সংখ্যালঘু নির্যাতন বিচারের অপেক্ষায় নির্যাতিতরা

চারদলীয় জোট সরকার গঠনের পর তাদের সন্ত্রাসী ক্যাডার কর্তৃক বরিশালের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলার সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ এ অঞ্চলের সহিংস ঘটনা তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিশনের ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল  বরিশাল সার্কিট হাউজে তদন্ত কাজ সম্পন্ন করেছেন। এ সময় তদন্ত কমিশনের প্রতিনিধি দল নির্যাতিতদের সাথে কথা বলেন। তারা নির্যাতিতদের কাছ থেকে লিখিত জবানবন্দি, ঘটনার বর্ননা ও  ছবি সংগ্রহ করেছেন। তদন্তের পর একটি বছর পার হলেও এখনো বিচার পাননি গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার নির্যাতীতরা। বিচার পাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন এসব উপজেলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আওয়ামীলীগ সমর্থিত নির্যাতিতরা।

গতকাল মঙ্গলবার গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার বিভিন্ন এলাকার ২০০১ সালে নির্যাতিত পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর পরই গৌরনদী উপজেলার বার্থী, খাঞ্জাপুর, সমরসিংহ, বাঘমারা ,চন্দ্রহার, আধুনা, শাহজিরা, বাঘার, বিল্লগ্রাম, দোনারকান্দি, বাকাই, আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার, বাকাল, বাগধা, আস্কর, কালিবাড়িসহ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় বিএনপি জামায়াত জোটের ক্যাডাররা হামলা, ভাংচুর, চাঁদাবাজি, লুট ও ধর্ষনের মতো হিংস্র ঘটনা ঘটায়। ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল বরিশাল সার্কিট হাউজে কমিশনের চেয়ারম্যান জেলা দায়রা জজ (অবঃ) মোঃ শাহাবুদ্দিন, সদস্য সিআইডি অতিরিক্ত ডি.আই.জি (অবঃ) মোঃ সহিদুল ইসলাম, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের উপ-সচিব (অবঃ) মোঃ মনোয়ার হোসেন নির্যাতনের ঘটনা তদন্তের জন্য বরিশাল সার্কিট হাউজে হাজির হন। ওই দিন সকাল থেকেই নির্যাতনের বর্ননা দিতে বরিশাল সার্কিট হাউজে জড়ো হতে থাকে গৌরনদী- আগৈলঝাড়ার শত শত নির্যাতিত নারী ও পুরুষ। এ সময় গৌরনদীর ২৬০জন ও আগৈলঝাড়ার ১৮০জন নির্যাতনের ঘটনার বর্ননা দেন কমিশনের কাছে। তদন্ত শেষ না হওয়ায় নির্যাতিতরা সময় বৃদ্ধির আবেদন করেন। পরে কমিশন একদিন সময় বৃদ্ধি করে ১২ এপ্রিল সরেজমিনে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় এসে দ্বিতীয় দিন তদন্ত কাজ সম্পন্ন করেন। তদন্তের দুইদিনে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার ৬৬০ জন নির্যাতিতরা লিখিত অভিযোগ জমা দেন। এরমধ্যে গৌরনদীর ৩১০ জন ও আগৈলঝাড়ার সাড়ে তিনশত অভিযোগ জমা পরে। গতকাল মঙ্গলবার কথা হয়, ২০০১ সালে গৌরনদী উপজেলার বিল্লগ্রাম গ্রামের ধর্ষিতা হাজেরা বেগমের (৩০) সাথে। তিনি জানান, গৌরনদী উপজেলা আওয়ামীলীগের তৎকালীন সভাপতি কালিয়া দমন গুহুর রাইস মিলে তিনি কাজ করতেন। ২০০১ সালে নির্বাচনের পর বিএনপির সন্ত্রাসীরা চাঁদার দাবিতে মিলটি বন্ধ করে দেয়। ৭ মাস পর ২০০১ সালের মে মাসে তিনি (হাজেরা) কাজে যোগদান করে মিলটি চালু করতে গেলে  ১১ মে সকালে স্থানীয় যুবদলের সন্ত্রাসীরা মিলে হামলা চালিয়ে লুটপাট করে। এ সময় ওই সন্ত্রাসীরা হাজেরাকে পালাক্রমে জোর পূর্বক ধর্ষন করে। পরবর্তীতে স্থানীয়রা ধর্ষিতাকে উদ্ধার করে গৌরনদী হাসপাতালে ভর্তি করেন। তৎকালীন সময় পুলিশ ধর্ষিতার জবানবন্দি রেকর্ডসহ ধর্ষনের আলামত উদ্ধার করলেও আজো বিচার পায়নি হতভাগ্য হাজেরা। তিনি আরো জানান, বিচার পাওয়ার আশায় ২০১০ সালে তদন্ত কমিশনের কাছে অভিযোগ জমা দিয়েছি কিন্তু আজো বিচার পাইনি।

