হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য-যাঁতা ও মুষ্টি চাল প্রথা

পূর্বে যাঁতার সাহায্যে গম, চাল, কালাই, মশুরী, যব ইত্যাদি পিষা নিয়ে সারা বছর ব্যস্ত থাকতেন গ্রাম বাংলার গৃহিনীরা। গ্রামের শত শত শ্রমজীবি মহিলার কর্মসংস্থান ছিল যাঁতার ওপরেই। যাঁতাতে পিষা আটা দিয়ে বানানো পিঠা বেশ সু-স্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর বলে প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে যাঁতাতে পিষা আটা এখনও বেশ প্রিয়। প্রতিদিন বিকেলে ও কাঁকডাকা ভোরে আজপাড়া গাঁ মুখরিত হয়ে উঠত যাঁতার ঘ্যাঁস-ঘ্যাঁস শব্দে। পাড়াগাঁয়ে ঢুকলেই শোনা যেত যাঁতার মধুর শব্দ। গ্রামীণ বধূরা এখন আর যাঁতাতে হাত রাখেন না। তবে কোনও কোনও বাড়িতে পিঠা বা ছাতু তৈরিতে যাঁতার প্রচলন এখনো রয়েছে।

মুষ্টি চাল-দুঃসময়ের বন্ধু, গ্রামীণ মহিলাদের কৃষ্টি ‘মুষ্টি চাল’ সংরক্ষণ ও সংগ্রহ প্রথা গ্রামাঞ্চল থেকে আজ উঠে যাচ্ছে। আধুনিকতা এসে কেড়ে নিয়েছে গ্রামীণ সঞ্চয় মুষ্টি চাল প্রথা। গ্রামীণ গৃহবধূদের রান্নার জন্য কলসি থেকে মেপে নেয়া চালের এক-দুই মুঠো চাল অন্য পাত্রে তুলে রেখে জমা করার পদ্ধতিই হচ্ছে মুষ্টি চাল সংরক্ষণ। গৃহীনিরা যে পাত্রে মুষ্টি চাল সংরক্ষণ করে আসছেন ওই পাত্রের নাম স্থানভেদে বরকতের হাড়ি, বরের হাড়ি, লক্ষীর ভান্ডার, মুষ্টি পাত্র বা সঞ্চয় হাঁড়ি বলে কথিত।

আশোকাঠী গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধা ফুলবানু বেগম জানান, আবহমানকাল থেকে মুষ্টি চাল গ্রামাঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়ে অতিথি আপ্যায়ণে, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার প্রয়োজনে, মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানায় সর্বপরি সংসারের জরুরী প্রয়োজনে অথবা মহিলাদের ক্ষুদ্র আয়বর্ধনমুলক কাজে পুঁজি হিসেবে কাজে লেগে আসছে।
এই মুষ্টি চাল সংরক্ষণ প্রথা কবে কখন কারা প্রথম শুরু করেছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়, তৎকালীন অবিভক্তি ভারতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনকারীদের সহায়তা করার জন্য সে সময়ে প্রথম গৃহিনীরা মুষ্টি চাল সংরক্ষণ করে রাখতেন। সপ্তাহ বা মাস শেষে স্বদেশীরা গৃহিনীদের সংরক্ষিত ওই চাল নিয়ে যেতেন খাদ্য বা অন্যান্য আর্থিক সহায়তার প্রয়োজনে।

গেরাকুল গ্রামের সীমা আহম্মেদ জানান, গৃহিনীদের সংরক্ষিত মুষ্টি চাল দ্বারা অনেক সামাজিক, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হওয়ার নজির প্রায় প্রতিটি গ্রামে রয়েছে। এক সময় গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ এতিমখানা, মসজিদের ইমামের বেতন, মকতবের হুজুরের বেতন মুষ্টি চালের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। উত্তর মোড়াকাঠী গ্রামের রাশিদা বেগম জানান, মুষ্টি চালের বহুবিধ উপকারীতার কথা জানা সত্বেও গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় অধিকাংশ গৃহিনীরাই মুষ্টি চাল সংরক্ষণে প্রথাকে এখন গ্রাম্যতা বা ব্যাকডেটেড বলে মনে করেন। সে কারনে তারা মুষ্টি চাল সংরক্ষণের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি আরো জানান, প্রতিবারের রান্নার চাল থেকে ২/১ মুঠো বরকতের হাঁড়িতে তুলে রেখে গৃহিনীরা প্রতিমাসে ৭/৮ কেজি চাল সংরক্ষণ করতে পারেন। আশোকাঠী গ্রামের মমতাজ মিজান জানান, প্রতিমাসে একবার সংরক্ষিত মুষ্টি চাল বিক্রি করে অর্জিত অর্থ দিয়ে অনেকেই পারিবারিক ভাবে হাঁস-মুরগিসহ ছাগল পালনে ব্যয় করে বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারেন।