লিমনের কাটা পায়ের খোঁজে

একটা পা ছিল। পুত্রশোক বড় শোক। যে লোকটি ছেলেটিকে উঠে বসাচ্ছেন, তিনি বাবা। পেছনে যিনি দাঁড়িয়ে, তিনি মা। ছেলেটির বয়স বড়জোর আঠারো। সকালে সে গরু চরায়, দুপুরে কামলা খাটে ইটভাটায়, রাতে পড়তে বসে। প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি লাইন, প্রতিটি পৃষ্ঠার জন্য সারা দিন সে গতর খাটে। পড়ার সময়টাই তার স্বপ্নের সময়। তখন ভুলে যায় সে এক দরিদ্র রাখাল, সে এক ইটভাটার মজুর, সে এক অভাবী পরিবারের সন্তান; তখন সে রাখালরাজা। এ ধরনের ছেলেরা মাতৃমুখী হয়। গরিবের সন্তান সে, হিমালয়ে ওঠার স্বপ্ন তার নেই। স্বপ্ন কেবল দুঃখিনী মাকে সুখী করার, বাবার মুখের হাসি দেখার। তার সেই স্বপ্নের নাম: নিজের পায়ে দাঁড়ানো। পা-ই তার আত্মবিশ্বাসের খুঁটি, যাতে ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়াবে। হাঁটবে একবারের জন্য পাওয়া এই পৃথিবীর বুকে। সেই পায়েই বিনা দোষে গুলি করেছে র‌্যাব।

সেই পা-টাই কাটা পড়েছে। ঊরুর কাছ থেকে কাটা পড়া বাঁ পা এখন লিমনের আঠারো বছরের স্বপ্নের সঙ্গে পচছে কোনো ভাগাড়ে। লিমন আর লিমন নেই, এই লিমন অর্ধেক লিমন, তার জীবন এক পায়ে দাঁড়ানো টলমল। আমরা তাকে ভুলে যাওয়ার পরও সে এক পায়ে জীবনের দৌড় চালিয়ে যাবে। যাওয়া ছাড়া তার উপায় নেই। এক পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে আবারও হাঁটবে পৃথিবীর পথে। আর কেবলই পিছিয়ে যাবে। পৃথিবীর তাতে দুঃখ হবে, কিন্তু সরকারযন্ত্রের কিছুই হবে না। রাষ্ট্র কী পাষাণ! পাথরে আঘাত লাগলে তো শব্দ হয়, আওয়াজ করলে প্রতিধ্বনি করে পাথর। রাষ্ট্র কি পাথরের থেকেও কঠিন? অনুভূতিহীন?

দুই দিন গেল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাক। মন্ত্রীদের কি হূদয় নেই, বিবেক নেই? একজন তবু কেঁদেছেন। একজনের অশ্রু আর লিমনের অশ্রু তবু মিলতে পেরেছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান লিমনকে দেখতে গিয়ে অঝোরে কেঁদেছেন, ফরিয়াদ করেছেন, তদন্ত চেয়েছেন। আর কী চাইতে পারেন তিনি? সহমর্মিতার কান্না মানুষকে মানুষ করে, মানবিক করে। যাত্রাপালায় কত রাজা-বাদশা-সেনাপতি আর উজির-নাজির। তারা হাসে আর ডায়ালগ ছাড়ে। কিন্তু কাঁদে কেবল দুয়োরানি আর তার হতভাগা সন্তানেরা। তাদের দুঃখে কাঁদে কেবল বিবেক। যেমন আমাদের গুমরানো কান্না মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের চোখের অশ্রু পেয়েছে। যাত্রার রাজা-উজিররা একসময় তাদের ভুল বুঝতে পারে। আমাদের রাজা-উজিররা কি তাঁদের ভুল বুঝতে পারছেন? তাঁরা একটু মানবিক হলে দেশটাকে মানুষের দেশ মনে হতো।

