নো চিন্তা ডু ফুর্তি

কিন্তু সে বর্তমানে নিখোঁজ। করিত্কর্মা এই লোক ব্যবসায়ী। নাম জাহিদ হোসেন খলিফা। ব্যবসাটা ব্যতিক্রমী। লোকজনকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে-ফুসলিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া। মানুষকে ঠকানোর ব্যাপারে তার প্রতিভা দুর্দান্ত। বিশ্বস্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। আইপিএলে মহা ছক্কা হাঁকানো তা-বড় তা-বড় ব্যাটসম্যানও লজ্জা পাবে, এমনই প্রতিভা। কত টাকা সে বাগিয়ে পগার পার হয়েছে? খুব বেশি না। কোটি দুয়েক টাকা মাত্র। কীর্তিমান এই ব্যবসায়ীর নাম জাহিদ হোসেন খলিফা।

‘তালেবর’ শব্দের অর্থ হলো সৌভাগ্যবান, প্রতিপত্তিশালী, মান্যগণ্য। খলিফা সৌভাগ্যবান তো বটেই। তার আস্তানা ছিল বগুড়া শহরের গালাপট্টিতে। আমদানি-রফতানি ব্যবসার নামে সঞ্চয় সমিতি গঠন করেছিল। সদস্য সংগ্রহে তার টার্গেট ছিল ছোট ব্যবসায়ী, অল্প আয়ের লোকজন। ফুটপাতের দোকানি, চটপটি বিক্রেতা, পানওয়ালা, মুচি, ভিখিরি, হোটেল শ্রমিক, হকার—সবাইকে সে এক পতাকাতলে সমবেত করতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। রোজ তারা যে যার সাধ্যমত জমা রাখতেন খলিফার কাছে। ২০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। গত এক বছরে আদায় হয় এক কোটি টাকা। সমিতির নামে ভাড়া দেয়া দোকান দেখিয়ে ব্যাংক, এনজিও থেকে ৫০ লাখ টাকা লোন। সমিতিতে টাকা রাখলে বেশি লাভের লোভ দেখিয়ে জোগাড় করা হয় আরও ৫০ লাখ টাকা। একুনে দুই কোটি টাকা। তারপর? গানের ভাষায় বলা চলে, তার আর পর নেই নেই কোনো ঠিকানা…। টাকা বগলদাবা করে খলিফা সাব হাওয়া। কড়কড়ে টাকা নিয়ে আনন্দেই হয়তো হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে সে। একা নয়, বউ-বাচ্চাসমেত। এখন ক্ষতিগ্রস্ত পার্টি সক্কলের মাথায় হাত। পাওনাদাররা হায় হায় করছেন। হায় রে! এদের জন্যই বোধকরি বলা হয়েছিল, ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না!

মামলা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা ডিসির দরবারে ধরনা দিয়েছেন। কেন্দে কেটে জার জার হয়েছেন। অভাগা লোকজনরা জেলা প্রশাসককে বলেছেন, হয় আমাদের টাকা ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন, না হলে মেরে ফেলেন। প্রতারক ও পলাতক জাহিদ হোসেন খলিফার সঙ্গে নানা উপায়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছে। সে ধরা দিতে চায় না। সেয়ানা লোক তো। সে জন্যই বোধহয়। অজ্ঞাত স্থান থেকে সে অল্পকথায় নিজের ‘দুরবস্থা’র কথা জানিয়েছে। বলেছে, সমস্যায় আছে। সময় দিলে টাকা শোধ করে দেবে। পুলিশ খলিফাকে খুঁজছে। খুঁজতে থাকুক। চিরুনি অভিযান চলতে থাকুক না। এই ফাঁকে আমরা খলিফার কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে দেখি। হয়তো পণ্ডশ্রমই হবে, তারপরও মন যে মানে না।
খলিফা কেন উত্তম কাজ করেছে? তার দৃষ্টান্ত কেন অনুসরণীয়? আমরা একটু খতিয়েই দেখি না কেন?

