ভিআইপি, সাধারণ মানুষ ও রিকশাচালকেরা

দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ বিভাগ। যদিও রাস্তায় রিকশা বন্ধ করে দেওয়ার আগে কখনো কোনো ধরনের নোটিশ দিয়েছে পুলিশ বিভাগ—এ রকম নজির নেই। এরই অংশ হিসেবে সোমবার নয়টার পর কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে মালিবাগ-মৌচাক হয়ে মগবাজার ও রামপুরা পর্যন্ত রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে রিকশাচালকেরা বিক্ষোভ, গাড়ি ভাঙচুর করেন (প্রথম আলোয় ২৯ মার্চ) কয়েকটি রাস্তাকে ভিআইপি রোড ঘোষণা এবং কয়েকটি রাস্তাকে যানজটমুক্ত করার জন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে ডিএমপি জানিয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যাঁরা রিকশায় চলাফেরা করেন, তাঁদের কী হবে?

সপ্তাহ খানেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে রিকশা বন্ধ করে দেওয়া হয় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি থেকে বিডিআর গেট পর্যন্ত, যেখানে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি শিক্ষার্থী নিবাস (দুটি ছাত্রী হল ও একটি ছাত্রাবাস), আছে একটি ইনস্টিটিউট। যেদিন রিকশা বন্ধ হলো, সেই এলাকায় ভুক্তভোগী ছাত্রী হলের মেয়েরা মিছিল করেছে, হলে বিক্ষোভ করেছে। পরের দিন বিষয়টির আপাতসুরাহা হয়েছে। বলা হয়েছে, আইডিকার্ড সঙ্গে থাকলে রিকশা ছেড়ে দেওয়া হবে বেলা দুইটা পর্যন্ত। সেখানে অবস্থিত ছাত্রী হলগুলোর হাউস টিউটরের দায়িত্ব পালন করতে যাওয়ার সময়ও আমাদের অনেককে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে রিকশা থেকে। কারণ, আমরা আইডি কার্ড দেখাতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় চার হাজারের মতো শিক্ষার্থী যে রাস্তা ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, বিশেষ করে কার্জন হলে যায় ক্লাস করতে, এর জন্য প্রতিদিন কয়েকবার করে পুলিশকে কার্ড দেখিয়ে চলাফেরা কতটা যৌক্তিক? আর যেসব শিক্ষার্থী নিজের গাড়ি করে বা সিএনজিতে যাবে, তাদের আইডি কার্ড দেখাতে হবে না। কী চমৎকার নিয়ম এ দেশে!

আর কারও যদি পরীক্ষা থাকে, তাহলে কথাই নেই। অনেক শিক্ষার্থী যেখানে পরীক্ষার টেনশনে নিজের প্রবেশপত্র পর্যন্ত আনতে ভুলে যায়, সেখানে আইডি কার্ড নিয়ে পুলিশি জেরার মুখে পড়া পরীক্ষার আগে মনস্তাত্ত্বিকভাবে একটা চাপ তৈরি করবে। ওই হলগুলোর জন্য বাসট্রিপ আছে। কিন্তু ক্লাসের বাইরেও নানা কাজে শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানল না, হলগুলোর কিংবা ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ জানল না, তাহলে কীভাবে এত বড় একটি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলো?

পরের ঘটনা আরও কষ্টের। নয়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার ডিউটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে গেলে নয়টার অনেক পরে পৌঁছাতে হয়। সকাল সাড়ে সাতটায় বের হয়ে কোনো রিকশা বা সিএনজির হদিস পাওয়া গেল না। একজন রিকশাচালককে রাজি করানো হলো ৬০ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে। কিন্তু নয়াটোলা থেকে মগবাজার মোড়মুখী হওয়ার পথে মগবাজার রেললাইনের কাছে যাওয়ার পরই ট্রাফিক রিকশা আটকে বললেন, ‘এই রাস্তায় রিকশা বন্ধ।’ তাহলে উপায়? ট্রাফিককে অনেক অনুরোধ করে সেই যাত্রা বেঁচে গিয়ে পরীবাগে এসে দ্বিতীয় ঝামেলায়। ১০ মিনিট রাস্তা বন্ধ। দ্বিতীয় দফা অনুরোধ। সেখানেই শেষ নয়, তৃতীয়বার রিকশা থামানো হলো শাহবাগের কাছাকাছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানো গেল নয়টা ১০ মিনিটে। এর পরের দিন বন্ধ করা হলো কাকরাইল, মগবাজার, মৌচাক আর রামপুরা সড়ক।

রাস্তায় রিকশা বন্ধ হতেই পারে। কিন্তু এর বিকল্প ব্যবস্থা করে বন্ধ করতে হবে। নইলে এসব এলাকার মানুষ কীভাবে চলাচল করবে? ঢাকা শহরে বসবাস করা এক কোটি মানুষের মধ্যে গাড়ি আছে খুব কম লোকের। বিআরটিসি বাসের অনেকগুলোই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিসকে ভাড়া দেওয়া। সব জায়গায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা ট্যাক্সিক্যাব পাওয়া যায় না এবং পাওয়া গেলেও বেশি ভাড়া দাবি করা হয়। ঢাকা শহরে যাঁদের গাড়ি নেই, তাঁরা চলে যাবেন শহর ছেড়ে? নাকি পরোক্ষভাবে বলে দেওয়া হলো, গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই যাঁদের, তাঁরা থাকতে পারবেন না এই ‘ভিআইপি’দের শহর ঢাকায়? আর রিকশাচালকদের রুটিরুজির পথ বন্ধ হলে তাঁরা কোথায় যাবেন?

আরেকটি উপায় আছে, তা হলো হাঁটা। ঢাকা শহরে হাঁটার রাস্তা কই? রাস্তার ওপর দোকানপাট। কোনো কোনো জ্যামে ফুটপাত দিয়ে চলে মোটরসাইকেল ও সিএনজি। বাসগুলো পুরো না থামিয়েই যাত্রী নামায়। আর সেই যাত্রীরা লাফ দিয়ে নামে গাড়ি থেকে। ধাক্কা খায় অন্য পথচারী। এই যখন রাস্তার চিত্র, তখন বিকল্প উপায় না সৃষ্টি করে, জনগণকে জানতে না দিয়ে কীভাবে একের পর এক রিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ডিএমপি। কাদের স্বার্থ তারা দেখছে, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করার আগে সেসব রাস্তায় দ্বিগুণ বাস দিয়ে, জনগণকে জানিয়ে এবং তাদের যেন অসুবিধা না হয়, তা নিশ্চিত করে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে সাধারণ মানুষের কথা ভুলে যায়। তাদের সমস্যা নিয়ে ভাবে না। রাস্তায় বের হলেই শুনতে হয়, রাস্তায় রিকশা বন্ধ। রিকশায় গেলে চলতে হবে আইডি কার্ড নিয়ে। তবে নিজের গাড়ি থাকলে আর আইডি কার্ড নিয়ে ঘুরতে হবে না। কারণ গাড়িই তো ডিএমপির কাছে বড় আইডি কার্ড। আর সরকারকে ভাবতে হবে, ভোটে গাড়িওয়ালা ও রিকশাযাত্রী—সবার ভোটই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষ ও রিকশাচালক সবাইকে দরকার গণতন্ত্রে। হুট করে কারও কারও সুবিধার জন্য সাধারণ মানুষের অসুবিধা করাটা কতটা যৌক্তিক ও মানবিক?