অফিসগুলো ভাত-তরকারির কারখানা

আজ বহু বছর ধরে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে ভাত-তরকারির কারখানা খুলে ফেলেছে। আগে, মানে স্বাধীনতার কিছু বছর পর্যন্ত একটু রাখঢাক মতন ছিল, কিন্তু এখন বেশ কিছু বছর ধরে আর রাখঢাক বলে কিছু নেই। এখন যেকোনো অফিসে সকাল ১০-১১টার সময় গিয়ে হাজির হলে নাকে ভাত-তরকারির গন্ধ মানুষের পাছ ছাড়ে না। ভালো জামাকাপড় পরে আপনি কোনো অফিসে ঢুকবেন, তারপর কাজ সেরে (যদি সেটা আদৌ সারা হয়) বেরোনোর সময় জামায় তরকারির গন্ধ নিয়ে খুশি মনে বেরিয়ে আসবেন!

এখন তো এমন অবস্থা যে তাদের খাবারের মেন্যু কী হচ্ছে সেদিন সেটা পর্যন্ত আপনার চোখে পড়বে। সেদিন এক অফিসে কাজ সারতে গেছি এবং চুপ করে বসে আছি, যেহেতু অফিসার তার সিটে নেই, তারপর অফিসার যখন সিটে এলেন, তিনি বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, এখানে কেন বসে আছেন, আপনার কাজ তো পাশের ডিপার্টমেন্টে। তো গেলাম পাশের ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু সেখানে যেতে গেলে পেছনের বারান্দা পেরিয়ে যেতে হয়। পেছনের বারান্দা পেরোনোর সময় বারান্দার তোলা চুলায় টগবগ করে মাছের ঝোল হাঁড়িতে ফুটছে দেখা গেল। এতক্ষণ নাকে মাছের ঝোলের গন্ধ পাচ্ছিলাম।
কিন্তু গন্ধের উৎস এবং কী মাছ সেটা জানতাম না। এবার চোখের সামনেই সেটা দেখতে পেলাম। বেগুন দিয়ে নলা মাছের ঝোল। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, বারান্দায় পড়ে আছে শাক চচ্চড়ি হওয়ার শাক। সেগুলো আরেকজন মহিলা বসে কাটাবাছা করছে। আরেকটি চুলোয় টগবগ করে ফুটছে ডাল। ভাত এখনো চাপানো হয়নি, তবে হবে। কারণ ভাতের হাঁড়িতে এক কাঁড়ি চাল আধোয়া অবস্থায় পড়ে আছে। সবচেয়ে বড় কথা, বারান্দাটা অফিসেরই একটি অংশ, সেখান দিয়ে অফিস আওয়ারে সারাক্ষণ লোকে চলাচল করছে। অফিসে রান্নাঘর পেতে রাখার জন্য বিন্দুমাত্র কোনো লজ্জা নেই দেখলাম।

পাকিস্তান আমলে বা ব্রিটিশ আমলেও বাংলার মানুষ ভাত-তরকারিই খেত। কেক, পেস্ট্রি বা কাবাব-পরোটা খেত না। কিন্তু কোনো দিন অফিস-আদালত ভাত-তরকারি দিয়ে সয়লাব করে ফেলত না। বড় বড় অফিসে বা ছোট ছোট অফিসেরও বস বা বড় সাহেবরা ছিল উর্দুঅলা। লাঞ্চ টাইমে তারাও লাঞ্চ করত। কিন্তু তারা ভাত খেত না। তাদের খাবার ছিল শুকনো খাবার। সাধারণ খাবার। স্যান্ডউইচ বা ডাল-রুটি। তখন তাদের অধস্তন কর্মচারীরা ছিল সব বাঙালি। তখন কোনো দিন বাঙালি কেরানি বা ছোট অফিসার অফিসে বসে ভাত-তরকারি খেত না। বা খেলেও হয়তো বাড়ি থেকেই খাবার করে নিয়ে আসত। তখন অফিস-আদালতে ভাত-তরকারির গন্ধ ছিল অকল্পনীয় একটি ব্যাপার। এবং লজ্জার কথাও বটে। এখন অফিসের কামরায়, বারান্দায়, হলঘরে_সব জায়গায় ভাত-তরকারির গন্ধ।

বড় বড় সব অফিসে ক্যান্টিন আছে, ক্যান্টিন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থিত। সেখান থেকে খাবার খেয়ে এলে সারা অফিস এবং তার প্রাঙ্গণজুড়ে ভাত-তরকারির গন্ধ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেটা হয় না। এখন সবাই যাদের অফিসে রান্না হয় না, যেমন খুব ছোট ছোট অফিস, তারাও পোঁটলা বেঁধে ভাত-তরকারি বাড়ি থেকে এনে কাজের টেবিলে বসে দুপুরবেলা খায়। তাদের সেই ভাত খাওয়ার গন্ধ অফিসের কামরায় দাপাদপি করে বেড়ায়। টেবিলে বসে সেদিন এক ঘোমটা পরা মহিলাকে দেখলাম মাগুর মাছের মাথা চুষছেন। টিফিনকারির বাটিতে হাত ডুবিয়ে খাচ্ছেন, যেহেতু টেবিলে প্লেট পাতার অবস্থা নেই ।

কৌতূহল চাপতে না পেরে একদিন একটা নামকরা ব্যাংকের অফিস লাগোয়া রান্নাঘরে গিয়ে রান্নার মহিলাদের বললাম, অফিসের সব লোক এই ভাত-তরকারি খাবে?