আগৈলঝাড়া উপজেলার সুতার বাড়ি গ্রামের পঙ্গু সঞ্জিব কুমার জানান, ২০০১ সালে নির্বাচনের পর তার বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট চালায়। তাকেসহ তার পরিবারের নারী ও শিশুদের গাছের সাথে বেঁধে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করা হয়। সে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিএনপি জামায়াতের ক্যাডাররা তার ১২০ শতক দীঘির প্রায় ১০ লক্ষাধিক টাকার মাছ লুট করে নিয়ে যায়। চাঁদশী গ্রামের নির্যাতিত কৃষ্ণ কান্ত দে (বর্তমানে নব নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান) অভিযোগ করেন, ২০০১ সালের ৩ অক্টোবর জোট সরকারের ক্যাডাররা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত  চাঁদশী গ্রামটিতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। হামলা ভাংচুর, লুট, অগ্নিসংযোগসহ নারী নির্যাতনের মতো হিংস্র ঘটনা ঘটনায় নরপশুরা। ধর্ষন করে গ্রামের সংখ্যালঘু পরিবারের অনেকে মেয়েকে।  সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে ও আত্মসম্মানের ভয়ে ধর্ষিতারা মামলা করতে পারেনি। এ গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে জোট সন্ত্রাসীদের। তিনি নিজের নির্যাতনের কাহিনি বর্ননা করে বলেন, সন্ত্রাসীরা বাড়িতে হামলা করে তার মা, বোন, ভাইকে গুরুতর আহত করে বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিলো। ক্যাডারদের নির্মম ও বর্বোরেচিত ঘটনা ৭১’র পাক হানাদাদেরও হার মানিয়েছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন। হামলার পরের দিন তিনিসহ তার ছোট ভাই বোরকা পরে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে পাশ্ববর্তী রামশীলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইল্লা গ্রামের নির্যাতিত প্রনব রঞ্জন ওরফে বাবু দত্ত জানান, জোট সরকারের ক্যাডাররা তার বাড়িতে হামলা করে তাকে না পেয়ে তার বৃদ্ধ বাবা মাকে কুপিয়ে জখম ও বাড়িতে লুটপাট চালায়। পরের দিন রান্না করে খাবার মত কোন হাড়ি পাতিল ঘরে রেখে যায়নি সন্ত্রাসীরা। তার বাড়ির মন্দির ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো।

তিনি তার অভিযোগের সমর্থনে সচিত্র ছবি ও ওই সময় প্রকাশিত সংবাদ পত্রের কপি বিচার পাওয়ার আশায় তদন্ত কমিশনের কাছে জমা দিয়েছিলেন কিন্তু আজো তার কোন বিচার পাননি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এভাবেই চারদলীয় জোট ক্যাডারদের হিংস্রতার অসংখ্য অভিযোগ করেন, বিল্লগ্রামের কালিয়া দমন গুহ, সুতার বাড়ি গ্রামের নারায়ন চক্রবর্তী, উত্তর চাঁদশী গ্রামের রিপন বাড়ৈ, গৌরাঙ্গ দাস, হরিপদ বিশ্বাস, মঞ্জু রানী, গেরাকুল গ্রামের হেলাল মিয়া, নলচিড়া গ্রামের অভিজিৎ, আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার গ্রামের কমলা রানী, পতিহার গ্রামের নিতাই রঞ্জন, বাকাল গ্রামের সুধির রালা, রত্নপুর গ্রামের প্রবীর বিশ্বাস ননী, অপূর্ব লাল সরকারসহ অসংখ্য নির্যাতিতরা। তারা সবাই বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন। উল্লে­খ্য, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর পরই জোটের ক্যাডাররা বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) নির্বাচনী এলাকায় হত্যা, ধর্ষন, লুট, হামলা, ভাংচুরসহ ব্যাপক নির্যাতন ও  সহিংসতার মতো হিংস্র ঘটনা ঘটনায়। ওইসময় এ দু’উপজেলার হাজার-হাজার আওয়ামীলীগের নির্যাতিত নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা জীবন রক্ষার্থে পার্শ্ববর্তী কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।