আল্লাহর চেয়ে ইনসাফগার কেউ হতে পারে না

কারন তারা নারী- ঠিক যেভাবে কিনা প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের সব  স্ত্রী জাতি পুরুষের চেয়ে আলাদা।  নারীরা পুরুষের চেয়ে আকার ও দৈহিক শক্তি- সক্ষমতায় একটু আলাদা হলেও নারীই ইসলামে পেয়েছেন পুরুষ থেকে কয়েক গুণ বেশি অধিকার। বস্তুত ইসলাম নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে নয়। বরং নারী নির্যাতনের এক চরম সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বের নির্যাতিত ও নিগৃহীত নারীর পক্ষে ইসলামই সর্বাগ্রে আওয়াজ বুলন্দ করেছে। জীবন্ত প্রোথিত হওয়ার আবহ থেকে, পণ্য হিসেবে বাজারে বিক্রি হওয়ার পরিবেশ থেকে উঠিয়ে এনে নারীকে সম্মানের রাজাসনে ইসলামই সর্বপ্রথম অধিষ্ঠিত করেছে। সামাজিক সমূহ নিগ্রহের অক্টোপাস থেকে মুক্ত করে নারীকে স্বাধীন জীবন উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে। মাতৃত্বের গৌরবে বিভূষিত নারীর দেহবল্লরী যাতে যারতার লালসা ও লোলুপ দৃষ্টির শিকার না হয় সেজন্য পর্দার বিধান দিয়ে মানবরূপী পশুদের দৃষ্টিসীমার অন্তরালে নিয়ে নারীকে করেছে দুর্লভ, মহামূল্যবান ও মহাসম্মানী। বিয়েতে মোহরের প্রথার প্রবর্তন করে নারীর মূল্য যে পুরুষের তুলনায় বেশি সে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছে।

পারিবারিক অর্থ জোগানের দায়-দায়িত্ব ও কায়িক কষ্টকর শ্রমের বোঝা নারীর ওপর অর্পণ না করে পুরুষের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর নারীকে আগামী পৃথিবীর জন্য যোগ্য ও আদর্শবান, সত্পরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ, মমত্ববোধসম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব অর্পণ করে তাকে মর্যাদার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে। কোনোরূপ আর্থিক ব্যয়ের দায়িত্ব নারীর ওপর অর্পণ না করেও পৈতৃক উত্তরাধিকারে তাকে পুরুষের অর্ধেক প্রদান করে তার জীবনের অর্থনৈতিক ভিতকে করা হয়েছে সুদৃঢ়; যাতে দুর্যোগের মোকাবিলা সে সহজেই করতে পারে। যৌথ জীবনে পুরুষকে তার অভিভাবক সাব্যস্ত করে সব জটিলতা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রেখে নারীকে দান করেছে টেনশনমুক্ত হাস্যোজ্জ্বল এক আনন্দময় জীবন। বলতে গেলে ইসলাম নারীকে যে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে তার চেয়ে বেশি সম্মান দেয়া আদৌ সম্ভব নয়। পৃথিবীতে কেউ দেয়নি, দিতে পারবে না কোনো কালেও।

বস্তুত নারী-পুরুষের স্বভাব ও মেজাজ বিবেচনা করে ইসলাম কোনো ক্ষেত্রে নারীকে দায়িত্ব দিয়েছে কম, পুরুষকে দিয়েছে বেশি, আবার কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে দায়িত্ব দিয়েছে কম নারীকে দিয়েছে বেশি। আবার অধিকারের প্রশ্নেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে দেয়া হয়েছে বেশি, আর নারীকে দেয়া হয়েছে কম। তবে এ ধরনের ক্ষেত্র খুব একটা বেশি নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসলাম উভয়ের দায়িত্ব ও অধিকারে সাম্য বিধান করেছে যথার্থভাবেই। যেসব ক্ষেত্রে কাউকে বেশি ও কাউকে কম দেয়া হয়েছে, তার যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যাা করে দিয়েছে ইসলাম। সামাজিক ভারসাম্য ও পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার জন্যই যে এরূপ করা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। ইসলামের এই ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করে ১৪শ’ বছর যাবত ইসলামী সমাজ নির্বিঘ্নে পরম শান্তি ও শৃঙ্খলার সঙ্গে অতিবাহিত করে আসছে তাদের জীবন। কিন্তু পাশ্চাত্য জগতের নারীরা ইসলাম প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে ছিল চরম নিগ্রহের শিকার। সেই নিগ্রহের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে একদিন তথাকার নারীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে; তারা তাদের অধিকারের দাবি নিয়ে রাজপথে অবতীর্ণ হয়। সেই আন্দোলন জোরদার হয়ে একদিন তা সমঅধিকার দাবিতে পরিণত হয়।

বস্তুত সেই প্রেক্ষাপটেই অনুষ্ঠিত হয় ‘কনভেনশন অন দ্য এলিমিনেশন অব-অলফম অব ডিসক্রিমিনেশন এগেইনস্ট উইমেন’ সংক্ষেপে (সিডও)। সেই সম্মেলনের সিদ্ধান্তবলিকে বলা হয় ‘সিডও সনদ’। জাতিসংঘ এ সনদ জারি করতে চাইলে বিশ্বের বহু দেশই তা মেনে নেয়নি। কেননা সেই সনদে নারীকে যেভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে, তা স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না। অধিকাংশ মুসলিম দেশও তা মেনে নেয়নি। কেননা তার বহু ধারা ইসলামের সঙ্গে ছিল সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। বিশেষ করে উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমতার নীতি এবং তালাকের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার নীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে কোরআনের বিধানের পরিপন্থী। একই পিতামাতার সন্তান হয়ে বোন পাবে ভাইয়ের অর্ধেক। এই নীতি অনেকের কাছেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। এ নীতির মাঝে অনেকেই অবিচারের গন্ধ পান, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের তত্ত্ব আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন।

