সন্তানের ভালোবাসা বনাম শিকড়ের টান

আমেরিকায় আসা এক সংগ্রামী  মানুষের আত্মকথন। তার কথার মালায় এক অব্যক্ত আনন্দ আর কষ্টের অনুভুতি Dream USAমাখা স্মৃতিচারনের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে প্রবাসীদের অন্তরের আনন্দ বেদনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুমিহীন জমিদারের লেখনীতে চলুন খুজে ফিরে নিজের অস্তিতেকে।

ভাবের তাড়নায় আজ থেকে সিকি শতাব্দি আগে ফেক কাগজ পত্র দিয়ে ভিসা (তখন মতিঝিলের আদমজী কোর্টে আমেরিকান দূতাবাসের অফিস ছিলো) নিয়ে আমি ভূমিহীন বউয়ের চোখের পানি, তিনটি অবুঝ বাচ্চার বোবা দৃষ্টি, মা’র বুক ফাটা চাপা আর্তনাদ, ভাই বোনের বিচ্ছেদের আকুতি সব পেছনে ফেলে আটলান্টিক পাড়ি দেই। নিজের এবং পরিবারের জন্য আর্থিক স্বচ্ছলতাই ছিলো আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার মূল উদ্দেশ্য। এই আমেরিকায় আমার আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য আমি কিনা করেছি! আমার যেহেতু কোন প্রফেশনাল ডিগ্রী ছিলোনা সেহেতু আমাকে অনেক অড জব করতে হয়েছে। প্রয়োজনের তাগিদে প্রচন্ড বরফে দাড়িয়ে প্রতি শনিবার রাতে নিঊ ইয়র্ক টাইমস ভাঁজ করেছি, ফার্মেসীতে কাজ করেছি, ডেলিভারী বয়ের কাজ থেকে রেস্টুরেন্টে কিচেন হেলপার বাস বয় (মেসিয়ার) ওয়েটার বার টেন্ডিং (বার টেন্ডিং? লা হাওলা………) করেছি। নিজের এবং পরিবারের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার জন্য জীবনের অনেক বন্দরেই আমাকে নৌকা ভিড়াতে হয়েছে। আর্থিক স্বচ্ছলতার বিনিময়ে আমি কি পেলাম আর কি হারালাম এই ট্রায়াল ব্যালেন্স করা আমার পক্ষে সম্ভব না। ।

যেই বয়সে সন্তানেরা বাপের আংগুল ধরে মেলায় যায়, বেলুন আর বাশি কিম্বা অন্য কোন খেলনার আবদার করে তখন প্রয়োজনের তাগিদে এইসব আবদার থেকে আমাকে অনেক দূরে বিদেশ বিভূইয়ে নিজের অস্তিত্ব লড়াইয়ে ব্যাস্ত থাকতে হয়েছে। কয়েক বতসর পরে বাচ্চাদের যখন কাছে পেলাম তখন তাদের বেলুন বাশির বয়স পেড়িয়ে গেছে এবং বেলুন বাশির পরিবর্তে ভিডিও গেমসের আবদার করেছে। যেই বয়সে বাচ্চারা বাপের শরীরের উপর গড়াগড়ি খায়, বাপকে জড়িয়ে ধরে হাজারো প্রস্ন কিম্বা হাজারো বায়না অথবা হাজারো অভিযোগ করে ঠিক সময়টা আমি আমার সন্তানদেরকে দিতে পারিনি। একজন বাপ হিসাবে এযে কত কস্টের এটা বু্যিয়ে বলা যাবেনা। এখনও এই এতো বছর পরেও এই কস্ট বুকের মধ্যে চিনচিন করে বাজে। বউকে প্রায়ই আমার এই কস্টের কথা বলি, বউ স্বান্তনা দেয় কিন্তু কিছু কিছু কস্ট আছে যা সিস্টেম থেকে ডিলিট করা যায় না।

ছেলেরা (আমার তিন ছেলে, মেয়ে নাই) হাই স্কুল শেষ করে কলেজে গেলো, ২০০৫ সালে ছোটটাও কলেজ শেষ করলো। আমার মনে আছে ছোট ছেলের গ্র্যাজুয়েশনের দিন যখন তার নাম ডাকা হয়, ওর বন্ধুরা যখন আনন্দে চিতকার চেচামেচি এবং শীষ দিচ্ছিলো তখন আমি দাড়িয়ে দুদিকে দু হাত তুলে অনেক জোরে বলেছিলাম ইয়েস আই ডিড ইট। কিন্তু এই আই ডিড ইট এর পেছনে কত কস্ট, কি পরিমান শ্রম, কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এটা শুধু আমিই জানি। ছেলেরা সবাই কাজ করছে, কাজ করা অবস্থায় এমবিএ শেষ করে স্বস্ব কর্মক্ষেত্রে মোটামুটি ভাবে স্তিতিশীল। একটা সময় ছিলো যখন ছেলেরা আমার কাছে “সময়” চাইতো। আমার পক্ষে আলাদা সময় বের করা খুব কস্টকর ছিলো কারন আমি এফোর্ড করতে পারতামনা। তার পরেও যতটা সম্ভব আমি ছেলেদের সময় দিয়েছি। আজ আমার হাতে অনেক সময় এবং আমি ছেলেদেরকে সময় দিতে চাই কিন্তু আমার থেকে সময় নেয়ার মত সময় তাদের নেই।

