সারথী ধান সর্বশান্ত করে দিয়েছে কৃষদের ভাগ্য

মহাজনের কাছ থেইক্কা সুদে ও ব্যাংক থেকে লোন নিয়া ভুই লাগাইয়া আইজ পথের ভিখারী হইয়া গেলাম। ও ভগবান পোলাপান লইয়া এ্যাহন মুই ক্যামনে বাঁচমু, এইয়ার চাইয়া তুমি মোরে লইয়া যাও। কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলেছেন, দিনমজুর কৃষক গোপাল রায় (৪৫)। উঠতি ফসল হারিয়ে গোপাল রায়সহ বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার প্রায় পাঁচ শতাধিক কৃষক পরিবারের মধ্যে এখন চরম হতাশা বিরাজ করছে। জমিতে বাম্পার ফসল পাওয়ার আশায় চলতি বছর ইরি-বোরো মৌসুমে উপজেলার জোবারপাড়, রামদেবেরপাড় ও উত্তর কালীবাড়ির আটটি ব্লকের প্রায় পাঁচশতাধিক কৃষকেরা তাদের প্রায় দেড়হাজার হেক্টর জমিতে গণচীনের উদ্ভাবিত শ্রেষ্ঠ হাইব্রিড ধান বীজ সারথী-১৪ ব্যবহার করেছিলেন। ফসল ঘরে তোলার মাত্র কয়েকদিন আগে জমিতে নেকব্লাস (ঘার পঁচা) রোগে ফসল ঝলসে (পুড়ে) যায়। ফসল হারিয়ে ওইসব কৃষকেরা আজ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এ জন্য কৃষকেরা গণচীনের উদ্ভাবিত শ্রেষ্ঠ হাইব্রিড ধান বীজ সারথী-১৪ কে দায়ি করে বলেন, সারথী ধানের বীজ আইজ মোগো সর্বশান্ত কইরা দিয়া গ্যাছে।

ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক গোপাল রায় জানান, কাঠমিস্ত্রির কাজ করে একার উপার্জনে ৯ সদস্যর পরিবার পরিজন নিয়ে ও জমাজমি চাষ করে কোন একমতে তিনি দিনাতিপাত করতেন। চলতি বছর তার একমাত্র ৫২ শতক জমির পুরোটিতে সারথী-১৪ ধানের বীজ বপন করেছিলেন। কৃষক কালীপদ হালদার (৭০) তার ১ একর, নিপেন পান্ডে (৬৫) তার ৫০ শতক, অসিম মজুমদার (৫২) তার ৬৬ শতক, মনি শংকর হালদার (৪৫) তার ৮৮ শতক, অনিল রায় (৪৫) তার ১ একর ৪ শতক, রমা মিস্ত্রি (৪৫) তার একমাত্র ৬৬ শতক, প্রফুল্ল রায় (৪০) তার ১ একর জমিসহ জোবারপাড়, রামদেবেরপাড় ও উত্তর কালীবাড়ি এলাকার ৮টি ব্লকের প্রায় পাঁচশতাধিক কৃষকেরা তাদের প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে সারথী-১৪ ধানের বীজ বপন করেছিলেন।

