আমিনীকে ঘিরে রহস্য বাড়ছেই

মুফতি ফজলুল হক আমিনীসে সঙ্গে কট্টরপন্থি ইসলামী রাজনীতির একজন পুরোধাও। বিগত তিন দশক ধরে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইসলামী জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। তবে আগাগোড়াই আলোচিত-সমালোচিত তার রাজনৈতিক জীবন। রাজনৈতিক মহলে প্রায়ই আলোচনার মধ্যে থাকেন তিনি। তাকে নিয়ে রয়েছে নানা মুখরোচক আলোচনাও। রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে- তিনি কোন রাজনৈতিক শক্তির পক্ষেই একনিষ্ঠ নন। হাওয়া বুঝেই তুলে ধরেন রাজনীতির পাল। বর্তমানে তিনি বিভোর হয়েছেন তৃতীয় শক্তির শীর্ষ নেতা হওয়ার স্বপ্নে। সরকারের ইস্যুভিত্তিক পদক্ষেপ আর বিরোধী দলের সাংগঠনিক বিপর্যয়ের মধ্য থেকে তিনি প্রতিষ্ঠা পেতে চান নতুন শক্তির প্রধান হিসেবে। তবে নারীনীতি বিষয়ে এবারে তিনি হঠাৎ করেই এলেন লাইম লাইটে। অতীতে যা দেখা যায়নি, এবারে তেমন কিছুই চোখে পড়লো। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোড়া থেকেই মুফতি আমিনীকে নিয়ে মন্তব্য করেন। সে কারণেই দ্রুত তর্ক-বিতর্কের শীর্ষবিন্দুতে চলে আসেন তিনি। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন রাজপথের আন্দোলন ছিল স্তিমিত। পর্যবেক্ষকরা কৌতূহলভরে লক্ষ্য করেন, রাজপথে নেমেছেন এক নতুন সিপাহসালার। তিনি একটি হরতালের ডাক দেবেন, সে কথা গণমাধ্যমের একটি অংশ এমনভাবে প্রচার করলো যাতে মনে হলো তিনি রাতারাতি বনে গেলেন এক ‘উদীয়মান বিরোধীদলীয় নেতা।’ নারীনীতি নিয়ে নারীদের বা সচেতন ইসলামী চিন্তাবিদরা খুব বেশি সতর্ক হওয়ার কারণও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কারণ একথা সবারই জানা যে, নারীনীতি কোন আইন নয়। বাংলাদেশ এমন এক দেশ যেখানে আইনই থাকে অচল, সেখানে নীতি অনেক বেশি ঠুনকো। নীতি দিয়ে কোন আদালত চলে না। সে কারণেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা সন্দিগ্ধ হলেন। তারা বিবেচনায় নিলেন প্রেক্ষাপট।
ড. ইউনূসকে বিরক্ত করার ঘটনায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে বহির্বিশ্বে। কারণ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের একটা উত্থান পশ্চিমা বিশ্বে কখনও কখনও নানা প্রশ্ন, নানা জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছে। সেখানে লাখো লাখো নারীর প্রিয় প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকে আঘাত এসেছে। এরকম সময়ে বিরোধী দলও দাঁড়িয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের পাশে। এ সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ। ড. ইউনূস ইস্যু বড় বেশি চোখে লাগছিল। কাকতালীয়ভাবে হোক বা না হোক, আমিনী হলেন আন্দোলনের নতুন অবতার। তার ‘হুমকি-ধামকি’ এবং রাজপথে তা মোকাবিলা করার পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেখা গেল এক নতুন দৃশ্যপট। নারী ক্ষমতায়নে মরিয়া আওয়ামী লীগ। সাহসী, অকুতোভয়। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ছুড়ে দিয়েছেন চ্যালেঞ্জ। সুতরাং অনেকে নীরবে দুয়ে দুয়ে চার যোগ করলেন। আমিনী সাহেবের হঠাৎ হলোটা কি? তিনি ও তার নারীনীতিবিরোধী আন্দোলন পাত্তা পেল কেন? নারীদের প্রকৃত কিছু না দিয়েই বাজার মাৎ হলো। দুটি বাজার। অভ্যন্তরীণ বাজার এবং পশ্চিমা বাজার। পশ্চিমা বাজার দেখলো, বাংলাদেশের সেক্যুলার সরকারটি কট্টর মৌলবাদীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে।

সরকারদলীয় কয়েকজন নেতা স্বীকার করেন যে, মুফতি আমিনীর সামপ্রতিক আন্দোলনে কৌশলগতভাবে সফল সরকার। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে সরাসরি যেসব কৌশল প্রয়োগ সরকারের জন্য কঠিন হতো তাই সহজ করে দিচ্ছে নারীনীতি বিরোধী সামপ্রতিক আন্দোলন। চারদলীয় জোটের শরিক হিসেবে মুফতি আমিনীর এ আন্দোলনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে লাভবান হচ্ছে সরকারই। বিশেষ করে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির কড়া হরতালের কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিরোধী দলের সাংগঠনিক শক্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি পরিস্থিতির বিবেচনায় বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াই দলের নির্বাহী কমিটির সভায় নেতাদের কড়া সমালোচনা করেছেন। উপদেশ দিয়েছেন মাওলানার (মুফতি আমিনী) মতো আন্দোলন করার। এতে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের আত্মবিশ্বাসেও চিড় ধরেছে। এছাড়া নারীনীতি নিয়ে সামপ্রতিক আন্দোলনের কারণে বিরোধী দলের ইস্যুভিত্তিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচিগুলো রীতিমতো চাপা পড়ে গেছে। বিএনপির আন্দোলনে প্রভাব সৃষ্টি ও আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরির কৌশল প্রায় সফল। বিশেষ করে নারীনীতি ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানকে বিভ্রান্তিকর হিসেবে প্রমাণ করা গেছে। মহাজোটের নেতারা আরও জানান, মুফতি আমিনীর নেতৃত্বে সামপ্রতিক আন্দোলনের মাধ্যমে কৌশলগতভাবে সবচেয়ে বেশি কোণঠাসা করা গেছে জামায়াতকে। ইসলামী রাজনৈতিক দল হলেও ইসলামী আইন সংক্রান্ত ইস্যুতে কথা বলতে পারেনি তারা। বিষয়টি তাদের জনপ্রিয়তায় কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছে। তবে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে জামায়াতের বিকল্প ইসলামী শক্তি প্রতিষ্ঠায় অনেকটাই সফল হয়েছে সরকার। আগের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি চাঙ্গা জামায়াতবিরোধী অন্য ইসলামী দলগুলো। মহাজোটের নেতারা আরও জানান, ইতিমধ্যে বিএনপি-জামায়াতের বাইরে তৃতীয় একটি শক্তি হিসেবে মুফতি আমিনীর নেতৃত্বাধীন অংশকে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বহির্বিশ্বে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে বিএনপি-জামায়াতের গুরুত্ব অনেকটাই কমেছে। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের কাছে বিএনপি-জামায়াতকে আরও একবার উগ্র ইসলামী শক্তির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে প্রমাণ করা গেছে।

এদিকে বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের নেতাদেরও মুফতি আমিনীর ব্যাপারে সতর্ক মনোভাবের কথা জানিয়েছেন। তাদের মতে, আমিনী এখন দেশের তৃতীয় শক্তির শীর্ষ নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এ জন্য জোটের রাজনীতি করেও নারীনীতি ইস্যুতে একটি জটিল পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিএনপির বেশ কয়েক জন নেতা জানান, রাজনীতিতে অনেক মোড়-বাঁকের সৃষ্টি হয়। নারীনীতি নিয়ে সামপ্রতিক আন্দোলনও সে ধরনের একটি মোড়। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে এ মোড় চারদলীয় জোটের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। এ আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে মুফতি আমিনী অদৃশ্য সুতোর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছেন। সরকার ও দেশী-বিদেশী কিছু শক্তি তাকে কৌশলের ক্রীড়নক বানিয়েছে। ফলে যেখানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে যাচ্ছে সেখানে আমিনী হঠাৎ করেই রাজপথ কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। বিএনপি নেতারা সরকারের সমালোচনা করে কোন কথা বলার আগেই সারাদেশে মামলার বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু আমিনী একের পর এক ‘কড়া কড়া’ বক্তব্য ও হুমকি দিয়েও দিব্যি আন্দোলন জমিয়ে তুলছেন। বিরোধী দল যেখানে কোন কর্মসূচির পক্ষে লিফলেট পর্যন্ত বিলি করতে পারে না, সেখানে আমিনী হরতালের পক্ষে সারাদেশ সফর করেছেন। মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম কয়েক দিন তিনি হরতালের পক্ষে- সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেছেন। ২রা এপ্রিল হরতালের পক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কাফনের কাপড় পরে মিছিল করিয়েছেন। কিন্তু বিএনপির মতো বাধার মুখে পড়তে হয়নি।

হাসিনা মুক্ত বাংলাদেশ!
