আমেরিকার সঙ্গে টেলিযোগাযোগব্যবস্থা পৃথিবীর সব দেশেরই ভালো। এমনও হয়েছে যে ঢাকা থেকে কলকাতার লাইন পাওয়া যাচ্ছে না; কিন্তু ঢাকা থেকে আমেরিকা হয়ে কলকাতায় কথা বলা যাচ্ছে। আমেরিকাকে ধরা হয় টেলিযোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু। সব দেশ এর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করেছে। সেই হিসাবে আমেরিকা থেকে যে দেশে কথা বলতে যত বেশি খরচ হয়, তাকে আমরা ধরে নিতে পারি তত বেশি পিছিয়ে পড়া দেশ। কিছু উদাহরণ দিলে বিষয়টি বোঝা যাবে।
যেমন আমেরিকা থেকে ইউরোপের অনেক দেশে বিনা পয়সায় কথা বলা যায়। এর অর্থ হলো, এরা যোগাযোগব্যবস্থাকে এতই সহজ করে ফেলেছে যে নিজেদের আমেরিকার পাশাপাশি নিয়ে এসেছে। এরা যোগাযোগব্যবস্থা থেকে পয়সা বানানোর চেষ্টা করছে না; বরং এটাকে ব্যবহার করে অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে মুনাফা করছে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার অন্যান্য বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে। একটি দেশে বিদ্যুত্, পানি যেমন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়; টেলিযোগাযোগও তেমনি। এটাকে যত সহজ করা যায়, ততই মানুষের জন্য মঙ্গল। আমেরিকা থেকে আফ্রিকার দেশগুলোতে কলচার্জ খুব বেশি। এর অর্থ হলো, এরা তথ্যপ্রযুক্তিতে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এখন আমেরিকা থেকে ভারতে একটি ফিক্সড বিল দিয়ে যত খুশি কথা বলা যায়। কারণ ভারত এই প্রযুক্তিকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আমরা এখনো সেই পুরোনো বেড়াজালে আটকা পড়ে আছি। কিছুতেই আমরা এই বন্ধন থেকে যেন মুক্ত হতে পারছি না।
পৃথিবীর যাবতীয় দেশ যখন ভয়েস ওভার আইপি উন্মুক্ত করে দিয়ে দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমরা কেন বারবার এটাকে পুঁজি করে পুরো দেশকে জিম্মি করে রাখছি? কার সুবিধার জন্য?
বিএনপি সরকার তার পুরো সময় এটাকে নিজেদের ব্যবসার কাজে ব্যয় করল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এই সেবার লাইসেন্স দিল। এখন শুনছি এই সরকার আরও কিছু লাইসেন্স দেবে। কিন্তু জনগণের দাবি যদি হয় সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দেওয়া, তাহলে সমস্যাটা কোথায়! যখনই সরকার এটার ওপর বাড়তি কোনো ট্যারিফ রাখবে না, তখনই বিদেশ থেকে কথা বলার খরচ অনেক কমে যাবে। তখন আর কাউকে এটা নিয়ে চোর-পুলিশ খেলতে হবে না। এই সমস্যার চীরতরে একটা সমাধান হয়ে যেতে পারে।
সরকারের দিক থেকে বলা হয় যে সরকার রাজস্ব হারাবে। এখনো কি সরকার সঠিক রাজস্ব পাচ্ছে? এনবিআর যেমন যেকোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে কর আদায় করে, এটাও তাই। কয়েকটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর সব দেশ এটাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এটাকে এভাবে বেঁধে রাখা যায় না। যে জিনিস বেঁধে রাখা যায় না, সেটাকে বাঁধতে গেলেই যত বিপত্তি।
আমাদের দেশের তরুণ গোষ্ঠীর কাজের তেমন একটু সুযোগ নেই। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে এই লাখ লাখ তরুণের কাজের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া যায়। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই জটিল প্রযুক্তি তারা পেটের ক্ষুধার তাড়নায় ঠিকই শিখে ফেলেছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা যে প্রযুক্তি শিখতে পারে, এটাই কি তার বড় প্রমাণ নয়?
আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে দেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, সেটা অনেক ক্ষেত্রে তিন ফুট উঠে দুই ফুট নিচে নেমে যাওয়া। মাঝে মাঝে মনে হয় চার ফুট নিচেও নেমে যাচ্ছি। এই ভয়েস ওভার আইপি আমাদের সবার মুখে কালি মেখে দিয়েছে। জিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে যাঁরা প্রধানন্ত্রীকে পরামর্শ দিচ্ছেন, যাঁরা এর স্বপ্নদ্রষ্টা, তাঁদের চিন্তাটা প্রশংসনীয়। কিন্তু বাস্তবায়নে আরও পরিপক্ব হওয়া জরুরি। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ, আপনি দয়া করে তাঁদের ডেকে, এটাকে উন্মুক্ত করার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করুন। এটি আমাদের ওপর একটি রাহুর মতো ভর করে বসে আছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ, আপনি দেশকে সেই রাহুর হাত থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিন।
সিলিকন ভ্যালি, যুক্তরাষ্ট্র
জাকারিয়া স্বপন: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ।
zakariaswapan@hotmail.com
Source : Prothom-Alo.com | তারিখ: ২৬-০৩-২০১০