যে র‌্যাব সদস্যটি লিমনের পায়ে গুলি করেছিল, তারও কি আনন্দের অভাব পড়েছিল? লিমন তো প্রাণে বেঁচে গেছে, কিন্তু কত লিমন যে পঙ্গু হয়েছে, কত নিরপরাধের যে লাশ পড়েছে, কত পরিবার যে পুত্রশোকে স্তব্ধ হয়েছে, কত নারী বিধবা হয়েছে, কত সন্তান বাবা হারিয়েছে, তার হিসাব কে দেবে? হিসাবের দায় কেবল মানবাধিকার সংস্থাগুলোর? সরকারি বাহিনী কিংবা খোদ সরকার কি তাহলে মানবাধিকারবিরোধী? তাঁদের বিবেকও কি লিমনের পায়ের মতো কাটা পড়েছে? লিমনের পঙ্গুত্ব পায়ে, তাঁদের পঙ্গুত্ব কি চেতনায়!

অনেক দুঃখে রাগ জাগে। রাগটা অক্ষম। যে গেছে, সে তো গেছেই। যেমন আজিজ মার্কেটের শফি চলে গেছে। শফি গিটার বাজিয়ে গান গাইত, কবিতা লিখত, কম্পিউটারের দোকানে কম্পোজ করত। অসম্ভব লাজুক আর শান্ত এক তরুণ ছিল সে। অনেক দিন তাকে দেখিনি। তারও অনেক দিন পরে শুনলাম, সিরাজগঞ্জে যমুনার পাড়ে তার ‘ক্রসফায়ার’ হয়েছে। শফি বা লিমনকে আমরা ভুলে যাব। যে দুঃখ সওয়া যায় না, তা ভুলে যেতে হয়। সেই দুঃখের লাশ নদী দিয়ে ভেসে যায়।

কিন্তু ভুলে যেতে যেতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছি আমরা? সবারই তো জীবন একটা, দেশও একটা। এক জীবনে সুস্থ-সভ্য একটা দেশ কি আমাদের পাওনা ছিল না? যশোরের সেই বুড়ির কথা ভেবে ভরসা পাই। প্রান্তরের মধ্যে বুড়ির ঘর। শুধু ঘর নয়, বেশ একটু জমির ওপর ঘর। তিন কুলে বুড়ির কেউ নেই। একা থাকেন, একা খান, একাই ঘুমান। জমিখেকোরা তক্কে তক্কে থাকে। বুড়ি মরলে কি আর জমি মরবে? ঘর ধসবে? বুড়ির ওয়ারিশান নেই, জোর যার এই জমি হবে তার। বুড়ি ভয়ে আর ঘুমান না। রাতে বাড়ির আশপাশে টর্চ জ্বলতে দেখেন। ঘরের চালে ঢিল পড়ে। তবু বুড়ি ঘর ছাড়েন না। তিনি বরং কুপির সলতেটা আরও চাগিয়ে দিয়ে উঠে বসেন। ভেবে ভেবে আত্মরক্ষার একটা বুদ্ধিও বের করেন। রাত হলে খেয়েদেয়ে কাঁসার একটা কলস আর বাঁশের ডালঘুঁটনিটা নিয়ে বসেন। তারপর সারা রাত দুলে দুলে সারা জীবনের জানা সব গীত গান আর তালে তালে কাঁসার কলসটা পেটান। পড়শিদের বলা আছে, ডাকাত এলে গীত থামবে, আমি মরলে বাজনা থামবে। তোমরা বুঝে নিয়ো, তোমরা সাড়া দিয়ো। বুড়ি গাইতে থাকেন আর ডঙ্কা বাজান। লোকে ঘুমের মধ্যেও কান পাতে: আওয়াজ আসছে, বুড়ি বাজছে। বুড়ি সশস্ত্র। বুড়ি সতর্ক। বুড়ি অতন্দ্র।

কোথাও ঘণ্টা বাজছে, কোথাও বীভৎস অন্যায় হচ্ছে, কোথাও কেউ পঙ্গু হচ্ছে, কোথাও কেউ মরে যাচ্ছে ক্রসফায়ারে। আমরা কি শুনতে পাই, আমরা কি আছি, আমরা কি বাজি? আমরা কি সাড়া দিই?


faruk.wasif's picture – Priyo.com