মহাসঙ্কটে নিপতিত সরকার ও জনগণ

সরকারের দলীয়করণ, লাগামহীন সন্ত্রাসী ও অবৈধ কার্যকলাপ ও দুর্নীতির জন্য সমস্যা বেড়ে ভাদ্রের নদীর মতো কানায় কানায় ভরে গেছে। ফলে কেবল বিরোধী দল থেকে নয়, মহাজোটের শরিক থেকেও সমালোচনা হচ্ছে এবং তারা মহাজোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি হেরে যায়_ যাওয়াটাই স্বাভাবিক, তাহলে এসব এতিম নেতার হালুয়া-রুটি খাওয়া একদম বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ মহাজোটে যদি গাঁটছড়া না বাঁধে তাহলে ওইসব দলের এককভাবে নির্বাচনে বিজয় অসম্ভব। কাজেই শেখ হাসিনা যিনি একাধারে পার্টি প্রধান, সংসদীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী, তার কাছে তাদের প্রত্যাশা তিনি যেন মহাজোটকে চাঙ্গা করেন, তাদের মতামতের গুরুত্ব দেন, দুর্নীতি কমান, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির যেন কিছুটা সমাধান করেন। তাহলে মহাজোট আবার জিতবে এবং তখন এসব এতিম নেতা এবার মন্ত্রী না হলেও আগামীতে মন্ত্রী হবেন কিংবা উপমন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু যেভাবে চলছে সরকার, তাতে তারা হতাশ ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে এবং যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও অভিমানী।

দুর্ভাগ্য, সমস্যার মধ্যে দুটি সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করেছে_ লিমন ট্র্যাজেডি এবং শেয়ার বাজারের ধস। জনগণের প্রচ- চাপে তদন্ত করতে বাধ্য হয়ে তদন্ত প্রতিবেদন বের হওয়ার পর সরকারের আক্কেল গুড়ুম। তারা স্বপ্নেও ভাবেনি বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী, যে তাদের প্রিয় বিশ্বাসী মানুষটি এ ধরনের রিপোর্ট দেবে। যে রিপোর্টে তাদের কাছের মানুষের নাম থাকবে। কী ভয়াবহ রিপোর্ট। ভয়াবহ আরো এ জন্য যে, এদের নাম ১৯৯৬ সালের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি প্রতিবেদনেও ছিল। এখন খালেদ সাহেবের বিরুদ্ধে সরকারি মহল ও আওয়ামী লীগ মালিকানাধীন পত্রিকা মাঠে নেমে তার চরিত্র হনন শুরু করেছে এবং তাকে ভয়াবহ বিপদের মুখে নিক্ষেপ করেছে।

লিমন ট্র্যাজেডির জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন যা বলেছেন তা অমানবিকই নয়, মহাদুঃখজনক। ফলে মানবাধিকার চেয়ারম্যানের কান্না ও সহানুভূতি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তার আবেদন বুমেরাং হয়ে গেছে। ফলে বেচারি চেয়ারম্যান তারপর থেকে এমন চুপ হয়ে পড়েছেন যে তিনি ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং ভয়ঙ্কর লজ্জার কথা উল্টো লিমনকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে মামলা করা হয়েছে। অথচ এটা র‌্যাবের অন্যায় কাজের জন্য সরকার ব্যবস্থা নিলে সরকারের সম্মান বাড়ত।

সবচেয়ে সমস্যা সৃষ্টি করছে সরকার সংবিধান নিয়ে। এ সম্পর্কে অসংখ্য লেখা বেরিয়েছে। অধিকাংশই বাস্তবধর্মী মতামত ও বক্তব্য। কিন্তু ওস্তাদের মার শেষ রাত্রে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী হিসেবে আসল উদ্দেশ্য ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ৯০ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে বিদায়ী সরকার অর্থাৎ বর্তমান সরকার পুনর্বহাল হবে এবং নির্বাচন করবে। অর্থাৎ ছলেবলে-কৌশলে নির্বাচনে বিজয়ী হবে আওয়ামী লীগ সরকার। ভাবতে অবাক লাগে এসব নেতা তথা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কত হীনস্বার্থে রাজনীতি করে যার অর্থ হলো যেমন করে হোক ক্ষমতায় থাকা। তাহলে প্রজেক্টের নামে অর্থ আত্মসাত করা যায়, দলীয় নেতাকর্মীরা লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বালু চুরি, জমি দখল এবং পর্বতসমান দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করা যায়। দুঃখ এখানেই এবং লজ্জা যে তথাকথিত বামপন্থী নেতারা এই হীনস্বার্থে আওয়ামী লীগ ও সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে দু'একজন মন্ত্রী হওয়ার জন্য। দেশকে এক ভয়াবহ সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ সরকার হারবে তা এই দলটি সবচেয়ে ভালো জানে।