২১শে মার্চ ইসলামী মোর্চার আলোচনা সভায় মুফতি আমিনী সরকারের প্রতি হুমকি দিয়ে বলেছেন, দেশ শেখ হাসিনামুক্ত করা হবে। ১লা এপ্রিল হরতালের পক্ষে মিছিল করতে গিয়ে বলেন, কোরআনের বাইরে গেলে সরকার তছনছ হবে। ৩রা এপ্রিল বলেন, হরতালে বাধা দিলে তা লাগাতার হবে। হরতালের পর বলেন, সফল হরতাল সরকারের জন্য ওয়ার্নিং। ৬ই এপ্রিল বলেন, আন্দোলনকারীদের নির্যাতন করে কোরআন অবমাননা করেছে সরকার। মাদ্রাসা শিক্ষিতরা আধুনিক শিক্ষিতদের চেয়েও ভাল রাষ্ট্র চালাতে পারে। এ জন্যই সরকার মাদরাসাকে টার্গেট করেছে। ৮ই এপ্রিল যশোরে বলেন, আওয়ামী লীগ দেশে দ্বীন-ইন-এলাহী চালু করতে চাইছে। ১৩ই এপ্রিল বলেন, আমার ছেলেসহ আটক সবাইকে মুক্তি না দিলে আবারও হরতাল। ২০শে এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীকে গজব দিয়ে বলেন, শেখ হাসিনা আমার ছেলেকে গুম করেছে, আল্লাহ যেন তার ছেলেকে গুম করেন। এখনও হুমকি দিচ্ছেন ২৭শে মের সমাবেশে বাধা দিলে ২৯শে মে হরতাল দেয়া হবে। তবে ১৬ই এপ্রিল সমাবেশে আমিনীর দেয়া বক্তব্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সেদিন তিনি বলেন, ‘সরকারের কর্মকাণ্ড জঙ্গিবাদ উৎসাহিত করছে। এদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপিই রাজনীতির সবকিছু নয়।’ রাজনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে- এ বক্তব্যের মাধ্যমে কি আমিনীকে অদৃশ্য সে সুতোকে দৃশ্যমান করতে চেয়েছেন? এছাড়া ২১শে মার্চ রাজধানীর ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশনে ইসলামী ছাত্র মোর্চা আয়োজিত এক আলোচনা সভায় দেয়া মুফতি আমিনীর দেয়া- ‘শেখ হাসিনামুক্ত হবে দেশ’ বক্তব্যের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টার অভিযোগে সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান বাদী হয়ে ৩১শে মার্চ মুফতি ফজলুল হক আমিনীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা মামলা করেন। ওইদিন সকালে আমিনীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলেও দুই ঘণ্টা পর সে আদেশ পরিবর্তন করে নতুন করে শুনানির দিন ধার্য করা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের প্রভাব ছাড়া বিচার বিভাগ হঠাৎ এ ধরনের উদ্যোগ নেয়ার কোন কারণ নেই।

 

তিনি বুজুর্গ
চারদলীয় জোট নেতারা এ ঘটনা তুলে বলছেন, দেখুন, দেখুন। তারা আরও বলেন, নারীনীতির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা আগাগোড়াই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। এমনকি সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়- আমিনীর ব্যাপারে তাদের বক্তব্যগুলোও স্ববিরোধী। প্রধানমন্ত্রী কখনো বলছেন, নারীনীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জঙ্গিবাদকে রুখতে হবে। আবার বলেছেন, এ সরকার কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন করছে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী আমিনীকে ‘বুজুর্গ’ আখ্যায়িত করে ২রা এপ্রিল কক্সবাজারে একটি সমাবেশে বলেন, মুফতি আমিনী একজন বুজুর্গ মানুষ হয়েও নারীনীতির ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী নারীনীতির পক্ষে সরব থাকলেও ৮ই এপ্রিল ময়মনসিংহের একটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আওয়ামী লীগাররাও নারীনীতি সমর্থন করেন না। ১২ই এপ্রিল কুমিল্লায় মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ বলেন, কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন দেশের মানুষে মেনে নেবে না।