* বোকা পাবলিককে ধোঁকা দেয়ার কোনো বদ ইচ্ছা তার মাথায় ছিল না। তাদের নিজস্ব অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলার মহত্ লক্ষ্যেই সে এ কাজ করেছে। জাতীয় পর্যায়ে আমরা কতই না প্রতারণার মুখোমুখি হচ্ছি প্রতিনিয়ত। কই, তা নিয়ে তো এমন হাল্লাচিল্লা করি না। এই যে বিদ্যুত্, গ্যাস, পানি, ইতিহাস, সংশোধনী ইত্যাদি নিয়ে কারবালায় পরিণত হয়েছে সোনার দেশ, আমরা কি মিনিমাম ট্যাঁ ফোঁ করছি? সীমান্তে আমাদের মহান প্রতিবেশীর পাইক বরকন্দাজরা প্রতিমাসেই গণ্ডায় গণ্ডায় বাংলাদেশী নাগরিকদের লাশ ফেলছে। আমরা কি তার ন্যূনতম নিন্দা প্রতিবাদ করছি? খলিফার মতো কোনো প্রতিভাবানের পাঁচনের রাম খোঁচা পেলে হয়তো আমরা জেগে উঠলেও উঠতে পারি। যদিও এরই মধ্যে আম-ছালা দুটোই গন হয়ে গেছে আমাদের! কখন এই সর্বনাশ ঘটল? হায় রে কপাল!

* ঘরে ঘরে লোকজনকে রাতারাতি টাকাওয়ালা বানিয়ে ফেলার আজীব একখান স্বপ্ন সে (খলিফা) সাফল্যের সঙ্গে দেখাতে সক্ষম হয়েছিল। তার ম্যানিফেস্টো লোকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিল বলেই না এই বালা মুসিবত। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। জাতীয় জীবনেও কি আমরা বিশ্বাসের (অন্ধ) উপযুক্ত প্রতিদান পেয়েছি? পেয়েছি কি ঘরে ঘরে চাকরি? পেয়েছি কি ১০ টাকা কেজির চাল? পেয়েছি কি বিদ্যুত্,পানি, গ্যাস?

* লোক ঠকানোর বিস্ময়কর প্রতিভা, যাকে বলছি এই খাতের অন্যতম সেরা তালেবর, সে কি ধরা পড়বে। খুব সহজে যে ধরা পড়বে না, এ কথা একটা বাচ্চা ছেলেও জানে। শেয়ারবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা যত সহজে ধরা খেতে পারে, এই ধড়িবাজ খলিফাকে ধরে ফেলা ততই কঠিন। কোনোক্রমে ধরে ফেললেও তার হাতে আছে প্রচুর মালপানি। আমরা তো জানিই, মালপানির ক্ষমতা কতই বিস্ময়কর। রাতকে দিন, দিনকে রাত বানিয়ে ফেলার মতো সুকঠিন কাজ পানির মতো সহজ করে ফেলা যায়। এই থেরাপিতে মালপানির ভূমিকাকে জাদু বললেও কম বলা হয়।

* বৌ-বাচ্চাসমেত আত্মগোপনকারী খলিফার চিন্তার কিছু নেই। গা-ঢাকা দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে বহাল তবিয়তে সে থাকতে পারবে বহু বহু দিন। হয়তো। গ্লোবাল ইন্টেগ্রিটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্ট এটি। এতে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে : আইন প্রণয়নে বাংলাদেশ যতটা ভালো, প্রয়োগে ততটাই খারাপ। শুধু এটুকুই না। রিপোর্টে ভয়ঙ্কর তথ্য আছে আরও। বলা হয়েছে : সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল। ন্যায়পাল নিয়োগ না করা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন পরিস্থিতির তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।

অতএব, খলিফার মতো যারা আছো, খাও দাও মৌজ করো। নো চিন্তা ডু ফুর্তি।

Priyo.com