কোথায় গেল দিনবদলের সনদ

সরকারের পরিবর্তন হলেও সেগুলোর কোনো পরিবর্তন হয় না। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রথম প্রতিরোধের মুখে পড়েন ছাত্র রাজনীতির কাছেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাঁকে জুতা প্রদর্শন করেছিল। ঢিল ছুড়ে নাজেহাল করেছিল। এর পর থেকেই ছাত্র রাজনীতি ধ্বংস করার চক্রান্ত শুরু হয় সুপরিকল্পিতভাবে। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া, অপরাধীদের ছাত্র ও যুব রাজনীতিতে ঠাঁই করে দেওয়া, ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি অর্থাৎ ছাত্র ও যুবকদের ত্যাগী রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাজে রাজনীতির হাতেখড়ি শুরু হয়। আমাদের মনে পড়ে, এক খুনের মামলার আসামি আশ্রয় পেয়েছিল তৎকালীন যুবমন্ত্রীর বাসায়। সেই বাজে সংস্কৃতি আরেক সামরিক শাসক এরশাদের সময় আরো অনেক দূর এগিয়েছে। অভি-নিরুর মতো অনেক সুপারস্টারও তৈরি হয়েছিল। ক্যাম্পাসে রাতে গোলাগুলির শব্দ হয়ে উঠেছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার।

এর পর চার চারটি গণতান্ত্রিক সরকার এসেছে, কিন্তু ছাত্র ও যুব রাজনীতির সেই বাজে সংস্কৃতি বদলায়নি, বরং আরো বেগবান হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, ছাত্র রাজনীতির এই পচন ঠেকানোর ভালো কোনো উদ্যোগও চোখে পড়েনি। অন্যদিকে শিক্ষক নামধারী কিছু ব্যক্তিকে পচন-ধরা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে দেখা গেছে। ফলে ছাত্র রাজনীতির পচন চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পেঁৗছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে তখন ব্যবসায়ীদের অপহরণের পর জিম্মি করে রাখা এবং মুক্তিপণ আদায় করার মতো বহু ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রদল নেতা মতিঝিলে ডাকাতি করতে গিয়ে ঘটনাচক্রে পুলিশকে মেরে ফেলার পরও দিব্যি ঘুরে বেড়িয়েছে এই ঢাকা শহরে। বর্তমান মহাজোট সরকার শুরুতে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকলেও ছাত্র রাজনীতি প্রায় একই পথ ধরে এগিয়ে চলছে।

বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন বিগত জোট সরকারের আমলে আরেকটি নজিরবিহীন বাজে সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। তারা ক্ষমতায় এসেই বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত, এমনকি দণ্ডপ্রাপ্ত প্রায় ৭০ হাজার অপরাধীকে মুক্তি দেয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও তাতে মুক্তি পেয়ে যায়। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও মারাত্মক ধস নামে। সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা, হত্যা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, লুটপাট, ধর্ষণসহ নানা রকম অপরাধ এমনভাবে বেড়ে যায় যে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়।

বর্তমান সরকারও একই ধারায় 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা' হিসেবে আখ্যায়িত করে চুরি, ডাকাতি, খুনের মামলাসহ এমন সব মামলা প্রত্যাহার করতে শুরু করে, যা সম্পূর্ণরূপে আইনের শাসনের পরিপন্থী। পত্রিকায় এ নিয়ে অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, কিছু দিন আগে একটি হত্যা মামলার প্রধান আসামিকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই ব্যক্তিটি রাজারবাগ পুলিশ টেলিকমের সাবেক হিসাবরক্ষক আবদুল লতিফ। তার বিরুদ্ধে সহকর্মীকে হত্যার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগেও সাতটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টিই করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। হত্যা মামলায় ছাড় দেওয়া হলে দুর্নীতির মামলায়ও আবদুল লতিফ সরকারি অনুকম্পা পাবে_এমন অনুমান করাটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বর্তমান সরকার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু এই কি তার নমুনা? একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে_এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তাকে কেউ না কেউ হত্যা করেছে_এটাও সত্য। যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত হত্যাকারীর বিচার করাই রাষ্ট্রের কাজ, তথা আইনের শাসন। কেউ নির্দোষ হলে আদালতই তা নির্ধারণ করবে। অতীতের পথ ধরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কেন এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ নিতে হবে? তদুপরি মহাজোট সরকার দুই বছর পার করেছে। দুই বছর পরেও কেন রাজনৈতিক হয়রানির নামে সরকারকে হত্যা মামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। বরং দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' আখ্যায়িত করে আর একটি মামলাও প্রত্যাহার করা হবে না।

