ছোটলোকের বড়মানুষি

সুন্দরী রিসিপসনিস্ট এর মধুর কন্ঠেও বিরক্ত হন হায়দার সাহেব। বিরক্তির কারন এই কাশেম, তার প্রাইমারি স্কুলের বন্ধু। যদিও তার খুশি হবার কথা, এত পুরাতন দিনের বন্ধু, এতদিন পর দেখা। কিন্তু মনের ভিতর আশংকা কাটে না। গ্রামের এই “ছোটলোক” গুলো পুরাতন বন্ধুত্বের সুত্রধরে শুধু টাকা চাইতেই আসে।

বিরক্তি লুকানোর চেষ্টা না করেই তিনি রিসেপসনিস্টকে বলেন, ঠিক আছে, ওকে উপরে পাঠিয়ে দাও।

হায়দার সাহেব একটি বহুজাতিক কোম্পানীর বড় পদে চাকরি করেন। গ্রামের পাট তিনি চুকিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা শহরে পড়তে আসেন। কলেজ-ইউনিভার্সিটি শেষ করেই ঢুকে যান বেসরকারি চাকরিতে। সে সময় সবাই সরকারি চাকরির জন্য জান দিয়ে দিত। কিন্তু উচ্চাভিলাষি হায়দার সাহেব সরকারি চাকরি পেয়েও নেন নি। দুটো ছোট কম্পানী বদলিয়ে ঢুকে যান এই বহুজাতিক কোম্পানিতে। আর ফিরে তাকানোর দরকার হয়নি। আজ তিনি দুই দিয়ে শুরু ছয় অংকের উপরে বেতন পান, গাড়ি-বাড়ি সব হয়েছে। মাঝে মাঝে সপ্তাহান্তে পানি পানের পার্টি কিম্বা ছুটি কাটাতে বিদেশ যাওয়াও চলে।

পিওন সাথে করে নিয়ে আসে কাশেম কে। ছিমছাম ভাবে গুছানো বহুজাতিক অফিসের বড় স্যারের রুমে গ্রাম থেকে আসা কাশেমকে বড়ই বেমানান লাগে। জড়সড় হয়ে বসে কাশেম। হায়দার সাহেব যথাসম্ভব বিরক্তি লুকিয়ে পিওনকে বিস্কিট-চা দিতে বলেন, আর খুশীর ভাব নিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করেন,

কাশেম, কি খবর? কেমন আছ? আসতে কোন কষ্ট হয় নি তো?
না, না, কষ্ট হবে কেন? আর একটা ভাল কাজ নিয়ে বেরিয়েছি তো, ছোট-খাট কষ্ট গায়ে লাগে না। তা তোমার কি খবর বলো, গ্রামে তো আর যাওনা অনেক দিন।

“আসলে খুব ব্যাস্ত থাকতে হয় তো। আর বাব-মা মারা যাবার পর গ্রামের শিকড়টাও মনে হয় ছিড়ে গেছে। তাছাড়া তোর ভাবি শহরের মেয়ে তো, গ্রামে যেতে চায় না সাথে আছে বাচ্চাদের স্কুল। এই সব মিলে যাওয়া হয় না আরকি”। নিজের অপরাধবোধ ঢাকার চেষ্টা করেন হায়দার সাহেব। “তা কি কাজ নিয়ে বের হয়েছিস?”

তুমি থেকে তুই তে নেমে আসেন হায়দার সাহেব, পুরাতন বন্ধুকে পেয়ে কিছুটা খোলস ছেড়ে বেরিয়েও আসেন যেন। পিওন চা নিয়ে আসে, সাথে দামি বিস্কিট। চায়ে চুমুক দিয়ে কাশেম আবার কথা শুরু করে। কাশেম ও তুই তে নেমে আসেন, মনের আশাটি প্রস্ফুটিত হতে থাকে, হয়ত তার কাজটা হবে।

দোস্ত, আমাদের সবার মধ্যে তুই সবচে ভাল আছিস। আমরা সব সময় তোর কথা বলি। এত বড় অফিস!! আমরা জানতাম তুঈ বড় অফিসে বড় পদে চাকরি করিস, কিন্তু এত বড় অফিস, না আসলে মনে হয় বিশ্বাস হত না!

