বরিশাল হলিকেয়ার সেন্টারে পুলিশী অভিযান

হলিকেয়ারে রোগীকে নির্মম নির্যাতনে হত্যার ঘটনায় অবশেষে টনক নড়েছে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। সোমবার রাতে পুলিশের একটি দল হলিকেয়ার সেন্টারে কয়েক ঘন্টা ব্যাপী অভিযান চালিয়েছে। পুলিশী অভিযানের আগেই গা ঢাকা দিয়েছে হলিকেয়ারের পরিচালক ঘাতক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন।

এর আগে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে কয়েক লাখ টাকা নিয়ে মাঠে নেমে মিডিয়া ম্যানেজে ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্য পুরোপুরি হতাশ হলিকেয়ারের পরিচালক ঘাতক সুমন ও তার শেল্টারদাতরা। বিশেষ করে জনৈক শেল্টারদাতার মিশন ব্যর্থ হওয়ায় ঘাতক সুমন বর্তমানে আতœগোপনে রয়েছে। মুলত জাকির হোসেন হত্যার বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় অনুসন্ধানী রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে। হলিকেয়ারের শেল্টারদাতা সম্পর্কেও পুলিশ খোঁজ খবর নিচ্ছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে ।

সোমবার রাত ৯টায় বরিশাল কোতোয়ালী মডেল থানা পুলিশ হলিকেয়ার সেন্টারে অভিযান শুরু করে। পুলিশ জাকির হত্যার নানা বিষয়ে দ্বায়িত্বরতদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দ্বায়িত্বরতদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা গোলাম মর্তুজা জুয়েল, মার্কেটিং অফিসার সাখাওয়াত হোসেন ও ডিপ্লোমা নার্স পুলিন সরকার। সেখানে পুলিশ রেজিষ্টার খাতা ও ব্যাবস্থাপত্র দেখেন। রেজিষ্টার খাতায় জাকির হত্যার বিষয়ে তাদের দেয়া তথ্যের সঙ্গে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমাজেন্সি বিভাগের তথ্যে গড়মিল পাওয়া গেছে। শেবাচিম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোন মৃত্যু সনদ দেখাতে না পারলেও হাসপাতালের বিতর্কিত চিকিৎসক ডাঃ ফারুক আলমের নিকট থেকে অর্থের বিনিময়ে একটি ভূয়া মৃত্যু সনদ সংগ্রহ করেছে হলিকেয়ার কর্র্তৃপক্ষ। ওই মৃত্যু সনদে বলা হয়েছে ১৬ এপ্রিল বিকেল ৪টার আগেই রোগী মারা গেছেন। অর্থাৎ হাসপাতালে নেয়ার আগেই রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আর হলিকেয়ারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গোলাম মর্তুজা জুয়েল জানিয়েছেন রোগী জাকির বিকেল সাড়ে ৪টায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিকেল পাঁচ টায় শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তবে হলিকেয়ার কর্তৃপক্ষ জাকিরের মৃত্যু ও পরিবারের নিকট লাশ হস্তান্তরের কোন কাগজ পত্র দেখাতে পারে নি। এক্ষেত্রে ডাঃ ফারুক আলম ও হলিকেয়ার কর্তৃপক্ষের তথ্যের মধ্যে ব্যাপক গড়মিল পেয়েছে পুলিশ। ডিপ্লোমা নার্স পুলিশ সরকার পুলিশকে বলেছেন আমাদের এখানে নিয়োগকৃত কোন চিকিৎসক না থাকায় আমি রোগীর প্রেসার পরীক্ষা করে পালস কম থাকায় ওরাল স্যালাইন খাইয়ে দেই।

এ প্রসঙ্গে আলাপকালে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ আবদুর রশীদ জানান হাসপাতালের ইর্মাজেন্সী থেকে কোন লাশ নিতে হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে নিতে হয়। আর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করে অনুমতিক্রমে লাশ গ্রহন করতে পারবে। অন্যথায় ময়নাতদন্ত বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে ডাঃ ফারুক আলম যথাযথ দ্বায়িত্ব পালন করেনি। এ কারনে মঙ্গলবার হাসপাতালে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্ত কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিবে।