সময়ের কি পরিবর্তন! সময় সবকিছুকে বদলে দেয়, বদলে দেয় গোটা পরিবেশকে যার প্রভাব পরে আমাদের জীবনে এবং সময়ের এই পরিবর্তনের কাছে আমাদের নতি স্বীকার করতেই হয়। নাহ, ছেলেরা কেউ দেশে ফিরে যাবেনা। আর আমার পক্ষেও এই দেশে থাকা সম্ভবনা একটা সময় আসবে (প্রায় এসে গেছে) যখন আমি অবসর নেবো আর আমার ছেলেরা কাজে এবং নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়বে। তখন আমি কি করবো? ছেলেরা চাচ্ছে তাদের বাপ মা যেন বাকী জীবনটা তাদের সাথে কাটায়। এখানেই আসল এবং মূল সমস্যা। একদিকে আমার সন্তান অন্যদিকে আমার শিকড়। আমার সন্তানদের জন্য যেমন আমার ভিতর হাহাকার করে অন্যদিকে আমার শিকড়ের টানকে আমি কোন অবস্থাতেই অস্বীকার করতে পারতেছিনা। কুমিল্লার সেই অজ পাড়াগাঁও যেখানে আমার জন্ম, যে মাটিতে ভর দিয়ে আমি হাটতে শিখেছি, তালেবানদের মত মাথা দুলিয়ে হুজুরের কঠিন শাসনে সূরা কায়দার ছবক নিয়েছি, প্রাইমারি স্কুলে ক্লাসের সবাই সুর করে নামতা পড়তাম বিশ একে বিশ বিশ দ্বিগুনে চল্লিশ, পড়ন্ত বেলায় ফড়িং এবং ঘুড্ডির (ঘুড়ি) পেছনে দৌড়ানো কিম্বা ডাংগুলি দাড়িয়াবান্দা গোল্লাছুট অথবা কানামাছি বো বো খেলা শেষ করে ঠিক সুর্য ডোবার সাথে সাথে ঘড়ে ফেরা এবং হারিকেনের আলোতে ক্লাসের পড়া শেষ করা, যদিও সবই শুধু সৃতি কিন্ত শৈশবের সবই আজ বার বার চোখের সামনে ভেসে আসছে এবং ম্যানহাটানের স্কাই লাইন, আলোকজ্জ্বল টাইমস্কোয়ার কিম্বা মিড টাউনে নাচে গানে ভরপুর নাইটক্লাব যেখানে আমি একটানা ১৭ বছর কাজ করেছি , নাম্বার সেভেন ট্রেন ইত্যাদি ইত্যাদি সবকিছু ফেড আউট হয়ে যাচ্ছে।

এই প্রাবাসী জীবন আমাকে অনেক দিয়েছে। ছেলেদের বেস্ট-পসিবল এডুকেশন নিজের এবং পরিবারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এই প্রবাসী জীবন থেকেই পেয়েছি। এই দেশে আমি যেই পরিমান স্বাধীনতা (লেবেল অব ফ্রিডম) ভোগ করেছি, আমার জন্মভূমি বাংলাদেশে এতোটা ভোগ করতে পারতাম কিনা সন্দেহ আছে। এতো পাওয়ার পরেও অকৃতজ্ঞের মত আমি চলে যাচ্ছি। যতদিন সচল থাকব মাঝে মধ্যে হয়তো ছেলেদের দেখতে আসবো  অথবা আমি অচল হয়ে গেলে ছেলেরা দেখতে যাবে। আমার অবর্তমানে ছেলেরা আর দেশে যাবে বলে মনে হয়না। হয়তোবা ২/১ বার বেড়াতে যেতে পারে কিন্তু তাদের সন্তানেরা বাংলাদেশে যাওয়ার প্রস্নই আসেনা। নতুন প্রজন্ম এখানে এই কমিউনিটিতে মার্জ হয়ে যাবে অন্যদিকে আমার মৃত্যর পরে আমার কমিউনিটি থেকে আমার নাম নিশানা শেষ হয়ে যাবে কারন আমাকে ধরে রাখার মত কেউ নেই এবং এটাই মাইগ্রেশনের কঠিন বাস্তবতা। ছেলেদেরকে ফেলে একবুক হাহাকার নিয়ে আমি আমার শিকড়ে অর্থাৎ দেশে ফিরে যাচ্ছি। আমি যা পেয়েছি তার চেয়ে বেশী হারিয়েছি। আমার চেয়ে হতভাগ্য বাবা আর কে আছে বলুন?

চমৎকার এই লেখাটি ২০০৮সালে ই-মেলাতে প্রকাশিত হয়েছিল