এসব সমস্যার মধ্যে ঋণ সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক দেবে ১২০ কোটি ডলার। এছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, ও জাপান দেবে ১১৫ কোটি ডলার। বাকি অর্থ বাংলাদেশের। এটি নাকি স্বপ্ন। এই স্বপ্নে কী হবে? যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। অর্থাৎ দক্ষিণবঙ্গ থেকে ঢাকা আসা কাজে-কামে সহজ হবে। অথচ এই টাকার অর্ধেক টাকায় দক্ষিণবঙ্গের কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ ও কুটির শিল্পে বিপ্লব করা যেত। ঢাকার ওপর চাপ কমতো। বছরের পর বছর নানাবিধ কাজে ঢাকার ওপর নির্ভরতা কমে যেত। কিন্তু না, প্রকল্প দরকার। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নয়; দুর্নীতর জন্য। বিশ্বব্যাংক চুক্তি করার আগে-পরে বারবার দুর্নীতি যেন না হয় হুশিয়ারি করেছে। স্বচ্ছতার কথা বলেছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে।

এভাবে দেখলে দেখা যায়, সমস্যা বাড়ছে তো বাড়ছেই। হঠাৎ করেই পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি সামনে এসেছে। জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক, রাজনৈতিক দল ও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো অস্ত্র জোগাড় করছে। মিয়ানমার ও ভারতীয় কয়েকটি গ্রুপের কাছ থেকে সেখানে অস্ত্র আসছে। নারীনীতি নিয়েও সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমিনীদের সঙ্গে সংলাপ করলে এ সমস্যা দেখা দিত না। কিন্তু সরকার সংঘর্ষে ও দ্বন্দ্বে চলে গেল। মিছিল-মিটিংয়ে বাধা দেয়া হলো। এটা এখন যথেষ্ট জটিল সমস্যা। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি মিটছে না। সরকারের অর্থমন্ত্রীর একের পর এক বিবৃতি সমস্যাকে জটিল করে তুলেছে। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন এখনো ঢেলে সাজানো সম্ভব হয় নি। ফলে শেয়ার বাজারের অবস্থা ঠিক আগের মতোই।

এই সরকারের আমলে বিপুলসংখ্যক অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে। এতে প্রশাসনে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। অনভিজ্ঞ দলীয় সমর্থকদের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। এতে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাছাড়া সরকারি দলের মধ্যে ব্যর্থতা ধরা হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী, পাটমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রমুখের লাগামহীন কথা বলায় দলের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছে। উপদেষ্টারা অবান্তর ও লাগামহীন কথাবার্তা বলেন। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, অসভ্য জাতি ট্রানজিট ফি নেয়। ইউনূস সঙ্কটও সরকারকে বিপদে ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ- চাপ আছে। একটার পর একটা কর্মকর্তা এসেছেন এবং চাপ দিয়ে চলেছেন সরকারকে।

সব মিলে এ সরকার মহাসঙ্কটে পড়েছে এবং জনগণকেও সঙ্কটে ফেলেছে। এতে মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে বই কমবে না। দলীয়করণ, দুর্নীতি ও সুশাসনহীন অস্থিরতার এই বছরে জাতি ও দেশ ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে পতিত হবে। সরকার সময় থাকতে সতর্ক না হলে পরিণতি যে শুভ হবে না তা বলাই বাহুল্য। সরকারের মতিগতি দেখে মনে হয় সরকার সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে, সঙ্কটের সমাধান করতে পারে না কিংবা চেষ্টাও করে না।

Priyo.com