লিমনের ওপর নিষ্ঠুরতা এবং আমাদের মানবতা

কথা ছিল। সে প্রস্তুতিই নিচ্ছিল সে। দিনে ইটখোলায় কাজ আর রাতে ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে। এসএসসিতে জিপিএ ৪ পেয়েছে। এবার ভালো ফল করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ভালো একটা চাকরি নেবে। মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবে। একজন দিনমজুর তোফাজ্জল হোসেনের টানাপড়েনের সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, পরীক্ষার মাত্র কয়েক দিন আগে র‌্যাব-৮-এর নিষ্ঠুরতায় তাকে একটি পা হারাতে হয়েছে। ভেঙে খানখান হয়ে গেছে তার স্বপ্ন। লিমনের মা-বাবার বুকফাটা কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়। তাঁরা করুণ দৃষ্টিতে এই সমাজ, এই মানবসভ্যতার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা লিমনের মা-বাবার দিকে মাথা তুলে তাকাতে পারি না। লজ্জায় আমাদের মাথা অবনত হয়। মনে প্রশ্ন জাগে, কোথায় আমাদের মানবতা! কোথায় আমাদের মমত্ববোধ, আবেগ-ভালোবাসা! আমরা কী বলে লিমনের মা-বাবাকে সান্ত্বনা দেব? কী অপরাধ ছিল লিমনের? কেন তাকে সন্ত্রাসী বানানো হলো?

আমাদের এলিট ফোর্স খ্যাত র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ভুলের কারণে যদি একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটে, তার প্রতিকার কী হবে? শুধু ভুলের শাস্তি হলেই কি সব কিছু চুকে যাবে? লিমন কি তার পা ফিরে পাবে? ফিরে পাবে তার একটি বছর! লিমন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে কি না আমরা জানি না। দরিদ্র এই পরিবারটি সুষ্ঠু বিচার পাবে কি না তাও জানি না। জানি না এ ধরনের অসভ্যতা, বর্বরতা আর কত দিন আমাদের দেখতে হবে। মনের মধ্যে ভয়, কোথায় চলেছি আমরা! আমাদের মানুষগুলো কি দিন দিন নিষ্ঠুর, পাষণ্ড হয়ে যাচ্ছে? এ প্রশ্ন প্রতিটি বিবেকবান মানুষের। আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত টেলিফোন আসছে। ই-মেইলের মাধ্যমে আমাদের পাঠকরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। বলছেন, 'আপনারা লিখুন, সমাজটাকে জাগিয়ে তুলুন। আপনারাই পারবেন এই দেশটাকে বদলাতে।'

পত্রিকায় দেখলাম, বিচারের দাবি নিয়ে বিচারালয়ের দ্বারস্থ হয়েছেন লিমনের মা-বাবা। গত ১০ এপ্রিল লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে র‌্যাব-৮-এর ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন। বিচারক নুসরাত জাহান মামলাটি আমলে নিয়ে এজাহার হিসেবে রুজু করে রাজাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

এদিকে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন, র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ র‌্যাবই তদন্ত করবে। তিনি র‌্যাবের প্রতি তাঁর আস্থার কথা জানিয়ে বলেন, তারা নিরপেক্ষ তদন্ত করবে এবং তারা সত্য উদ্ঘাটন করতে পারবে। র‌্যাবের উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত দল ঝালকাঠিতে যাওয়ার কথা। উল্লেখ্য, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার জমাদ্দারহাটে গত ২৩ মার্চ র‌্যাব লিমনকে ধরে পায়ে গুলি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়। বর্তমানে লিমন ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালের বিছানায় পায়ের ব্যথায় তার নির্ঘুম রাত কাটে।

লিমনের মা কাঁদতে কাঁদতে সাংবাদিকদের বলেন, 'র‌্যাব মোর নিরীহ পোলারে ঠ্যাঙে গুলি কইর‌্যা পঙ্গু কইরা দেছে। পরীক্ষার হলে থাহার কতা থাকলেও সে এহন হাসপাতালের বিছানায় ঠ্যাঙ হারানোর ব্যাতায় কাতরাইতেছে। এই অবস্থার মধ্যেও র‌্যাব পঙ্গু হাসপাতালে তার বিছানার চারদিকে দাগি আসামির মতো পাহারা দিতেছে।'