কৃষক কালীপদ হালদার জানান, গত বছর তারা বোরো চাষে সারথী বীজ বপন করে বাম্পার ফলন পেয়ে অধিক লাভবান হয়েছেন। সেই আশায় চলতি বছর তারা পূর্ণরায় আগৈলঝাড়া সদরের বীজ ও সারের ডিলার মের্সাস বিজয় মন্ডল টেড্রার্স থেকে প্রতিকেজি ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা দরে সারথী-১৪ ধানের বীজ সংগ্রহ করেছেন। কৃষক নিপেন পান্ডে জানান, এবছর তাদের এলাকার ৮টি ব্লকের প্রায় পাঁচ শতাধিক কৃষকেরা প্রায় এক হাজার হেক্টর জমিতে সারথী বীজ দিয়ে বোরো চাষ করেছেন। শুরুতে ধানের উৎপাদনও ভালো হয়। আরমাত্র দশদিন পরেই ধান ঘরে তোলার সময় হবে। এরইমধ্যে গত ৪দিন পূর্বে (১১ এপ্রিল) ক্ষেতের সকল ধান ঝলসে পুড়ে যায়। বিনষ্ট হওয়া ধান ক্ষেতগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষেতের ধান গাছগুলো সবুজ আর ধানের ছড়াগুলো পাকা ধানের মতো হয়ে গেছে। দেখলে মনে হয় পুরো ধানগুলো পেকে গেছে। আসলে তা নয়। ছড়া টানতেই ধরা পড়ে ধানের ছড়ার গোড়া পচা। শুকিয়ে যাওয়া ধানের মধ্যে চিটা। ক্ষতিগ্রস্থরা জানান, কোন জমিতে এ রোগ দেখা দিলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে সবশেষ হয়ে যায়। গত ৪ দিনে উল্লেখিত গ্রামের সকল সারথী ধানের ক্ষেতের ফসল ঝলসে গেছে।

কৃষক কালীপদ হালদার বলেন, শুরুতেই বিষয়টি আগৈলঝাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমেন্দ্র নাথ বাড়ৈকে জানানো হয়েছে। তিনি কয়েকবার সরেজমিনে এসে জমিতে বায়ার কোম্পানীর নাটিভো নামের ছত্রাকনাশক ঔষধ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ৩৩ শতক জমির জন্য ৪০ গ্রামের প্রতিপ্যাকেট নাটিভোর মূল্য ২৭৫ টাকা। তাও আবার সারথী ধানের বীজের ডিলারের দোকান ছাড়া অন্যকোনো ডিলারের কাছে পাওয়া যায়না। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, শ্যাষ পোরযোন্ত বাড়ির এট্টা গাছ ৫ হাজার টাহায় বেইচ্চা ভুইর ধান রক্ষা করার লাইগা ঔষধও দিছি। হেইয়ার পরেও ধান রক্ষা করতে পারিনায়। পোলাপান লইয়া এ্যাহন মুই ক্যামনে বাঁচমু-ক্যামনেই বা মহাজনের সুদের টাহা ও ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করমু। অধিকাংশ কৃষকেরাই মহাজনের কাছ থেকে সুদে ও ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলন করে জমি চাষ করেছেন। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকেরা ফসল বিনষ্ট হওয়ার জন্য সারথী-১৪ বীজকে দায়ি করে বীজ কোম্পানীর কাছ থেকে ক্ষতিপুরন আদায়ের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।  

সারথী বীজের স্থানীয় বিক্রেতা বিধান মন্ডল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকেরা আজ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাদের অপুরনীয় ক্ষতি হয়েছে। তবে কি কারনে ধান গাছের এ অবস্থা হল? এ জন্য কি বীজ দায়ি ? বিষয়টি সনাক্ত করতে তারা কৃষি বিভাগের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমেন্দ্র নাথ বাড়ৈর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, রোগটি বীজ বাহিত। রোগটি ধান গাছের পাতায় আক্রান্ত হলে তেমন একটা ক্ষতি হয়না। কিন্তু ঘাড়ে আক্রান্ত হওয়ায় ফসল সম্পূর্ন নষ্ট হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, যেসব জমি ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সেসব জমির জন্য কিছইু করার নেই। তবে আর যাতে নতুন করে আক্রান্ত না হয় সেজন্য বায়ার কোম্পানীর নাটিভো নামের ছত্রাকনাশক ঔষধ দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। উপজেলার যেসব কৃষকেরা সারথী-১৪ ধানের বীজ বপন করেছেন তারা প্রায় সকলেই ফসল হারিয়েছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

খোকন আহম্মেদ হীরা, গৌরনদী।