ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীদের জন্য ওএসডি’র স্কুল

পরবর্তীতে অভাবের সংসারে তার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। বাবা-মা অশিক্ষিত হওয়ায় মেয়ের পড়াশুনার প্রতিও তারাও তেমন কোন ভ্রক্ষেপ করেননি। চৈতির বাড়ি বাটাজোর দক্ষিণপশ্চিম পাড়া গ্রামে। সুমন হোসেন (৯) প্রাইমারী স্কুলে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে আর স্কুলে যায়নি। বাবা রিকসা চালক। একার আয়ে ৬ সদস্যর সুমনদের পরিবারে টানাপোড়ন লেগেই রয়েছে। অভাবের সংসারে বাবাকে সহযোগীতা করার জন্য সুমন যে স্কুলের ছাত্র ছিলো ঠিক সেই স্কুলের সম্মুখেই ক্লাশে না গিয়ে বাদাম বিক্রি শুরু করে। সুমনদের ঠিকানা টরকী আবাসন প্রকল্পে। এভাবেই প্রাইমারি শিক্ষা থেকে প্রতিনিয়ন ঝড়ে পরছে অসংখ্য শিক্ষার্থীরা।

আর এসব ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীদের জন্যই ব্যতিক্রমধর্মী স্কুল খুলেছে বেসরকারি সামাজিক উন্নয়ন এনজিও ওএসডি। গত তিনবছরে ওইসব স্কুল পরিচালনা করে ব্যাপক সফলতা অর্জন করায় এলাকায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ব্যতিক্রমধর্মী এসব স্কুলের শিক্ষকদের বেতন, শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই, খাতা, কলমসহ টিফিন পরিবেশন করা হয়। ঝড়ে পড়া শিশুদের পড়াশুনার প্রতি মনযোগী করে গড়ে তুলে তাদের পূর্ণরায় প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করানোই হচ্ছে উদ্যোগক্তাদের মূল উদ্দেশ্য। “একটি শিশুও যেন নিরক্ষর না থাকে”-শ্লোগানকে সামনে রেখে গত তিনবছর ধরে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার প্রত্যন্ত— উত্তর চাঁদশী, টরকী আবাসন প্রকল্প ও বাটাজোর দক্ষিণপশ্চিমপাড়ায় ব্যতিক্রমধর্মী তিনটি স্কুল পরিচালিত হয়ে আসছে।

বাটাজোর দক্ষিণপশ্চিমপাড়া সার্বজনীন কালী মন্দির প্রাঙ্গনের ব্যতিক্রমধর্মী স্কুলের শিক্ষিকা মঞ্জু রানী দেবনাথ বলেন, আমার স্কুলে ৩৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। যার অধিকাংশই প্রাইমারিতে দু’চার মাস গিয়ে আর কেহই স্কুলে যেতো না। তাদের স্কুলগামী করার লক্ষে ওএসডির পরিচালনায় প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত আমার স্কুলে ক্লাশ নেয়া হয়। উত্তর চাঁদশী ঘরামী বাড়ির আঙ্গিনায় পরিচালিত স্কুলের শিক্ষিকা মনি ঘরামী বলেন, আমার স্কুলে ২৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।  টরকী আবাসন প্রকল্প কমিউনিটি সেন্টার স্কুলের শিক্ষিকা রিনা আক্তার বলেন, আমার স্কুলে ৪২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার সকল ব্যয়ভার, আমার বেতন ও শিক্ষার্থীদের টিফিনের ব্যবস্থা ওএসডির পক্ষ থেকেই নেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমার স্কুলে প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত ক্লাশ নেয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গৌরনদীর ব্যবসায়ী ও চাকুরীজিবী সাতজন সমাজ উন্নয়ন কর্মী ২০০৯ সালে অর্গানাইজেশন ফর সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট (ওএসডি) নামের এনজিও’র আত্মপ্রকাশ করেন। সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে এনজিও’র মাধ্যমে নিজেদের জড়িয়ে নেয়ার জন্যই ওএসডি এনজিও প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১০ সালে এনজিও-টি সরকারী রেজিষ্টেশন লাভ করে। এনজিও’র চেয়ারম্যান মনতোষ চন্দ্র দাস বলেন, দশের লাঠি একের বোঝা। প্রবাদ বাক্যকে ধারন করে আমরা সাতজনে মিলে সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহনের জন্য নিজেদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে ওএসডি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেছি। এনজিও’র নির্বাহী পরিচালক প্রেমানন্দ ঘরামী বলেন, সামাজিক উন্নয়নের নিজেদের জড়িয়ে নেয়ার অংশ হিসেবে প্রথমেই আমরা বেঁছে নিয়েছি ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীদের স্কুলগামী করার লক্ষে ব্যতিক্রমধর্মী স্কুল পরিচালনা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষে সভা-সেমিনার ও বেকার যুবকদের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করে সচেতনাতা বৃদ্ধি করা। এনজিও’র অর্থ সচিব পরিমল চন্দ্র হালদার বলেন, প্রতিমাসে আমাদের সাতজনের উপার্জিত অর্থের একটি অংশদিয়েই এ এনজিও’র সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। আমাদের কোন ক্রেডিট প্রোগ্রাম নেই। শুধু সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে নিজেদের জড়িয়ে নেয়ার জন্যই ওএসডি’র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ইতোমধ্যে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে সভা, সেমিনার ও বেকার যুবকদের মৎস্য চাষের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

গৌরনদী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি ও জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক স্বর্ণপদক প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ মুনসুর আহম্মেদ বলেন, গত তিন বছরে ওএসডি এনজিও’র ব্যতিক্রমধর্মী স্কুলের মাধ্যমে লেখাপড়ার প্রতি মনযোগী হয়ে অসংখ্য ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীরা আজ স্কুলগামী হয়েছেন।