আসলে মহান আল্লাহ তায়ালা নারীদের প্রতি কতটা সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন, সে বিষয়টি তারা তলিয়ে দেখেন না। নারীকে উত্তরাধিকারে সমান না দেয়ার প্রশ্ন উঠিয়ে একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে মায়াকান্না করছেন তারা আসলে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে আদৌ ধারণাই রাখেন না। কেননা, পৈতৃক উত্তরাধিকারই নারীর একমাত্র উত্তরাধিকারের সূত্র নয়; বরং নারীরা পিতামাতার সম্পদে উত্তরাধিকার লাভের সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর সম্পদেও উত্তরাধিকার লাভ করে থাকেন। স্বামী নিঃসন্তান হলে তার সম্পদের এক-চতুর্থাংশ লাভ করেন। আর স্বামীর সন্তান থাকলে তখন এক অষ্টমাংশ লাভ করেন। আর নারীর জীবদ্দশায় তার সন্তান মারা গেলে তার সম্পদের এক ষষ্ঠাংশ লাভ করে থাকেন। এভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তার সম্পদের পরিমাণ তার দায়-দায়িত্ব ও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। ইসলামী সমাজে নারীকে কোনো অর্থনৈতিক দায়িত্ব বহন করতে হয় না। এমনকি তার নিজের দায়িত্বও তাকে বহন করতে হয় না। জন্মের পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত তার লালন-পালন ও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার। বিয়ের পর তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর। স্বামীর মৃত্যুর পর তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছেলের (যদি সে বালেগ হয়)। সুতরাং কোনো এক সন্ধিক্ষণেও তার নিজের দায়িত্ব তাকে বহন করতে হয় না।

সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার, মাতার নয়। বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছেলের। পারিবারিক আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়নের দায়িত্ব পুরুষের, নারীর নয়। সারকথা এই দাঁড়ায়, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই নারীকে তার নিজের বা অন্যের দায়িত্ব বহন করতে হয় না। অথচ ছেলে সন্তান হলে বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পিতার। বালেগ হওয়ার পর থেকে তার নিজের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আইনগতভাবে তার নিজের। বিয়ে করলে স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়। সন্তান জন্মালে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বাবা হিসেবে তার ওপর এসে যায়। পিতা-মাতা বৃদ্ধ হয়ে গেল তাদের সম্পদ না থাকলে এবং তারা উপার্জনে অক্ষম হলে তাদের দায়-দায়িত্ব ছেলের। আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়নের দায়িত্ব ছেলের ওপর।

বেচারা পুরুষ নিজের, স্ত্রী-সন্তান ও পিতা-মাতাসহ সবার দায়িত্ব বহন করে যা পায়, তা নারীর প্রাপ্তির তুলনায় যথেষ্ট কম। পক্ষান্তরে রমণী নিজের দায়িত্বও বহন করে না, আর অন্য কারও কোনো দায়িত্ব বহন না করার পরও তাকে যদি পৈতৃক উত্তরাধিকারে পুরুষের অর্ধেকসহ অন্য সূত্রেও উত্তরাধিকারে অংশ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে কি বিষয়টা অবিচার করা হয়েছে বলে মনে হয়? তদুপরি মোহর হিসেবে প্রাপ্ত টাকা, বৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদে তার পূর্ণ অধিকার থাকে। স্বামী অভাবে পড়লেও স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পদে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার তার নেই। সুতরাং বলা যায়, দায়-দায়িত্ব ও প্রয়োজনের বিচারে নারীকে উত্তরাধিকার হিসেবে যতটুকু দেয়া হয়েছে তা অনেক বেশি। নারী দুর্বল বলেই দায়িত্ব না দিয়েও তাকে পিতা-মাতার উত্তরাধিকারে অর্ধেক দেয়া হয়েছে। যাতে দুর্যোগের সময় বা কারও অসহযোগিতার মুহূর্তে তার জীবন সঙ্কটে নিপতিত না হয়। ইসলামী সমাজের এই স্ট্রাকচারাল দিক সম্পর্কে যারা অবগত নয়, তারাই আল্লাহর বিচারে সন্তুষ্ট হতে না পেরে নিজেরাই নারীর পক্ষে মায়াকান্না শুরু করে দেন। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, (নাউজুবিল্লাহ) মহান আল্লাহ তায়ালা ভুল করলেও তারা সে ভুল সংশোধন করে ফেলতে চান। তাই তারা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। জাতিসংঘ প্রণীত সিডও সনদ পড়ে সেরূপই মনে হয়। তবে মুসলিম জাতিকে মনে রাখতে হবে, আল্লাহর চেয়ে ইনসাফগার কেউ হতে পারে না। যদি কেউ সেরূপ দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়, তাহলে মনে করতে হবে এর পেছনে কোনো অসত্ উদ্দেশ্য লুকায়িত আছে।

লেখকঃ প্রকৌশলী, খাদ্য প্রযুক্তি।