শেয়ারবাজারের সমগোত্রীয় লুটেরা শ্রেণী

খোন্দকার ইব্রাহিম শেয়ারবাজারখালেদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। শেয়ারবাজারে কীভাবে ধস নেমেছে, কারা এর নেপথ্যে তা তদন্ত করেছে এই কমিটি। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এই কেলেঙ্কারির নায়ক দুর্নীতিবাজরা রাজনৈতিক, সামাজিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই তদন্তের প্রয়োজনেই এদের নাম বলা যাবে না!

বাহ! কী অদ্ভুত যুক্তি। প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন দেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন এসব রাঘব বোয়ালের নাম বলা যাবে না! কারণ তারা দোর্দ- প্রতাপশালী!

এই তদন্ত ঘটনার মাধ্যমে বুঝা গেল সরকার বরাবরের মতো এসব মহাপরাক্রমশালীদের ঘাঁটতে চাইছে না। সরকার এদের তোয়াজ করেই ক্ষমতায় থাকতে চায়। এতে সাধারণ চুনোপুঁটি শেয়ার ব্যবসায়ীরা গোল্লায় যাক, তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। বিষয়টি দেশে-বিদেশে নানাভাবে আলোচিত হয়েছে। পত্র-পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী ৮৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যানের মতে এই সরিয়ে নেয়া অর্থের পরিমাণ চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি নয়।

কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমে এসব লুটপাটকারী হিসেবে কিছু নাম ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে এসইসিএর কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার নামও রয়েছে। তা নিয়েও চলছে নানা রকম বাকবিত-া। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের যাদের নাম রয়েছে, তারা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গভীর তদারকি ফাঁকি দিয়ে কীভাবে এমন যোগসাজশ তৈরি করল তা ভেবে দেখার বিষয়। অন্যদিকে ব্যবসায়ী হিসেবে যাদের নাম ছাপা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে তারা প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ে সম্পৃক্ত। আর এই সুবাদে তারা আগেই হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক ছিল এবং আছে।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এরা আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির রাজনীতির মদদপুষ্ট হলেও লুটপাটের মাঠে তারা একে অন্যের সতীর্থ। দলীয় আদর্শ তখন তাদের কাছে মোটেই মুখ্য নয়। বাংলাদেশে 'মিলেমিশে' লুটপাট করার প্রথা নতুন নয়। এর আগেও হয়েছে। বিশেষ করে এবার শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে এসব দলীয় লেবাসধারীদের একই সমান্তরালে অবস্থান তাদের মুখোশ নগ্নভাবে খুলে দিয়েছে।

কত অরক্ষিত একটি দেশে বসবাস করছে বাংলাদেশের মানুষ! এটা খুবই নিশ্চিত করে বলা যায়, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে যদি শুধু বিএনপিপন্থি শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততা থাকত তবে, মহাজোট সরকার গলা হাঁকিয়ে তাদের নাম বলে বেড়াত। যেহেতু এই কেলেঙ্কারিতে আওয়ামী লীগপন্থি শীর্ষ ব্যবসায়ীরাও জড়িত রয়েছে, সে কারণেই 'ভাসুরের নাম মুখে নিতে' লজ্জা পাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মতো 'নীতিবান' একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর কিংবা আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো একজন 'নীতিবান' অর্থমন্ত্রীর কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকারি জাঁতাকলে এভাবেই পিষ্ট হচ্ছে গণমানুষের স্বপ্নের বাংলাদেশের অর্থনীতি। আমার প্রশ্নটি হচ্ছে এই, ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যে স্বপ্ন মানুষকে দেখাচ্ছেন, তা কী এভাবে বাস্তবতার পরশ পাওয়ার কোন সুযোগ রয়েছে? শেয়ারবাজার লুটপাটের যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে তার কিছু কারণও নির্ণয় করেছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট সম্পর্কে বলা হয়েছে_ প্রাইভেট প্লেসমেন্ট এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। প্রভাবশালীদের আইপিও মূল্যের তুলনায় কম মূল্যে প্লেসমেন্ট বরাদ্দ দিয়ে অনেক অনৈতিক কর্মকা- করার ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে এসইসির প্রাইভেট প্লেসমেন্ট সম্পর্কে কোন বিধিমালা না থাকার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের শেয়ার লেনদেন সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের মধ্যে লেনদেনের প্রবণতা সাম্প্রতিককালে ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে অফিসের কাজ কর্মের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। কর্মকর্তারা অনেক সময় ঘুষ হিসেবে প্লেসমেন্ট শেয়ার দাবি করছেন। যা দেশে ঘুষের নতুন সংস্করণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

