সুন্দর বনের জন্যে ভোট, এবং কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা..

কুড়িগ্রাম হয়ে রৌমারী যাওয়ার পথে। ফ্লাইটের দেরী। কেন দেরী কেউ বলতে পারছেনা। সময় নষ্ট করতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি এয়ারপোর্ট টার্মিনালে। কড়িডোরের এক কোনায় খাতা মত কিছু একটা চোখে পড়তে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম। মন্তব্য খাতা, এয়ারপোর্ট এবং বিমানের সার্বিক সার্ভিস নিয়ে মন্তব্য করতে অনুরোধ করা হয়েছে যাত্রীদের। পাতা উলটে পড়তে শুরু করলাম ইতিমধ্যে দেয়া মন্তব্যগুলো। ভাগ্যিস সাথে ইংরেজী জানা কেউ ছিলনা, বিশেষ করে রমণীকুল! বাংলায় কোন মন্তব্য দেখলাম না, সবটাই বিদেশীদের। ইংরেজীতে এমন কুৎসিত গালাগালি এ জন্মে পড়া দূরে থাক, কখনও শুনেছি বলে মনে করতে পারলাম না। এক ভদ্রলোক লিখেছেন, ‘পারলে এয়ারপোর্টের সবাইকে পাখীর মত গুলি করে মারতাম‘।

ঘটনা-২:
আমার এক বন্ধু গত বছর দেশে গিয়েছিল বিয়ে করতে। বিয়ের অনুষ্ঠানিকতা শেষে স্বামী-স্ত্রী দু’জন গেল কক্সবাজারে হানিমুন করবে বলে। হানিমুন দিনগুলোর কোন এক সন্ধ্যায় রিক্সা করে হোটেলে ফিরছিল ওরা। আজরাইলের মত পথ রুখে দাঁড়াল স্থানীয় পুলিশ। তাদের সন্দেহ, এরা আসল স্বামী-স্ত্রী নয়। বিয়ের দলিলাদি দেখতে চাইল সত্য প্রমানের জন্যে। নগদ নারায়ণ বাবাজিকে ডাকতে হল উদ্ধারের জন্যে।

ঘটনা-৩:
১৯৯৫ সালের কথা। অষ্ট্রেলিয়ার সিডনি শহর। শহরটার এন্‌জাক প্যারেডের উপর রতন ভাইয়ের গ্রোসারি দোকান তখনকার দিনে বাংলাদেশীদের একমাত্র দোকান। সকাল বিকাল ওখানটায় বাংলাদেশীদের আড্ডা। কোন এক বিকেলে দোকানটার সাইন বক্সে একটা শালিক আটকে ছটফট করতে শুরু করল। আর যায় কোথা! রাস্তা হতে কে একজন দেখে ফেলে পাখিটাকে। দেখাদেখি প্রায় গোটা ৫০ গাড়ি থেমে গেল। যাত্রীরা হায় হায় করে উঠল পাখিটার ভাগ্য নিয়ে। শালিকটার শেষ অবস্থা দেখার মত সময় এবং ধৈর্য্য না থাকায় জানা হয়নি এর শেষ পরিণতি।

মূল লেখাঃ
ইদানিং প্রায়ই দেশ হতে ই-মেইল পাচ্ছি সুন্দর বনকে বিশ্বের আশ্চর্য্যতম স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে ভোট দেয়ার জন্যে। অনলাইনে ভোট হচ্ছে, তাই একটা নয়, একাধিক ভোটের অনুরোধ। নিঃসন্দেহে কক্সবাজার এবং সুন্দরবন খুব সুন্দর জায়গা, পৃথিবীর অনেক জায়গার সাথে টেক্কা দিয়ে সুন্দরতম জায়গার উপাধি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু প্রাসঙ্গিকভাবেই দু’একটা কথা এসে যায়।

প্রথমত, একাধিক ভোট দেয়া কি অনৈতিকতার পর্যায়ে চলে যায়না?

দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর সুন্দরতম জায়গাগুলো যাদের ভ্রমণ করার সূযোগ হয়েছে তাদের একটা জিনিস স্বীকার করতে হবে, শুধু জায়গা নয়, জায়গাটা ঘিরে বাস করা মানুষ গুলোকেও সুন্দর হতে হয় এমন একটা স্থান পেতে। আমাদের সুন্দরবন কি এদিক হতে তৈরী বিশ্বকে টেক্কা দেয়ার জন্যে? এই কি সেই সুন্দরবন নয় যেখানে শতাব্দি ধরে বেড়ে উঠা গাছগুলোকে নির্বিচারে নিধন করা হয় বনখেকো ওসমান গনী এবং সাজেদা চৌধূরীদের পকেট ভরতে? এই কি সেই সুন্দরবন নয় যেখানে হরিণ সহ বিরল প্রজাতির পশু-পাখীদের জবাই করা হয় জৈবিক চাহিদা মেটানোর লালসায়? এই কি সেই সুন্দরবন নয় যেখানে মেজর জিয়াউদ্দিনের মত রাষ্ট্রীয়ভাবে লালিত ডাকাতদল ঘাটে ঘাটে ওঁৎ পাতে থাকে শিকারীর আশায়? ধরে নিলাম অনৈতিকতার আশ্রয় নিয়ে সুন্দরবনকে পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য্য সুন্দর স্থাপনা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা গেল। স্বভাবতই এ্মন একটা বন আবিষ্কারে ঢল নামবে ট্যুরিস্টদের। পৃথিবীর অনেক দেশে ছুটি কাটানোর জন্যে মানুষ হন্যে হয়ে খুজে বেড়ায় নতুন জায়গা, তাই সুন্দরবনের মত নতুন একটা নাম অনেকের নজড় কাড়বে। আমাদের বিমান বন্দর হতে সুন্দরবন পর্য্যন্ত রাস্তার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে মৃত্যুর হাতছানি, মলম পার্টি আর অজ্ঞান পার্টির পাশাপাশি কাজ করে রাজনৈতিক সন্ত্রাস। এ সবের ফাক ফোকর গলে ক’টা ট্যুরিস্ট জান নিয়ে ফিরে যেতে পারবে আপন ঠিকানায়?

এমনিতেই বিশ্বে আমাদের পরিচিতি দুনীতির কর্ণধার হিসাবে। সুন্দরবনকে বিশ্বসুন্দরী বানাতে গেলে আমাদের পরিচিতির পাশে নতুন একটা বিশেষণ যোগ হবে, বিশ্বজালিয়াত! যে দেশের মানুষ একটা শালিক পাখির জীবন নিয়ে বিচলিত হয় বিনা প্ররোচনায়, তারা যদি জানতে পারে সুন্দরবন হচ্ছে হরিণ আর বাঘ শিকারের অভয়ারণ্য, গাছ নিধনের স্বর্গভূমি, তাহলে তাদের প্রতিক্রিয়াটি এয়ারপোর্টের সেই মন্তব্য খাতার মত হবেনা এর নিশ্চয়তা কোথায়?

আসুন, নিজদের সুন্দর করি আগে, তারপর না হয় সুন্দরবন নিয়ে ভাবা যাবে। সুন্দরবন এমনিতেই সুন্দর, তার জন্যে জাতীয়ভাবে ভোট জালিয়াতির আয়োজন করতে হবে কেন?

NB: সৈয়দপূর এয়ারপোর্টে বিমান সময়মত ল্যান্ড করতে পারেনি কারন রানওয়েতে কিছু বেওয়ারিশ গরু-ছাগল হাঁটাহাটি করছিল!

আমিবাংলাদেশী – AmiBangladeshi.org