পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন বৈসাবিতে মাতোয়ারা

বছরকে বরণ উপলক্ষে এ উৎসব। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বৈসাবি উৎসব। পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-জাতি গোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব এ “বৈসাবি”।

প্রতিবছর এ সময়ে বৈসাবি আনন্দে একাকার হয়ে যায় এ অঞ্চলসমূহের পাহাড়ি ও বাঙ্গালী অধিবাসী। এসময়টা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পরিণত হয় সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতির মিলন মেলায়। এখানকার ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-জাতি গোষ্ঠী প্রতি বছর নিজস্ব আঙ্গিকে আলাদা আলাদা নামে এ উৎসব পালন করেন। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এ উৎসব ‘বৈসাবি’ নামে বেশি পরিচিত। বাংলা বর্ষবরণ ও বিদায় উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈষু, মারমারা সাংগ্রাই ও চাকমারা বিজু নামে পালন করে থাকে। অন্যতম বৃহৎ তিন উপজাতি সম্প্রদায়ের উৎসবের নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে এ উৎসব বৈসাবি নামেই পরিচিত।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচে বড় নৃ-গোষ্ঠী হলো চাকমা সম্প্রদায়। মঙ্গলবার ছিল চাকমাদের বিজু উৎসবের প্রথম দিন। বৈসাবি উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা বলে 'ফুলবিজু'। ফুল বিজু বলে ফুল দিয়ে চাকমা ছেলেমেয়েরা নদীখাল ও ঝর্ণায় গঙ্গাদেবীর পূজা করে। এদিন মাছ মাংসসহ মজার মজার সব খাবারের আয়োজন করা হয়।

বৈসাবি উৎসবের 'সা' আদ্যক্ষরটি পাহাড়ের অন্যতম নৃগোষ্টী মারমাদের 'সাংগ্রাই' উৎসব থেকে নেয়া। পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বুধবার মারমারা উদযাপন করবে সাংগ্রাই উৎসব। মারমারা সাধারণত চন্দ্রমাস অনুসারে এই দিনটি পালন করে থাকে। সাংগ্রাই উৎসব উদযাপনের দিন মারমা যুবক-যুবতীরা পিঠা তৈরি করার জন্য চালের গুঁড়া প্রস্তুত করে। সাংগ্রাই উৎসব এবং পানি খেলা এখন যেনো একে অপরের সমার্থক হয়ে গেছে। এই খেলার সময় এক জায়গায় পানি ভর্তি রেখে যুবক যুবতীরা একে অপরের দিকে পানি ছুড়ে মারে। স্নিগ্ধতায়, ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় ভিজিয়ে দেয় পরস্পরকে।

ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচে আকর্ষণীয় এবং প্রধানতম উৎসব হলো বৈসুক। বৈসুক চৈত্র মাসের শেষের দুইদিন ও নববর্ষের প্রথম দিনটি সহ মোট তিনদিন ধরে পালন করা হয়। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিনের প্রথম দিনটিকে ত্রিপুরারা 'হারি বুইসুক'এবং শেষ দিনটিকে 'বুইসুকমা'বলে থাকে। আর নববর্ষের প্রথমদিনটিকে তারা বলে 'বিসিকাতাল'। উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা গাছ থেকে ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। পরিচ্ছন্ন কাপড় চোপড় পরে ছেলেমেয়েরা গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায়। বৈসুক শুরুর দিন থেকে 'গরাইয়া'নৃত্য দল গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রত্যেক ঘরের উঠোনে নৃত্য করে। লোকনৃত্যে ১৬ জন থেকে ১০০/১৫০/৫০০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারে। বৈসুক উৎসবের জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় নৃত্যটি দেখার জন্য প্রত্যেক বৈসুকে সারাদেশের শত শত সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন।

উৎসবের এই দিনগুলোতে আদিবাসীদের ঘরে ঘরে রান্না করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী পাঁচন (বহু জাতিক সবজি), পিঠা ও সুস্বাদু খাবার। এ ছাড়াও ঐতিহ্য অনুযায়ী অতিথি আপ্যায়নে পরিবেশন করা হচ্ছে স্থানীয় উৎপাদিত মদ। এবারো বাংলা বছরের বিদায় ও বরণকে কেন্দ্র করে বান্দরবানসহ রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় আয়োজন করা হয়েছে বৈসাবির শোভাযাত্রা, আলোচনাসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিঠা উৎসব, পানি খেলা, নৌকা বাইচ, তরুণ তরুণীদের রথ যাত্রা, ঘিলা খেলা, নাদেং খেলা, আলারি গানের আসর ও বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। এর এসব আয়োজনে পাহাড়িদের পাশাপাশি অংশ গ্রহণ করছে বাঙ্গালিরাও।