যেভাবে নৈতিক সমর্থন
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, নারীনীতির বিরুদ্ধে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ডাকা হরতালে প্রথমে সমর্থন দেননি তারা। এ সময় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সৌদি আরব সফরে ছিলেন। তবে দলের গুরুত্বর্পূণ একটি অংশের প্ররোচনা ও জোটের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন তোলার মাধ্যমে সৌদিআরব থেকে দলের চেয়ারপারসনের সমর্থন আদায় করেন আমিনী। পরে বিএনপি সে হরতালে শুধুই নৈতিক সমর্থন দেয়। আর এতেই বহির্বিশ্বের কাছে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি দেশবাসীর কাছে এ ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান দাঁড়ায় বিভ্রান্তিকর। এছাড়া বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা করতেই হরতালের পর আমিনীর বদলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অভিযোগ তুলেন বিএনপির বিরুদ্ধে। বলেন, আমিনীকে হাতিয়ার বানিয়ে বিএনপি-জামায়াতই হরতাল করেছে।
চারদলীয় জোটের শরিক দল জামায়াত ইসলামীর একাধিক নেতা জানান, উদার মুসলমানের এ দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে ইসলামী সমাজ কায়েম সম্ভব নয়। প্রচলিত রাজনীতির মধ্যে থেকেই পরিবর্তন সমাজ পরিবর্তন করতে হবে। তবে আমিনীরসহ কিছু রাজনীতিকের মনোভাব চরমপন্থার দিকেই। যেহেতু তারাও ধর্মীয়ভিত্তিতেই রাজনীতি করে তাই তাদের পদক্ষেপের রেশ বহন করতে হয় জামায়াতকে। নারীনীতি নিয়ে জামায়াত নীরবতা অবলম্বন করেছে কৌশলগত কারণে। তবে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আন্দোলনে একটা পর্যায়ে গিয়ে নানামুখী সঙ্কট সৃষ্টি করছে জামায়াতের সামনে। সরকার জামায়াতকে কোণঠাসা করতে নারীনীতি বিরোধী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে জামায়াত বিরোধী ইসলামী দলগুলোকে চাঙা করেছে। কোন কোন এলাকায় তাদের কার্যক্রমকেও উৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি কোরআন হাতে মিছিল করার মাধ্যমে রাজনীতির ময়দানে সরাসরি কোরআনকে টেনে আনাও সমর্থন করতে পারছেন না তারা। তাদের মতে, বাংলাদেশে এখনও এমন পরিস্থিতি আসেনি যে কোরআন হাতে মিছিল করতে হবে। তেমন পরিস্থিতি এলে জামায়াত অনেক আগেই তা করে দেখাতো।

আমিনীর পুত্রের অপহরণ ও মুক্তি
আমিনীর ছেলের অপহরণ ও মুক্তির নাটকীয় ঘটনা নিয়েও রাজনীতিক মহলে বেশ গুঞ্জন চলছে। ১০ই এপ্রিল ছেলে মাওলানা আবুল হাসানাতকে অপহরণের অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, ডিবি পুলিশ তার ছেলেকে ধোলাই খাল এলাকা থেকে অপহরণ করেছে। এরপর ছেলের মোবাইল ফোন নম্বর থেকে ফোন করে তাকে হুমকি দেয়ারও অভিযোগ করেন তিনি। তবে এ ব্যাপারে দায়িত্ব স্বীকার করেনি সরকার। উল্টো বিষয়টিকে নাটক হিসেবে উল্লেখ করে তা খতিয়ে দেখার ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এমন পাল্টা-পাল্টির মধ্যেই ১২দিন পর ২২শে এপ্রিল নাটকীয়ভাবে মুক্তি পান আবুল হাসানাত। ওইদিন সকালে তাকে হাত বেঁধে ঢাকা আলিয়া মাদরাসা মাঠের কোণায় ফেলে যাওয়ার কথাই সংবাদ সম্মেলনে জানান মুফতি আমিনী। তবে এ নিয়ে বাপ-ছেলের বক্তব্যে অসঙ্গতি দেখা গেছে। হাসানাত বলেছেন, সব সময় তার চোখ বেঁধে রাখা হতো আর আমিনী বলেছেন, পুরো সময় কোরআন পড়ে সময় কাটিয়েছেন