আরও বলা হয়েছে অনেক কর্মকর্তা নিজ নামে না নিয়ে, বেনামে ও শেয়ার বেচাকেনা করছেন এবং প্লেসমেন্টও করছেন। প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, সিডিবিএল, বাংলাদেশ ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ার লেনদেনের প্রথা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। বলা হয়েছে স্টক এক্সচেঞ্জের নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাঠামো তৈরি করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। স্টক এক্সচেঞ্জের প্রশাসনিক বিভাগ থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগকে যত দ্রুত সম্ভব পৃথক করার সুপরিশও করেছে তদন্ত কমিটি।

সুপারিশ যাই করা হোক না কেন, সরকার যদি এর নেপথ্যের রাঘব বোয়ালদের চিহ্নিত করে, শায়েস্তা করতে না পারে তবে এই দুর্নীতি সমূলে বন্ধ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ভোগবাদীরা একে অন্যের পারিপূরক হয়েই লুটপাট এভাবে অব্যাহত রাখবে। তারা বারবার একই কাতারবন্দী হবে। পত্রপত্রিকায় দেখলাম বর্তমান অর্থমন্ত্রী বেশ জোর গলায় বলেছেন, এসব দুর্নীতিবাজ যদি সরকারি দলেরও হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও সরকার বদ্ধপরিকর। কিন্তু এমন কোন লক্ষণ কি দেশবাসী গেল কয়েকদিনে দেখেছেন? না দেখেননি। বরং নানা ছলছুঁতোয় এসব দুর্নীতির 'মহানায়ক'দের বাঁচাবার জন্য নানা রকমের ফন্দিফিকির করা হচ্ছে। কেউ কেউ বিভিন্ন মিডিয়া সাক্ষাৎকার কিংবা বিবৃতি দিয়ে নিজেদের সম্পৃক্তির কথা অস্বীকার করছে।

এটা খুবই পরিষ্কার বিষয় স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকেই এই 'প্রভাবশালী' মহলটি নানা সময়ের সরকারি আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। এরা কখনো সামরিক জান্তাদের মিত্র সেজে, কখনো গণতান্ত্রিক সরকারের প্রিয়ভাজন সেজে রাষ্ট্রের সুনাম এবং সম্পদ দুটোই হাতিয়ে নিয়েছে। মনে রাখা দরকার ৯৬ সালে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পরও শেয়ারবাজারে এমনি একটি পরিকল্পিত ধস নেমেছিল। যার দায় প্রকারান্তের সরকারের উপরই পড়েছিল। ২০১০-২০১১ সালের এই ধসও কাঁপিয়েছে মহাজোট সরকারের গদিকে। কারণ দায় তাদেরকেই নিতে হয় যারা ক্ষমতায় থাকেন। ভেবে অবাক হতে হয় যখন দেখা যায়, রাজনীতির মাঠে এসব ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিকরা একে অন্যের চামড়া তুলে নেয়ার মতো বুলি আওড়ালেও শেয়ারবাজার লুটপাটের মাঠে তারা একই টিমে খেলোয়াড় হিসেবে খেলছেন! ভাগ-বাটোয়ারা করছেন দুর্নীতির অর্থসম্পদ।

প্রশাসনিকভাবে বাংলাদেশ বেশ দুঃসময় পার করছে। ঘাতক-রাজাকারদের বিচারের জন্য গোটা জাতি যখন গভীর আগ্রহে উদগ্রীব তখন নানা রকম অশুভ তৎপরতার লক্ষণ প্রতীয়মান হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর বলেছেন_ 'চলি্লশ বছরের পুরনো ইস্যুভিত্তিক বিচার কার্য খুব দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে না।' সরকারের প্রায় আড়াই বছর বয়স হতে যাচ্ছে। ড. ইউনূস ইস্যু, মৌলবাদী জঙ্গিদের হুমকি, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য প্রভৃতি বিষয়গুলো সরকারের জন্য বিয়োগাত্মক চিহ্ন বহন করছে। তার উপর ভোগবাদীদের লুটপাট রাষ্ট্রের অর্থনীতির ভিতে কুড়াল মারছে। এ অবস্থায় এসব মুখোশধারী মহাপরাক্রমশালীকে চিহ্নিত করে এদের বিষদাঁত ভেঙে দেয়া সরকারেরই প্রধান কর্তব্য। তা না হলে মহজোটকে অনুতাপ করতে হবে অদূর ভবিষ্যতে।

by- fakir ilias-priyo.com