদুঘরে কথা বলে তা-ই স্পষ্ট হলো।

বিশ্বাস করার যথেষ্ট যুক্তি আছে যে জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত সেসব দলিলপত্র সম্পর্কে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ কোনো খোঁজখবরই রাখে না। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এসব দলিল জাতীয় জাদুঘরে আনা হয়। বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়, এত দিনেও দলিলগুলোর কোনো বিবি্লওগ্রাফি তৈরি হয়নি। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বিবি্লওগ্রাফি হয়েছে কি দলিলগুলোর? কর্মকর্তা আবারও জবাব দিয়েছিলেন, 'মনে হয়'। এবার একটু বাড়তি শব্দ যোগ করলেন, 'আসলে বিবি্লওগ্রাফি তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু অর্থ ও জনবলের অভাবে কাজ থেমে যায়।' সেটাও প্রথম দিকের ঘটনা। তারপর দুটি দশক গত হয়েছে, কিন্তু কোনো কাজই হয়নি।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে জাতীয় জাদুঘরে এসব দলিল হস্তান্তরের পর এত দিনেও বিবি্লওগ্রাফি তৈরি না হওয়ার এই জবাবটা কি যথার্থ? যদিও তাঁরা বলে থাকেন, লোকবল ও অর্থ না থাকায় কাজ হয়নি। এই অজুহাত প্রায় সব সরকারি অফিসেই শুনতে হয়। আর যদি তা সত্য হয়, মুক্তিযুদ্ধের দলিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরবর্তী সরকারগুলোর উদাসীনতাকে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবেই গণ্য করতে হবে। এসব দলিল নিয়ে গবেষণাকাজ সম্পন্ন করার জন্য সরকারের কাছে প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়ার পরও কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু সেও অনেক বছর আগের কথা। এটা যদি চারদলীয় জোট আমলে হয়ে থাকে, তাহলে প্রজেক্ট অনুমোদন না হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার চলছে দুই বছর হলো। তাদের কাছে কি নতুনভাবে প্রকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল? না তারা তেমন কিছু করেনি।

বিষয়টি নিয়ে আগেও পত্রিকান্তরে সংবাদ হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ যে নেওয়া হয়নি, তা তো জ্বলন্ত সত্য। অথচ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে একটি মন্ত্রণালয় আছে সরকারের। আছে তথ্য মন্ত্রণালয়। আবার যদি বলা হয় বাংলা একাডেমীর কথা। তাদেরও বাদ দেওয়া যায় না। কারণ গবেষণার কাজটি তারাও করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, চারদলীয় জোট আমলে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলা একাডেমীর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষণাকাজ এবং প্রকাশনার প্রকল্পটি আজও আলোর মুখ দেখছে না। সুতরাং তাদের দ্বারা কি এসব দলিল দিয়ে কোনো কাজ করা সম্ভব হবে? প্রশ্নটা আসে জেলাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়নের যে কাজটিতে তারা হাত দিয়েছিল এবং যার বেশির ভাগ কাজই সম্পন্ন হয়েছিল, সেসবের প্রকাশনা কিন্তু বন্ধই রয়েছে। গবেষকরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কিছু বই প্রকাশ করেছেন। দলিলপত্রগুলো যথাযথ সংরক্ষণ নিশ্চিত করে সেগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হতে পারে। এর জন্য ইউজিসি যথাযথ সহযোগিতা করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষণা করতে গেলে এসব দলিলপত্র হতে পারে অসামান্য সহযোগী। সংরক্ষণ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মীদের প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে। জাতীয় জাদুঘর তাদেরও সহযোগিতা নিতে পারে। চুরি হওয়া দ্রব্যসামগ্রীর কিছুই উদ্ধার করা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের দলিলগুলোর ভাগ্য যেন এমন না হয়। এ মুহূর্তে সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় অন্তত একটি বড় কাজ করতে পারে। এই মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যাতে কিছুটা সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে সে রকম পদক্ষেপ তারা নিতে পারে। আর এই পদক্ষেপের প্রথমটাই হতে পারে, জাদুঘরে সংরক্ষিত দলিলগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক সংরক্ষণ এবং এর ব্যবহার নিশ্চিত করা। তাহলে বড় একটা ক্ষতি থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে। তিন লাখ ৩৫ হাজার পৃষ্ঠা দলিল থেকে মুদ্রণযোগ্য দলিলগুলো অতিদ্রুত গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হোক। এর জন্য জাতীয় জাদুঘর যে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যাদের দ্বারা সম্ভব সেই প্রতিষ্ঠানকেই দায়িত্ব দেওয়া হোক। সরকারি প্রতিষ্ঠান অপারগ হলে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও কাজটি সম্পন্ন করতে পারে। অন্তত দলিলগুলো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা এ মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি।