গ্রেফতার আতংকে খুনী রেজাউল বাহিনীর ক্যাডাররা

রেজাউলের হামলার স্বীকারসন্ত্রাসী সফিকুর রহমান রেজাউল সিকদারের নিজ এলাকা বরিশালের গৌরনদী উপজেলার টরকী বন্দরসহ পাশ্ববর্তী এলাকায় সাদাপোষাকে আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বৃদ্ধির পর পরই রেজাউল বাহিনীর চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা গাঁ ঢাকা দিয়েছে। অপরাধ জগতের গৌরনদীর গডফাদার বলেখ্যাত রেজাউল সিকদার গ্রেফতারের পর কয়েকদিন প্রকাশ্যে তার ঘনিষ্ঠ ক্যাডারদের আনাগোনা দেখা গেলেও বর্তমানে তারা গ্রেফতার আতংকে আত্মগোপন করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। সূত্র আরো জানিয়েছেন, সন্ত্রাসী রেজাউলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুন্দরদী গ্রামের আল-মাদানী, একই গ্রামের আলাউদ্দিন দেওয়ানের পুত্র ও একাধিক মামলার আসামি ইমন দেওয়ান, নবীন সরদার, রামনগর গ্রামের কালু ভূঁইয়ার পুত্র সুজন ভূঁইয়াসহ বাহিনীর ১০/১৫ জন ক্যাডাররা গত দু’দিন থেকে আত্মগোপন করেছে।

অপরদিকে গত ৫দিন পর শুক্রবার রাতে বাড়িতে ফিরেছেন খুনী রেজাউল সিকদারের তৃতীয় স্ত্রী সুজিতা। স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চতুর্থ স্ত্রী কামরুন নাহার নাদিয়াকে হত্যা করে লাশ গুমের সময় গত ২৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় খুনী রেজাউল ঢাকার শাহবাগ থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। ওইদিন (২৪ এপ্রিল) রাতে টরকী বন্দরের সিকদার ভিলা তালাবদ্ধ করে রহস্যজনক ভাবে নিখোজ হয় রেজাউলের তৃতীয় স্ত্রী সুজিতা। দীর্ঘ ৫দিন পর গতকাল শনিবার ভোরে তিনি (সুজিতা) বাড়িতে ফিরেছেন। সুজিতা জানান, স্বামী রেজাউলের গ্রেফতারের খবর শুনে ওইদিন রাতেই তিনি ঢাকায় গিয়েছিলেন। এতোদিন ঢাকায় বসবাসের পর গত শুক্রবার রাতে তিনি বাড়িতে ফিরেছেন তবে আর কোন ব্যাপারে মুখ খুলতে চাননি খুনী রেজাউলের তৃতীয় স্ত্রী সুজিতা। টরকী বন্দরের একাধিক ব্যবসায়ীরা জানান, আগের মতো আনন্দ উল্লাস আর হই হুল্লর নেই খুনী রেজাউলের “সিকদার ভিলায়”। বর্তমানে নিরব নিস্তব্ধ এক ভূতুরে বাড়িতে পরিনত হয়েছে সিকদার ভিলাটি। ৫দিন পর রেজাউলের তৃতীয় স্ত্রী সুজিতা বাড়িতে ফিরলেও লক্ষ্য করা যায়নি রেজাউলের কোন ক্যাডার কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের।

আরেক রসু খাঁ : গতকাল শনিবার দুপুরে রেজাউলের সিকদার ভিলার পার্শ্বে সংবাদকর্মীদের দেখে ভয়ে আতংকিত হয়ে দ্বিগবিদিক ছোটাছুটি শুরু করে লম্পট রেজাউলের আরেক লালসার স্বীকার নিপা ঠাকুর (২৮)। হঠাৎ করে তাকে দাঁড়াতে বললে ভয়ে সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলেন, আমি কিছুই জানি না, আমি এই বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করি। টরকী বন্দরের ব্যবসায়ী কে.এম জুয়েলসহ স্থানীয় একাধিক বাসিন্দারা জানান, গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া ইউনিয়নের কান্ডপাশা গ্রামের সন্তোষ ঠাকুর (৪০) দীর্ঘদিন ধরে টরকী বন্দরের আদর্শ মিষ্টান্ন ভান্ডারে দিনমজুরের কাজ করে আসছিলেন। গত ৫ বছর পূর্বে সন্তোষ তার স্ত্রী নিপা ঠাকুরসহ ২ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানকে নিয়ে রেজাউল সিকদারের বাড়ির একটি টিনের ঘরে ভাড়া বাসায় তারা বসবাস করে আসছেন। অভাবের সংসারে নিপা ঠাকুর রেজাউলের বাসায় ঝিয়ের কাজ শুরু করেন। এরইমধ্যে লম্পট রেজাউলের লোলুপ দৃষ্টি পরে দিনমজুর সন্তোষের স্ত্রী নিপার ওপর। একপর্যায়ে কৌশলে লম্পট রেজাউল নিপার সাথে দৈহিক মেলামেশা শুরু করে। গত পহেলা রমজানের দিন রাতে নিপা ও রেজাউলের দৈহিক সম্পর্ক দেখে ফেলে নিপার স্বামী সন্তোষ ঠাকুর। এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় সন্তোষের জীবনে। ওইদিন রাতে ঘুমের ঘোরে পয়োজিং করে মেরে ফেলা হয় সন্তোষ ঠাকুরকে। পরেরদিন ষ্টক করে মারা যাওয়ার খবর এলাকায় রটিয়ে তরিঘরি করে সন্তোষ ঠাকুরের অন্তেষ্টিক্রীয়া সম্পন্ন করা হয়। টরকী বন্দরের আদর্শ মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্তাধীকারি শুভ্র ঘোষ বলেন, সন্তোষ ঠাকুর আমার দোকানের দীর্ঘদিনের কর্মচারী। ঘটনার দিন রাতে সে ভালো মানুষ কাজ শেষে তার ভাড়া বাসায় যায়। পরেরদিন ভোরে শুনি সে ষ্টক করে মারা গেছে। সন্তোষের মৃত্যুর পর গৃহবধূ নিপা ঠাকুরের ভরন পোষনসহ সকল দায়দায়িত্ব নেন লম্পট রেজাউল। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, গৃহবধূ নিপা ঠাকুরকে দিনের পর দিন ভোগ করার জন্যই কৌশলে সন্তোষকে সন্ত্রাসী রেজাউল মেরে ফেলেছে। এ নিয়েও নানা ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। স্থানীয়রা জানান, সন্তোষের মৃত্যুর ব্যাপারে গ্রেফতারকৃত রেজাউল সিকদার ও নিপা ঠাকুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে। অবশ্য নিপা ঠাকুর এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।  