বিগত জোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে অনেক মামলা হয়েছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তার আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও এমন কিছু মামলা হয়েছিল বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে, যাকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বলা যায়। এটিও আরেকটি বাজে সংস্কৃতি। স্থানীয়ভাবে বিরোধী দলকে ঘায়েল করার জন্য তাদের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন মামলার আসামি করা হয়। আর এ ক্ষেত্রে বরাবরই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। এই বাজে সংস্কৃতির শুরু মূলত নব্বই-পরবর্তীকালে, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলে। সেই সংস্কৃতির উপস্থিতি আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি। এটিও কোনোভাবেই কাম্য নয়।

আরেকটি বাজে সংস্কৃতি হচ্ছে, দেশি-বিদেশি ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন খাওয়া। এরও শুরু পঁচাত্তর-পরবর্তীকালের স্বৈরশাসকদের সময় থেকে। আর এই কমিশনের লোভে দেশে যেসব জিনিস রাষ্ট্রীয় কলকারখানায় উৎপাদিত হতো, সেগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানেও সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে রেলের বগি ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরি হতো। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ যত বেশি বগি আমদানি করা হবে, তত বেশি কমিশন পাওয়া যাবে। আর এই কমিশন থেকে লাভবান হতেন মন্ত্রী এবং আমলারা। সেনাশাসন বিদায় নিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও এই বাজে সংস্কৃতি বদলায়নি। বরং তা অনেক বেশি বেগবান হয়েছে, যার চরম বহিঃপ্রকাশ দেখেছি বিগত জোট সরকারের আমলে। মন্ত্রী ও আমলার বাইরে তখন এ সংস্কৃতিতে যোগ হয় একটি ভবন ও দুই রাজপুত্র_তারেক ও কোকো। এ সরকারের আমলেও যে কমিশন বাণিজ্য অব্যাহত আছে_বাতাসে এমন গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে। হয়তো প্রকৃত অবস্থাটি জানা যাবে এ সরকারের বিদায়ের পর।

সংসদ বর্জনের বাজে সংস্কৃতি চার-চারটি গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেই প্রবলভাবে বিদ্যমান। এভাবে বিরোধী দলের অনবরত সংসদ বর্জনের পরও একে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলা যায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সম্ভবত সে কারণেই 'খারাপ গণতান্ত্রিক' সরকারব্যবস্থার তালিকায়ও বাংলাদেশ নেই। আছে না-গণতান্ত্রিক, না-স্বৈরতান্ত্রিক অর্থাৎ এক মিশ্র বা জগাখিচুড়ি ব্যবস্থার তালিকায়। তবু আশার কথা, বাংলাদেশ এ তালিকায় এবার এক ধাপ এগিয়েছে। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা সংসদে হাজির না হলেও বেতন-ভাতাসহ একজন এমপির সব সুযোগ-সুবিধাই গ্রহণ করছেন। এমনকি শুল্কমুক্তভাবে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের সর্বশেষ মডেলের গাড়ি আমদানিতেও তাঁরা পিছপা হচ্ছেন না। ধিক তাঁদের এ মানসিকতাকে। সংসদ বর্জন করলে অবিলম্বে সব সুবিধা বর্জন করাটাও তাঁদের কর্তব্য নয় কি?

বিগত জোট সরকারের অব্যাহত দুঃশাসনের পর গত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট যখন দিনবদলের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে এল_তখন মানুষ তা বিশ্বাস করেছিল। দুঃশাসন থেকে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তা পেরেছে কি? দু-একটি ক্ষেত্রে তারা কিছুটা সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পারলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা তা পারেনি।

জোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রের পরোক্ষ মদদে জঙ্গিরা এ দেশে তাদের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল। অর্থ, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ ব্যাপক ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল। সারা দেশে একযোগে পাঁচ শতাধিক স্থানে বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে তারা তাদের সে শক্তিমত্তার পরিচয়ও রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জনকে হত্যা এবং কয়েক শ নেতা-কর্মীকে গুরুতর আহত করা হয়েছিল। ওই পরিকল্পনার সঙ্গে একাধিক মন্ত্রী জড়িত ছিল বলে আমরা এখন জানতে পারছি।

অথচ তখন জজ মিয়া কাহিনী সাজিয়ে মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বর্তমান সরকারের দুই বছরে জঙ্গিবাদ কমানো গেলেও সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি; বরং ক্ষেত্রবিশেষে অবনতি হয়েছে। সাধারণ মানুষ নিরাপদ ও শান্তিতে জীবনযাপন করতে চায়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তাদের সে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

দিনবদলের সনদের প্রতি আস্থা স্থাপন করে জনগণ মহাজোট সরকারকে বিপুল ম্যান্ডেটে বিজয়ী করেছিল। কিন্তু অতীতের সরকারগুলোর বাজে সংস্কৃতি ধরে রাখা বর্তমান সরকার মানুষের সে প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং হচ্ছে। আশা করি, সরকারের যাঁরা কর্ণধার তাঁরা বিষয়গুলো উপলব্ধি করবেন এবং সে অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। তাঁদের মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষ ওয়াদার বরখেলাপ সহ্য করে না, বরং অপরাধ হিসেবেই গণ্য করে।


Farhad.Mahmud's picture