জীবন যেখানে মূল্যহীন

গাজার পরাধীনতার ও বর্তমান অবস্থা :

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েলী যুদ্ধে ইসরায়েল এ ভূখণ্ড দখল করে নেয়। ফিলিস্তিনিদের অবিরাম প্রতিরোধ আন্দোলনে মুখে ইসরাইলিরা ২০০৫ সালে গাজা ছেড়ে গেলেও তারা গাজায় ঢোকার ও বেরোনোর পথগুলো বন্ধ রেখেছে। দক্ষিণে মিসরের সিনাইয়ের দিকে একটা প্রবেশপথ আছে কিন্তু আন্তজার্তিক চাপের ফলে মিসর সে পথটিও বন্ধ রাখছে । গাজার সামান্য কৃষি উৎপাদন রফতানি হতে পারছে না এই অবরোধের কারণে। অন্য দিকে খাদ্য, ওষুধপত্র, জ্বালানি ইত্যাদি সব কিছুরই আমদানি নির্ভর করে ইসরাইলের মর্জির ওপর। সাড়ে ১০ লাখ অধিবাসী সম্পূর্ণরূপে জাতিসঙ্ঘের খাদ্যসাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।

গ্লাডিয়েটরের মতো বন্দী এই মানুষগুলোর ওপরই ইসরাইলি ইচ্ছেমত জঙ্গিবিমান ও হেলিকপ্টার গানশিপগুলো আকাশ থেকে বোমা ফেলছে, ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে, নৌবাহিনী সমুদ্র থেকে বোমা নিক্ষেপ করছে, গোটা এলাকা ঘিরে রাখা ট্যাঙ্কগুলো কামানের গোলা ছুড়ছে, নিষিদ্ধ ফসফরাস বোমা ফেলা হচ্ছে গাজার ওপর।

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনী শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবেদনে গাজার অধিবাসী বিশেষ করে নারী, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তিদের দুর্দশার চিত্র ফুটে ওঠেছে । জাতিসংঘের ফিলিস্তিনী শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছেন।

জিওনিস্ট মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল রাষ্ট্র জামার্নদের ইহুদী হলোকাস্টকে অজুহাত করে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পর এখন তারাই সেখানে নতুন আরব হলোকাস্টের জন্ম দিচ্ছে। কি করে ইসরায়েলীরা মাত্র ছয় দশক আগে ঘটে যাওয়া নাজী হলোকাস্ট ভুলে গেল ? ভাবতে অবাক লাগে । দুর্বল সবল হলে সেও অত্যাচারী হয়ে যায় ।

গাজা বিপর্যয়ের জন্য একমাত্র ইহুদিবাদী ইসরাইলই দায়ী নয় ; এর পেছনে বিভিন্ন দেশের সরকার সার্বিক সমর্থন যোগাচ্ছে এবং সাহায্য-সহযোগিতা দিচ্ছে। তবে নিঃসন্দেহে দখলদার ইসরাইলের সবচেয়ে বড় মদদদাতা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ইহুদিবাদী নেতৃবৃন্দের উপর চাপ বৃদ্ধির মাধ্যমে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধান করতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ তো নেয়ই নি বরং অন্যায়-অপরাধ অব্যাহত রাখতে দখলদারদের সার্বিক সহযোগিতা দিচ্ছে। মার্কিন সরকার সব সময় নিজেকে মানবাধিকারের রক্ষক বলে মনে করে, কিন্তু গাজায় সংঘটিত অন্যায়-অপরাধ ও প্রায় আড়াই লক্ষ নিরপরাধ ফিলিস্তিনীর মৃত্যুকে মানবাধিকারের লংঘন বলে মনে করে না।

আরো অবাক করা ব্যাপার হলো : সভ্য উদার ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার আমেরিকান-ইউরোপীয়ান সভ্যতা ইসরায়েলের মত ধর্মীয় জাতিভিত্তিক দেশ প্রতিষ্ঠা করেছে । এটা কল্পনা/চিন্তা করতে কষ্ট হয় চরম ধর্ম নিরপেক্ষতার দাবিদার এই জাতিগুলো নির্লজ্জের মত বাইবেলের পুরাতন নিয়মে বণির্ত ইসরায়েল জাতির আবাসস্থল তৈরীতে এবং বর্তমানে রক্ষায় পূর্ণ উদ্যোমে কাজ করে যায় ।

গাজার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও অনেকাংশে দায়ী। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এ পর্যন্ত চলমান গাজা বিপর্যয় ঠেকাতে কোন ব্যবস্থা নেয়নি । জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদের নির্লিপ্তির কারণে ইসরাইল তার অন্যায়-অপরাধ অব্যাহত রাখার সাহস পাচ্ছে এমনকি নিরপরাধ ফিলিস্তিনীদের প্রতি যেসব দেশ সমবেদনা জানায়,তাদের বিরুদ্ধেও হুমকির সুরে কথা বলছে । জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ জেনেভায় বৈঠক শেষে গাজার উপর ইসরাইলী অবরোধের নিন্দা জানিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে।

বিশ্বের বৃহৎ শক্তিসমূহ (চীন-জাপান-রাশিয়া-ফ্রান্স-ইউরোপ-ভারত-জার্মানী-স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো) গাজায় ইসরায়েলের চরম মানবতা লঙ্ঘণের পরও শুধুমাত্র দু:খ প্রকাশ এবং কিছু মেডিকেল সাহায্য এবং রিলিফ দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করছে । কিন্তু স্থায়ী সমাধানকল্পে কেউ কোন কাজ করছে না ।

গাজায় ইসরাইলের নীরব গণহত্যা বন্ধে মুসলিম বা, আরব দেশগুলোর ব্যাপক দায়িত্ব থাকলেও এসব দেশ তা পালনে সচেষ্ট নয়। মুসলিম ও আরব দেশগুলোর মধ্যে অনৈক্য এবং অসহায় ফিলিস্তিনীদের অধিকারের ব্যাপারে অসচেতনতা, ইসরাইলকে উদ্ধত করে তুলেছে। এ অবস্থায় গাজার অধিবাসীদেরকে চরম দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত করতে ও.আই.সি. কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে ।

গাজা বা, ফিলিস্তিনী সমস্যা প্রকট হবার আরো একটি বড় কারণ হলো : ফিলিস্তিনীদের নিজেদের মধ্যে থাকা অনৈক্য । ফিলিস্তিনীদের মধ্যে দ্রুজ নামের আধা-মুসলিম একটি সম্প্রদায় আছে । যারা ইসরায়েলকে তাদের পরম বন্ধু ভাবে । তাছাড়া শিয়া-সুন্নী বিরোধও ফিলিস্তিনীদের মাঝে প্রকট । এর স্পষ্ট প্রমাণ হামাসের মূল সমর্থক হলো শিয়া আর ফাতাহের মূল সমর্থক হলো সুন্নী । হামাস-ফাতাহ বিরোধ তো আছেই ; আরো আছে মুক্তিকামী ছোট বড় আরো অনেক দল-উপদল । একতা না থাকলে কোন কিছুই সম্ভব না । ফিলিস্তিনীরা এর এক বড় উদাহরণ ।

গাজা ও সমগ্র ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে সমগ্র মানব সমাজ একত্রে যতদিন এগিয়ে আসবে না ততদিন এ সমস্যার কোন সমাধান হবে না ।

আরো কিছু ছবি :

Source : http://www.nagorikblog.com/user/150