বরিশাল কোতোয়ালী মডেল থানার উপ-পরিদর্শক আবু সাইদ বলেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হলিকেয়ার সেন্টারে গিয়ে কাগজ পত্র যাচাই বাছাই করেছি। রোগীর মৃত্যর সময় নিয়ে হলিকেয়ারের দ্বায়িত্বরতদের অপ্রসাঙ্গিক কথা বার্তায় নির্যাতনে মৃত্যুর বিষয়টি অনেকটা পরিস্কার। তিনি আরো বলেন হলিকেয়ারে চিকিৎসক থাকার নিয়ম থাকলেও সেখানে কোন চিকিৎসক নেই।

প্রসঙ্গত হলিকেয়ার সেন্টারের পরিচালক সুমন মোস্তাফিজ। তার বাসা নগরীর ক্লাব রোডের জাহাঙ্গীর ম্যানশন। তিনি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা কেন্দ্রের আড়ালে দেদারছে মাদক ব্যাবসা করে আসছে। একই সঙ্গে মাদক নিরাময় হলিকেয়ার সেন্টারকে তিনি অনেকটা টর্চার শেলে পরিনত করেছেন।  নানাবিধ অপকর্মে  বেশ কয়েকবার মিডিয়ার শিরোনামও হয়েছেন এই সুমন। সূত্র বলছে, উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের খলেদপুর এলাকার আবদুল মান্নানের পুত্র জাকির হোসেন (৩৮)। তিনি বিটিসিএল’র নিজস্ব পরিবহনের চালক পদে কর্মরত ছিলেন। সম্বপ্রতি নগরীর মুনসুর কোয়াটারে  ভগ্নিপতি ইউনুছের বাসায় বেড়াতে আসেন। গত ১৪ এপ্রিল বোন মুক্তা বেগম ভাই জাকিরকে জর্ডান রোডের মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে। শুরু থেকেই চিকিৎসার নামে তাকে শারীরিক নির্যাতন করে দ্বায়িত্বরতরা। একপর্যায়ে তাদের অমানুষিক নির্যাতনেই প্রান হারাল যুবক জাকির। শনিবার বিকেল ৫টার দিকে তাদের নির্যাতনে মূমুর্ষ অবস্থা হলে তাকে নিয়ে শেবাচিম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন হলি কেয়ারের ডিপ্লোমা নার্স পুলিন সরকার। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তির আগে জাকির মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। নিহত জাকিরের বোন মুক্তা হলিকেয়ারে ভর্তির পর সেখানে আমাদের আর প্রবেশ করতে দেয় নি। ঘটনার দিন দুপুরেও হলিকেয়ারে ফোন করে জাকিরের খোঁজ নিলে দ্বায়িত্বরতরা বলেছেন জাকির সুস্থ রয়েছে। সে এখন ঘুমাচ্ছে। বিকেল ৫টায় হলিকেয়ার থেকে ফোন করে জানায় যে জাকির মারা গেছে। স্বজন মনির হোসেন জানিয়েছিল নিহতের শরীরের গলায় রক্ত জমাট রয়েছে। এরবাইরে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ময়না তদন্তের রিপোর্টে হত্যা না স্বাভাবিক মৃত্যু তা পরিস্কার হত। কিন্তু লাশ মর্গে প্রেরন না করে ডাঃ ফারুক আলমের সহযোগীতায় দ্রুত হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে যায়। এরপর পরিবারকে কৌশলে  ম্যানেজ প্রক্রিয়ায় রোববার বেলা ১১টায় মরদেহের জানাজা শেষে উজিরপুরের গুঠিয়া ইউনিয়নের খলেদপুর এলাকার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।