লিমনের মায়ের অভিযোগ, র‌্যাব-৮-এর উপসহকারী পরিচালক মো. লুৎফর রহমান, করপোরাল মাজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল মো. আবদুল আজিজ, নায়েক মুক্তাদির হোসেন, নায়েক প্রহ্লাদ চন্দ্র ও সৈনিক কার্তিক কুমার বিশ্বাস ২৩ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে লিমনকে ধরে এনে নির্যাতন করে। লিমনের চিৎকারে ওর মা ছুটে এসে র‌্যাব সদস্যদের জানান, তাঁর ছেলে কলেজে পড়ে। কিন্তু তাঁর কথা কেউ শোনে না, কেউ বিশ্বাস করে না। উল্টো তাঁকে শাসায়। পরে লিমনের বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপর পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেন র‌্যাব সদস্য লুৎফর রহমান। এ সময় বহু লোক ঘটনাস্থলের দিকে এগোতে থাকলে তাদের দিকে অস্ত্র তাক করে ভয় দেখানো হয়। এরপর র‌্যাবের অভিযুক্ত সদস্যরা নিজেদের রক্ষা করতে লিমনের বিরুদ্ধে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা করেন। র‌্যাবের বিরুদ্ধে এ ধরনের নিপীড়ন-নিষ্ঠুরতার অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও নিরীহ সাধারণ মানুষ কিংবা ছাত্রকে সন্ত্রাসী বানিয়ে ক্রসফায়ার করেছে বলে অভিযোগ আছে। র‌্যাবের কোনো কোনো সদস্যের এ ধরনের ভুলের কারণে খেসারত দিতে হচ্ছে পুরো সংস্থাটিকে। সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমরা এ কথা বলতে চাই না যে র‌্যাবের সব কাজই খারাপ। র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। র‌্যাব সক্রিয় না থাকলে এ দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যেত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটত, যদিও র‌্যাবের ক্রসফায়ারে দাগি আসামি বা সন্ত্রাসীদের হত্যার বিষয়টিকে ভালোভাবে নিচ্ছে না জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং নাগরিক সমাজ। ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার বিষয়টিকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। আমরাও তা মনে করি।

২০১০ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তুখোড় সমালোচনা করা হয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মার্কিন প্রশাসন উদ্বেগ প্রকাশ করে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত ১০ এপ্রিল উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সরকারের বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত, অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি ও বিভিন্ন দেশের ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা উপস্থিত ছিলেন।

আমরা জানি, বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশে র‌্যাবের মতো এলিট ফোর্স রয়েছে। তারা যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে না, তা নয়। আমরা যেকোনো দেশের যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানাই। কারণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আর আইনের শাসন ছাড়া কোনো দেশই সভ্য রাষ্ট্র হতে পারে না। কোনো সভ্য দেশেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করতে পারে না। সন্ত্রাসকে সন্ত্রাসের মাধ্যমে মোকাবিলা করা সমর্থনযোগ্য নয়। প্রয়োজনে জরুরি বিচার আইনে অপরাধী সন্ত্রাসীদের বিচার করতে হবে এবং সেটাই সংগত। দাগি আসামি হলেও তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। আইনকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। জঙ্গিনেতা বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমানও র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছিলেন। আদালতে তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাঁদের ফাঁসি হয়। সন্ত্রাসীদেরও আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বিচার করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে সন্ত্রাস দমনের চেষ্টা করলে তার ফল ভালো হয় না। কখনো কখনো তা আত্মঘাতী হয়ে যায়।

র‌্যাব সদস্যরা যাতে বেপরোয়া না হন, ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারেন, কারো ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করতে না পারেন, সে জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে। র‌্যাবের আচরণবিধি, কর্মপরিধি ও কর্মক্ষমতা নতুন করে ঠিক করতে হবে। তাঁদের মানবাধিকারের ওপর উন্নত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। র‌্যাবের হেফাজতে যাতে কোনো মানুষ নিহত না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে সন্ত্রাসী-অপরাধীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আচরণ কেমন হয়, সে বিষয়ে ধারণা নিতে হবে। তা না হলে নিষ্ঠুরতা আরো বাড়বে। আর সেই নিষ্ঠুরতার শিকার হতে পারে নিরীহ মানুষও। এ ধরনের একটি-দুটি নিষ্ঠুরতায় র‌্যাবের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেগে যায়। প্রশ্নবিদ্ধ হয় সব কর্মকাণ্ড।

আমরা মনে করি, র‌্যাবের আত্মশুদ্ধির সময় এসেছে। একটা সময় র‌্যাবের ভাবমূর্তিতে যে চাঁদের আলো পড়েছিল, তা কালো মেঘে ঢেকে গেছে। লিমনের ঘটনাটি র‌্যাবকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আর বাড়া যাবে না। এবার রাস টানতে হবে। অতীতের সব গ্লানি ধুয়েমুছে সম্ভাবনার নতুন পথে পা বাড়াতে হবে। এলিট ফোর্সের মর্যাদাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।

লেখক: মোস্তফা কামাল – Priyo.com