ভিওআইপি ছড়িয়ে দিন : পল্লব মোহাইমেন

অনেকেই আশা করেছিলেন, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ভিওআইপির সত্যিকারের মুক্তি ঘটবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। জুয়া খেলার মতো নিলামে তিনটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেল। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স ফি বাবদ বছরে দেবে ১৫ কোটি টাকা। এরপর রাজস্ব হিসেবে আয়ের ৫১ থেকে ৬৫ শতাংশ দিয়ে দিতে হবে সরকারকে। ব্যবসার আয়কর, ভ্যাট ইত্যাদি তো দিতেই হবে। বাংলাদেশের আর কোনো ব্যবসায় কি রাজস্ব আয়ের এত বড় একটা অংশ সরকারকে দিতে হয়? এসবের ফলে আইজিডব্লিউয়ের কলরেট বেশি রাখতেই হয়। লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যক্রম শুরুর আগেই সরকার ঠিক করে দিয়েছিল যে প্রতি মিনিট কলের মূল্য হবে ছয় সেন্ট। পরে চার সেন্টে কার্যক্রম শুরু করে আইজিডব্লিউগুলো। এখন কলের এই মূল্য প্রতি মিনিটে তিন সেন্ট। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মিনিটে কলের মূল্য দেড় থেকে দুই সেন্ট। কোনো কোনো সময় এটা এক সেন্টেও নেমে আসে। ফলে ভিন্ন পথে দেশে আসছে ভিওআইপির কল। যাঁরা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে বেশি কথা বলেন, তাঁদের বেশির ভাগই প্রবাসী শ্রমজীবী মানুষ। তাঁদের কাছে প্রতিটি পয়সা মূল্যবান। তাই সাশ্রয়ী টেলিযোগাযোগের দিকেই তাঁরা এগিয়ে যান। কোন কল বাংলাদেশে কোন পথে ঢুকছে, তা দেখার দায়িত্ব তাঁদের নয়। বলা হয়ে থাকে, বৈধ পথে মানে বেশি টাকা খরচ করে ভিওআইপি কল করলে সেটির কথা বলার মান অনেক ভালো হয়। যেখানে স্বদেশে ফেলে আসা আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে কথা বলাই আসল উদ্দেশ্য, সেখানে কম খরচটাই তো মুখ্য।

এ কথা এখন প্রমাণিত সত্য যে চারটি আইজিডব্লিউ লাইসেন্স দিয়ে ভিওআইপি উন্মুক্ত হয়নি বরং একচেটিয়া ব্যবসার একটা সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এতে দেশের মানুষ সর্বনিম্ন খরচে কথা বলতে পারছে না।

আসলে এই মুহূর্তে ভিওআইপি উন্মুক্ত করে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ভিওআইপি এমন এক প্রযুক্তি, নিত্যনতুন উদ্ভাবনে যা প্রতিদিন মানুষের আরও নাগালের মধ্যে চলে আসছে। ধরুন, আপনার মুঠোফোনে স্কাইপ বা ফ্রিংয়ের মতো সফটওয়্যার আছে। আর আপনার আছে মাসে নির্দিষ্ট একটা ফি দিয়ে অসীম সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা। এখন চাইলে এই স্কাইপ বা ফ্রিং দিয়ে আপনি পৃথিবীর যেকোনো স্কাইপ বা ফ্রিং ব্যবহারকারীর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। ইন্টারনেটের সেই মাসিক ফির বাইরে এক কানাকড়িও খরচ হবে না। এটাও কিন্তু ভিওআইপি। এটা কীভাবে বন্ধ হবে? ইয়াহু মেসেঞ্জার, গুগলটকের মতো সফটওয়্যার থেকেও কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে কল করা যাচ্ছে। এগুলো বন্ধ করা যাবে? এ সবই তো ভিওআইপি।

ভিওআইপি পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও প্রযুক্তি সারা দেশেই আছে। র‌্যাবের অভিযানের পর যাদের ভিওআইপি পরিচালনার যন্ত্রপাতিসমেত বুকে ট্যাগ লাগিয়ে গণমাধ্যমে দেখানো হয়, তাঁরা আসলে ভিওআইপির প্রযুক্তিকর্মী। তাঁরা ব্যবসায়ীও নন। মূল হোতারা সব সময়ই থাকেন নাগালের বাইরে। কিন্তু এই দক্ষ প্রযুক্তিকর্মীদের ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। আজ যদি ভিওআইপি সত্যিকার অর্থে উন্মুক্ত করা হয়, তবে দেশে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

বলা হয়ে থাকে, সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে। কিন্তু নির্দিষ্ট লাইসেন্স ফি নিয়ে ভ্যাট এবং বেশি পরিমাণে কর নিয়ে যদি সারা দেশে ভিওআইপির লাইসেন্স দেওয়া হয়, তবে রাজকোষে পয়সার কমতি হবে না। ভিওআইপিকে বাংলাদেশে কুটির শিল্পের মতো ছড়িয়ে দিতে হবে। তৈরি করতে হবে প্রতিযোগিতামূলক বাজার। প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা বেশির ভাগ দেশেই ভিওআইপি খোলা। আমাদের এখনই ভিওআইপি মুক্ত করে দেওয়া উচিত। কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহারের পর এ দেশে আর চোরাই পথে কম্পিউটার আসে না। তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে ক্রেতা স্বল্পমূল্যেই কম্পিউটার কিনতে পারছেন।

মুক্ত পরিবেশে ভিওআইপির কলরেট কত হবে, তা বাজারই ঠিক করে দেবে। আন্তর্জাতিক বাজারে যে মূল্য হবে সর্বনিম্ন, বাংলাদেশেও তা দিয়ে কথা বলা যাবে। ফলে প্রবাসীরা সাশ্রয়ী মূল্যে প্রিয়জনদের সঙ্গে আরও বেশি করে কথা বলতে পারবেন।

দেশে ভিওআইপি পরিচালনাতেই যে শুধু বাংলাদেশিদের দক্ষতা আছে তা নয়, বাংলাদেশি তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের তৈরি করা ভিওআইপির নানা রকম সফটওয়্যার বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। তদুপরি মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপে যাঁরা ভিওআইপির বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁদের অনেকেই প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। এসব মানুষের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা আমরা কাজে লাগাতে পারি। দেশের অভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগেও ভিওআইপির ব্যবহার বাড়ানো যায়। আইপিনির্ভর নানা সেবা উচ্চপ্রযুক্তির পাশাপাশি দেবে ব্যয় সংকোচনের সুযোগ। কিন্তু ভিওআইপির বহুমুখী ব্যবহার থেকে বাংলাদেশ আজ বঞ্চিত। এর কারণ একটাই, ভিওআইপির ওপর চাপানো ‘অবৈধ’ তকমা। কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থে ভিওআইপিকে আর অবৈধ করে রাখা ঠিক হবে না। এই প্রযুক্তিকে একেবারেই খুলে দিতে হবে।

কদিন আগে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জনক স্যার টিম বার্নার্স লি বলেছেন, ইন্টারনেট মানুষের মৌলিক অধিকার। সেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে কম খরচে টেলিফোনে কথা বলাও এখন মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়বে। আইন করে মানুষের জন্য উপকারী কোনো প্রযুক্তি বন্ধ বা অবৈধ ঘোষণা করা যায় কি না, এখন সময় এসেছে সেসবের বিচার-বিশ্লেষণ করার। আইন করে মানুষকে প্রযুক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত করাও তো মানবাধিকারের পরিপন্থী।

Source : Prothom-Alo
পল্লব মোহাইমেন: সাংবাদিক।
pallabmohaimen@gmail.com

New layer…