ভুমিকা বুঝতে পারেন হায়দার সাহেব, তার আশংকা সত্যি হতে চলেছে, নিশ্চয় টাকা চাইবার মতলব। তবে তার জানা মতে কাশেমের অবস্থা খুব খারাপ নয়, সে কেন টাকা চাইতে আসবে? যাই হোক, পটভূমি বদলাতে হবে।

হায়দার সাহেব বলেন, তোরা তো বাইরের দিক টা দেখিস বা লোকের মুখে বাড়ানো গল্প শুনিস। আরে দোস্ত, চাকরি তো মোটামোটি বড়ই করি। কিন্তু কিইবা করতে পেরেছি বল? সব কিছুর যা দাম! এপার্টমেন্ট একটা অবশ্য কিনেছি, আরেকটা কিনা দরকার, আমার তো দুই বাচ্চা। বাচ্চাদের স্কুলে রাজ্যির খরচ। গাড়ি একটা পাইছি অফিস থেকে, বউ-বাচ্চার জন্য আরেকটা গাড়ি কিনা দরকার তাও পারছিনা। বছরে একবারের বেশী বিদেশে যাইতে পারিনা। মেয়েটা বড় হচ্ছে, ওর জন্য সোনা-গয়না কিনা দরকার, এখন থেকে কিনে না রাখলে তো হবে না, যে হারে দাম বাড়ছে!
একটু শরম পাওয়ার ভংগী করে আবার বলেন, যাক, কি বক বক করছি, তোর কথা বল। কি জন্য এসেছিস। আমার আবার আরেকটা মিটিং-য়ে যেতে হবে।

কাশেম এবার একটু ইতস্তত করে, মনে মনে ভাবে বাবারে ওর এত অভাব?তাহলে কি আসাটা ভুল হল? যাহোক এসেছি যখন এতটা পথ, বলেই দেখি না কি হয়। কাশেম এবার তার আসবার ঊদ্দেশ্যটা ব্যাক্ত করে।

দোস্ত, আমাদের সাথে পড়ত ওই আশরাফ কে কি মনে আছে? ক্লাস ফাইভ শেষ করেই শহরে একটা দোকানে সেলসম্যানের চাকরি নিয়েছিল? তো দীর্ঘদিন ওখানে চাকরি করেছে খুব অল্প বেতনে। দুটি বাচ্চা তার, বাচ্চাগুলো খুব মেধাবী। মেয়েটি ক্লাস নাইনে পড়ছে, ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছিল। ছেলেটি ক্লাস ফাইভে পড়ছে। ওর মালিক ব্যাবসা বন্ধ করে দেয়ায় ওর চাকরি টা চলে গেছে। এখন ও ভাবছে পাশের উপজেলা শহরে একটি নিজেই দোকান দেবে। পঞ্চাশ হাজার টাকায় একটা দোকানের পজেশন ঠিক করেছে, আর পঞ্চাশ হাজার লাগবে পুজি। আমরা পাচজনে ওর প্রত্যেকে ওক দশ হাযার করে দিচ্ছি…বাকীটা তুই দিবি। এই সাহায্যটুকু করলে ও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে আল্লাহর রহমতে।

হায়দার সাহেব মনে মনে আঁতকে ওঠেন, একেবারে পঞ্চাশ হাজার!! এ যে ডাকাতি। সাথে ব্যাস্ততার ভান করেন, ফাইল পত্র গোছানো শুরু করেন, হাত ঘড়ি দেখে বোঝাতে চেষ্টা করেন তার মিটিং-এ যাওয়া দরকার। কর্পোরেট কুটনীতির ভাষায় বলেন, দোস্ত, (তুই থেকে তুমিতে উঠে আসেন আবারো) তোমরা তো খুব ভাল উদ্যোগ নিয়েছ, একজন মানুষ কে স্বনির্ভর করার চে মহতী কাজ আর কি হতে পারে? কিন্তু দোস্ত এত টাকা কিভাবে দেই বলো? গত মাসে আমি একটা প্লট বুকিং দিয়েছি, ব্যঙ্ক লোন নিয়ে, অনেক টাকা কিস্তি দিতে হচ্ছে। শোন যদিও আমার খুব অসুবিধা কিন্তু এরকম ভাল একটা কাজে আমি অবশ্যই সাথে থাকব। আমি পাচ হাজার টাকা দেব, তবে আমাকে তিন মাস সময় দিতে হবে।

কাশেম আশাহত হয়। বলে, আশরাফ আমার খুবই কাছের বন্ধু। ওর সাহায্যটা করতে চেয়েছিলাম, হয়ত আয়-উপার্জন ভাল থাকলে মেয়েটার পড়াশুনা চালিয়ে নিতে পারত। না হলে হয়ত মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। আমাদের সাধ্য তোমার বোঝার কথা, আমরা অনেক কষ্টে পঞ্চাশ হাজার যোগাড় করেছি। আচ্ছা তুমি না হয় টাকাটা ধার হিসাবে দাও, পরে মাসে মাসে কিছু করে শোধ করে দিবে।