শুক্রবার গৌরনদী ডটকমে "নাদিয়া হত্যা মামলায় পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা" শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর পুলিশের রহস্যজনক ভুমিকা পালনের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বরিশাল জেলা শাখার সভানেত্রী রাবেয়া খাতুন, সম্পাদক নুর জাহান বেগম, সাংগঠনিক সম্পাদক মলিনা মন্ডল, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পুস্প রানী চক্রবর্তী ও লিগ্যাল এইডের জেলা শাখার সম্পাদিকা প্রতিমা সরকার। নেতৃবৃন্দরা আলোচিত কামরুন নাহার নাদিয়া হত্যার বাদি ও হতভাগ্য নাদিয়ার ছোট ভাই সজিব আহম্মেদ শাহ্রিয়ার সুজনের জীবনের নিরাপত্তাসহ মুল ঘাতকের ফাঁসির দাবি করেছেন। একইসাথে মামলার অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারসহ পুলিশ প্রসাশনকে সঠিক ভাবে মামলার অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নেতৃবৃন্দরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

গতকাল শনিবার বিকেলে গৌরনদী প্রেসক্লাবে হাজির হয়ে টরকী বন্দরের ব্যবসায়ী ও পরাজিত কাউন্সিলর মোঃ সলেমান হোসেন বলেন, প্রথমার্থে রেজাউল সিকদারের সাথে আমি চলাফেরা করলেও যখন রেজাউলের অপরাধ জগতের চিত্র আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়, তখন থেকে আমি রেজাউলের সাথে চলাফেরা বন্ধ করে দিয়েছি। তিনি আরো বলেন, আলোচিত কামরুন নাহার নাদিয়া হত্যার সাথে জড়িত ঘাতকের ফাঁসি আমিও চাই।

চাঁদাবাজি বন্ধে মাইকিং : ঈদ ও দূর্গা পূজা আসলেই রেজাউল ও তার বাহিনীর ক্যাডাররা টরকী বন্দরে ব্যাপক চাঁদাবাজি করে আসছিলো। ওইসব চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি হয়ে পরেছিলো বন্দরের ব্যবসায়ীরা। গৌরনদী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে মোঃ নুরুল ইসলাম-পিপিএম ২০০৯ সালের শেষার্ধ্যে যোগদান করার পর টরকী বন্দরের ব্যবসায়ীরা চাঁদা বন্ধে ওসির সহযোগীতা কামনা করেন। ওইবছর ওসির পরামর্শে টরকী বন্দর বণিক সমিতির পক্ষ থেকে চাঁদাবাজি প্রতিরোধে বন্দরে ব্যাপক মাইকিং করা হয়েছিলো।

পিতৃহারা শিশু মীম আজ পঙ্গু : ২০০৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর খুনী সিকদার রেজাউলের “সিকদার ভিলার” সন্নিকটে কুড়িয়ে পাওয়া বোমার বিস্ফোরনে পঙ্গুত্বের খাতায় নাম লেখাতে হয়েছে পিতৃহারা অবুঝ শিশু মীমের। সূত্রমতে, বার্থী গ্রামের বিধবা রোকেয়া বেগম টরকী বন্দরের একটি মিস্রি কারখানায় দিনমজুরের কাজ করে আসছিলো। প্রতিদিনের ন্যায় রোকেয়া তার নাতনী মীমকে নিয়ে ওইদিনও দিনমজুরের কাজ করতে এসেছিলেন। দুপুর একটার দিকে রেজাউলের বাসার কাছে খেলার ছলে মীম টেপমোড়ানো একটি কৌটা (বোমা) কুড়িয়ে পায়। হাতের মধ্যেই বোমাটি বিস্ফোরিত হয়ে মীমের ডান হাতের কব্জি উড়ে যায়। মীমের পিতা দিনমজুর রবিউল সরদারের মৃত্যুর পর তার মা ও নানীর সাথে মীম টরকীর চর গ্রামের মোসলেম সরদারের ভাড়াটিয়া বাড়িতে বসবাস করে আসছিলো। বন্দরের ব্যবসায়ীরা জানান, এ ঘটনার ১০ দিন পূর্বে ঘটনাস্থলের সন্নিকটের রেজাউল সিকদারের বাড়ির দেয়ালে রাতের আধাঁরে দশটি বোমার বিস্ফোরন ঘটিয়ে এলাকায় আতংক সৃষ্টি করা হয়েছিলো। এ ঘটনার কিছুদিন পরেই রেজাউল ও তার বাহিনীর ক্যাডাররা হত্যার উদ্দেশ্যে টরকী বন্দর বণিক সমিতির সাবেক সাধারন সম্পাদক হারুন হাওলাদারের ওপর বোমা হামলা করেছিলো।