হাসানাত। আবার হাসানাত বলেছেন, খাবার সময় তার হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হতো, কিন্তু আমিনী বলেছেন, ছেলে রোজা রেখে সময় কাটিয়েছেন। এছাড়া হাসানাতকে হাত বাঁধা অবস্থায় উদ্ধারের সময় এবং প্রক্রিয়া নিয়েও আমিনী এবং লালবাগ থানা পুলিশ পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। অথচ কারণ খতিয়ে দেখার ঘোষণা দিয়েও পুরো বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করছে সরকার। আর এতেই জন্ম দিচ্ছে নানা প্রশ্নের। ফলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা তুঙ্গে এখন আমিনী ও নারীনীতি। সবার জিজ্ঞাসা এখন বিএনপি-জামায়াত ঠেকাতে  কে বা কারা আমিনীকেই হিরো বানাচ্ছেন। আমিনী কি বেরিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট থেকে? নাকি হাত-পা বাঁধা পুতুল হিসেবে কেবল নির্দিষ্ট সময় মঞ্চ কাঁপাবেন আমিনী! এ খেলায় কে জিতবে- সরকার নাকি বিরোধী দল? আমিনী কি হিরো হচ্ছেন, নাকি জিরো? ফলে রাজনীতির এ খেলা শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেয় সেদিকেই এখন রাজনৈতিক মহলের নজর।
জামায়াতের ৬ শীর্ষ নেতা কারাগারে। কিন্তু রাজপথে জামায়াত আউট। সেখানে রাজপথের নতুন সিপাহসালার সক্রিয়। তার ইস্যুটিও রাজনৈতিক নয়। আবার উল্টো সরকারি দল বলছে, বিএনপিই মাঠে নামিয়েছে আমিনীকে। এ কথার অবশ্য দৃশ্যমান ভিত্তি অনেকেই খুঁজে পাবেন। আর তাতে লাভের গুড় পিঁপড়ার খাওয়া হবে না।

বিএনপি’র অনেকেই সংশয়ে
আমিনীর আন্দোলনের পিছনে সরকারের ইন্ধনের আরও একটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে করে বিএনপি। তাদের মতে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এই দেশটিতে ইসলামী শক্তির অস্বাভাবিক উত্থানের চিত্রটি তুলে ধরতে চায় সরকার। যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গন এই দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির বিষয়ে চিন্তাধারা পরিবর্তনের সুযোগ পায়। সরকারবিরোধী আন্দোলনে ইতিপূর্বে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের আচরণের মিল খুঁজছেন অনেকেই। ৪ঠা এপ্রিলের হরতালে রমনা থানার ওসি শিবলী নোমানের ওপর এক পিকেটারের দুঃসাহসিক আক্রমণের দৃশ্য সবাইকে বিস্মিত করেছে। কিন্তু সেই ঘটনা পুলিশ নীরবে হজম করেছে। অথচ বিএনপি’র ডাকা হরতালের আগে রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর কিংবা পোড়ানোর জন্য বিএনপি-জামায়াতের অনেক শীর্ষ নেতাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। আমিনী-পুত্র মাওলানা আবুল হাসানাতের ১২ দিন নিখোঁজ থাকার বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে বিএনপি। আমিনী নিজে ছেলেকে লুকিয়ে রেখেছেন- সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা একথা বলেছেন একাধিকবার। তবে কোথায় কিভাবে তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে তা উদঘাটন করেনি সরকার। ১২ দিন পর হাসানাত কোথা থেকে এলেন- সরকার তা তদন্ত করে দেখছে বলেও ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১২ দিন পরও সেই ঘোষণা আলোর মুখ দেখেনি। আমিনী-পুত্র হাসানাতের সঙ্গে অপহরণকারীদের আচরণ এবং শর্তসাপেক্ষে তাকে মুক্তি দেয়ার ঘটনাটি বেশ রহস্যময়- যা সরকারের সঙ্গে মুফতি আমিনীর যোগসূত্রের গুঞ্জনকে ভারি করে তুলেছে বলে অনেকের ধারণা। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী এক সদস্য বলেন, ‘সরকার নিজের প্রয়োজনে হাসানাতকে লুকিয়ে রেখেছে। প্রয়োজন শেষে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। সার্বিক ঘটনাপ্রবাহ সেটাই প্রমাণ করে।’ সরকার প্রধানকে হুমকি দেয়ার অভিযোগে ইতিপূর্বে বিএনপি-জামায়াতের অনেক নেতার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মামলা হয়েছে। ‘এক মাসের মধ্যে সরকারের পতন হবে’- আমিনীর এমন হুংকারেও আওয়ামী লীগদলীয় নেতাকর্মীরা নীরব থাকার কারণ ব্যাখ্যা করতে চাইছেন অনেকেই। তাদের মতে, বিএনপি-জামায়াতের কোন নেতা এমন কথা বললে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা হতো, গ্রেপ্তার করে তাকে হয়তো রিমান্ডেও নেয়া হতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের নমনীয়তা প্রশ্নের জন্ম দেয়। এছাড়া ৪ঠা এপ্রিলের হরতালকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক মাওলানা আহমদ শফিসহ বেশ ক’জনের নামে মামলা হয়। এই ঘটনার পর একজন অতিরিক্ত আইজিপি চট্টগ্রাম যান এবং ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এরপর মাওলানা আহমদ শফির নেতৃত্বাধীন সর্বদলীয় ইসলামী ঐক্যপরিষদের ডাকা মহাসমাবেশ বানচাল হয়ে যায়। রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে ২৭শে এপ্রিল এই মহাসমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। সেদিন মুক্তাঙ্গনে প্রথম ১৪৪ ধারা জারি হয়। সেই ১৪৪ ধারা জারির ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। এদিকে নারীনীতি, শিক্ষানীতি, ফতোয়াবিরোধী রায়সহ সব ইস্যুতে একক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে এখনও সক্রিয় রয়েছেন মুফতি আমিনী। আগামী ২৭শে মে ঢাকায় মহাসমাবেশের কর্মসূচি আছে তার। এই কর্মসূচিতে বাধা দিলে ২৯শে মে সারা দেশে হরতাল পালনের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। মুফতি আমিনীর এসব ধারাবাহিক কর্মসূচির ফলাফল নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বামপন্থি কিছু রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের একটি অংশ ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে এর বিরুদ্ধে কথাও বলেছে। তবে আমিনীর রাজনৈতিক মিত্ররা নীরবে পর্যবেক্ষণ করছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য এই সন্দেহের বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রাতের অন্ধকারে অনেক কিছুই হয়। তবে দিনের আলোয় এক সময় তা পরিষ্কার হয়ে যায়। আমিনীর আন্দোলনের শেষ ফল বলে দেবে তিনি কেন, কি করেছেন। তবে আন্দোলনের ইস্যুটি ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিধায় আমরা আপাতত সেটা পর্যবেক্ষণ করছি। তিনি বলেন, বহির্বিশ্বকে ইসলামী শক্তির উত্থান দেখিয়ে সরকার যে কোন ধরনের ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, আমি যাকে বেয়াদবি শিক্ষা দিলাম সে যখন অন্যকে পাবে না তখন আমার সঙ্গে সেই আচরণটি করবে। তবে অনুমানের ভিত্তিতে এখনি শরিক দলটিকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন বিএনপি’র প্রথম সারির এই নেতা। মুফতি আমিনীকে নিয়ে এসব গুঞ্জন সরাসরি নাকচ করেন তার দলের এক শীর্ষ নেতা। তিনি বলেন, আন্দোলনকে ব্যাহত কিংবা জোটের মধ্যে বিভ্রান্তি বা দূরত্ব সৃষ্টির জন্য মহল বিশেষ এসব কথা প্রচার করতে পারে। তবে আমিনীর চরিত্র সম্পর্কে যাদের জানা আছে তারা কখনও এতে বিভ্রান্ত হবেন না।

Source: ManabZamin