হায়দার সাহেব কঠোর হন, পকেট থেকে এক হাজার টাকা বের করে কাশেমের হাতে দিয়ে বলেন, এটা নিয়ে যাও, পরে আরো চার হাজার আমি পাঠিয়ে দেব। তোমার আর কষ্ট করে আসতে হবে না। আর শোন টাকা থাকলে ধার নয়, আমি এমনি দিতাম। আপাতত দেয়ার মত টাকা নাই।

কাশেম এবার হাল ছেড়ে দেয়। বলে আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার অসুবিধা থাকলে তুমি কিভাবেই বা দিবা। সমস্যা নাই, কোন এনজিও থেকে ওকে লোন নিয়ে দেব। তবে আরেকটা আবদার তোমাকে রাখতেই হবে। সামনে মাসে তুমি একবার গ্রামে আস। গাড়িতে গেলে মাত্র দুই ঘন্টার রাস্তা। সকালে চলে আসবা, আমার বাড়িতে দুইটা ডাল-ভাত খেয়ে বিকালে চলে আসবে। আগে থেকে জানালে সেদিন বিকালে আশরাফের দোকানে মিলাদ দিব।

হায়দার সাহেব যেন হাঁফ ছেড়ে বাচেন। যাক বাবা, পয়তাল্লিশ হাজার টাকা বেঁচে গেল শুধু একবার গ্রামে যাবার বিনিময়ে …..তাও আবার নিজের বাল্যস্মৃতি জড়ানো গ্রাম! এবার তিনি সহজেই রাজি হয়ে যান।

মাসখানেক পর।

কাশেমের সাথে গ্রাম ঘুরে দেখছিলেন হায়দার সাহেব, কেমন যেন ঘোর লাগা ভালবাসার টান তিনি অনুভব করছেন হৃদয়ে। গ্রাম বদলে গেছে এটা যেমন ঠিক, তবে এখনো অনেক মানুষ অনেক দরিদ্র। আশরাফের মেয়েটার সাথে দেখা হয়, জীর্ণ পোষাকে দারিদ্রের চাপে পিষ্ট যেন এক গোলাপ ফুল। এই মেয়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে! আশরাফের সাথে তার প্রতিদ্বন্দিতা ছিল পুরো প্রাইমারি জুড়ে, তাকে ডিংগিয়ে কখনই তিনি প্রথম হতে পারেনি। দিনমজুর বাবা পড়া-শুনার খরচ চালাতে না পারার কারনেই তাকে ঝরে যেতে হয়। তার মেধাটায় বোধহয় তার ছেলে-মেয়েগুলো পেয়েছে। নিজের অর্জনে এক ধরনের গর্বও হয় তার, শেষ পর্যন্ত তিনি তার প্রতিদ্বন্দী কে হারিয়েছেন, জীবনের যুদ্ধে। একই সাথে জীবন যুদ্ধে আশরাফের এই পরাজয় তাকে দুঃখও দেয়। নিজের অভাব ও দুঃখবোধের জন্য অনুতাপ হয় হায়দার সাহেবের। ভাবেন টাকাটা দিলে এমন বিশেষ কোন ক্ষতি তার হত না। পঞ্চাশ হাজার টাকা সত্যি তার কাছে এমন বেশি কিছু নয়।

দুপুরে খেতে বসে কাশেম কে জিজ্ঞেস করেন আশরাফের কথা, ও লোন পেল কিনা, ওর দোকানের ওপেনিং আজ হচ্ছে কিনা। কাশেম জানায় ওর দোকানটা আর নেয়া হয়নি। মোটামোটি সব যখন ঠিকঠাক তখন পাশের গ্রামের মুরুব্বি আমাদের আনিস স্যারের হার্টের অসুখ ধরা পড়ে, তুমি হয়ত তাকে চিনতে পার, হাইস্কুলে আমাদের ম্যাথ পড়াত। তিনি আমাদের সবার শিক্ষক ছিলেন, গ্রামের অনেকেই তার কাছে পড়েছে। তার চিকিতসার টাকা যোগাড় হচ্ছিল না, তখন গ্রামের বাড়ি বাড়ি যেয়ে টাকা তোলা হয়। তখন আশরাফ ওর জন্য তোলা পঞ্চাশ হাজারের পুরোটা আনিস স্যারের চিকিতসার জন্য দিয়ে দিতে বলে। ও শহরে আরেক টি দোকানে চাকরি নিয়েছে।

হায়দার সাহেবের গলায় যেন খাবার আটকে যায়। মনে হয় প্রাইমারী পাশ হতদরিদ্র পুরাতন প্রতিদ্বন্দী (তার ভাষায় “ছোটলোক”)এর কাছে তিনি আবারো হারলেন, হঠাত করেই নিজের অর্জন গুলোকে খুবই অর্থহীন ও ঠুনকো মনে হয়।

সূত্র: সামহোয়ারইনব্লগ