হ। গম্ভীর মুখে সে উত্তর দিল।

এতসব রোজ বাজার করে কে?

ক্যান, আমাগো আপিসে মানুষ কম নাকি?

বিরক্ত হয়ে মহিলা উত্তর দিল।

আর পয়সা? রোজ রোজ পয়সা দেয় কে?

অত খোঁজে আমাগো দরকার কী? আমরা কাজের বুয়া, কাজ কইরা পয়সা লইয়া চইলা যাই।

সকলে কি একসঙ্গে বসে খান এই অফিসে?

না, তা কি কইরা হইবে। যার যখন সময় হয়, তখনই খাইয়া লন। কেউ তাগো টেবিল-চেয়ারে বইসা খান। কেউ এইখানে আইয়া খান।

ভাত খাওয়ার পর তারা কি একটু ঘুমান?

বাঃ, ঘুমাইবে না? থোড়া টাইমের লাইগা তো ঘুমাইবে? তারপর নামাজ পড়া আছে, তারও তো সময় লাগে। রাতদিন দিন দুনিয়ার কাম কইরলে হইব, আখেরাতের কাম আছে না?

কথাটা সত্যি। দিন দুনিয়ার কাজের সঙ্গে সঙ্গে আখেরাতের কাজও সারতে হবে। আবার আখেরাতের কাজের সঙ্গে সঙ্গে দিন দুনিয়ার কাজও সারতে হবে। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে বা পাকিস্তান আমলে এই দিন দুনিয়া আর আখেরাতের কাজ কাম সব শিঁকেয় তোলা ছিল। ইংরেজ আমলে ঘুমালেই বড় সাহেব রবার্টসন এর চোখে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল বা পাকিস্তান আমলে মেজ সাহেব মিস্টার গুলজারের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হওয়ার শঙ্কা ছিল। এবং প্রমোশনের টানাটানি ছিল। তখন একজন অফিসার সুন্দর জামাকাপড় পরে অফিসে আসত এবং লাঞ্চ পিরিয়ডে এমন খাবার খেত বা বাইরে গিয়ে খেয়ে আসত, যেসব খাবারে কোনো গন্ধ হতো না অফিসের কামরায়। কিন্তু এখন অফিস-আদালতের চেহারা একেবারে ভিন্ন।
সেদিন একজন প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাকে আমার দুশ্চিন্তার কথা জানালাম। বললাম, ভাইজান, দেশের অফিস-আদালতগুলো যে একেবারে প্রাইভেট হাউস হয়ে উঠল দিনে দিনে। এখন অফিসের ফাইল আর ভাতের থালা বা টিফিনকারির বাটি একই স্থান অধিকার করে ফেলছে। এখন একনেকে যে ফাইলটা একটু পরেই মন্ত্রীর কাছে যাবে, তার পাশেই রাখা আছে টিফিনকারির বাটি, যে বাটিটা একটু পরেই খাওয়ার জন্য খোলা হবে! মাঝে মাঝে ঝোল, তরকারিও লেগে যাচ্ছে দামি দামি ফাইলের গায়ে।

উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা একগাল হেসে বললেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছি কেন বোনটি? মুক্তিযুদ্ধ করেছি সব কিছু থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। আচার, আচরণ, ব্যবহার, শালীনতা, এটিকেট, ডিসিপ্লিন, ডেকোরাম, বড়সাহেব, মেজসাহেব, ছোটসাহেব, কেরানি_সব কিছুর হাত থেকে মুক্তি। এখন অফিস হচ্ছে বাড়ি, বাড়ি হচ্ছে অফিস। এখন অফিসে ঢুকে শুধু কি আপনি ভাত খাওয়ার জন্য প্লেট আর টিফিনকারি দেখেন? নামাজের পাটি আর বদনা দেখেন না অফিসের একটা কোণ অধিকার করে বসে আছে? যেন অফিসের চেহারা দেখে মুহূর্তে আপনি বুঝে যান আপনি পরহেজগার এক অফিসে পা রেখেছেন, বুঝলেন? আপনাদের মতো ডিসপেপটিক মানুষ দিয়ে কি দেশ চলবে? এখন বড় সাহেবও তাঁর ঘরের টেবিলে বসে মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খান। তাঁর কেরানিও তাঁর লেখার টেবিলে বসে টিফিনকারির ভেতরে হাত ডুবিয়ে মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খায়। গন্ধে ম-ম করে কেরানি আর সাহেবের ঘর। কী সুন্দর একটা সমতা অর্জিত হয়েছে দেশে। আর কিছুতে না হোক, অন্তত অফিসে বসে ভাত খাওয়ার ইস্যুতে সাহেব আর কেরানি একই সাগর সঙ্গমে এসে মিলিত হয়েছে। এটা কী কম বড় অর্জন?

লেখক : মনোবিজ্ঞানী ও কথাসাহিত্যিক – কালেরকন্ঠ ডট কম