মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমাদের জনসেবা

ধরে চলে আসা সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার শিকড় উপড়ে ফেলে http://www.thesundayindian.com/secure/app/webroot/js/uploaded/29-05-2011bangla/4.jpgঐতিহাসিক ফলাফল অর্জনের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। যেমন ঐতিহাসিক ফলাফল, তেমন তাঁর কর্মসূচিও। শপথ নেয়ার সময় দরিদ্র রিকশাচালক থেকে শুরু করে কুলি-মজুর-শ্রমিকসহ নিম্নপেশা ও বর্ণের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন সূচনাতেই।

দায়িত্বভার গ্রহণের পর আরও যে বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তারই ধারাবাহিক প্রতিফলনও শুরু হয়েছে। তিনি অন্যান্য নাগরিকের থেকে যে আলাদা নন সে কথা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের প্রথম দিনেই জানিয়ে দেন। মুখ্যমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত বুলেটপ্রুফ গাড়ি তিনি নাকচ করে দিয়ে তার দলের দেয়া ট্যাপ খাওয়া ছোট্ট কালো সান্ট্রো গাড়িতেই মহাকরণে যাচ্ছেন।

ক্ষমতা গ্রহণ করেই তাঁর ট্রাফিক নিরাপত্তায় নিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের জানিয়ে দেন, হুটার বা লালবাতি লাগানো পাইলট গাড়ি তো নয়ই, এমনকি কনভয়ে একটি-দু’টির বেশি গাড়ি রাখাও চলবে না। সাধারণ নাগরিকের মতোই তিনি ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে যাতায়াত শুরু করেছেন। প্রথম দিন বাড়ি থেকে মহাকরণ যাওয়ার পথে সঙ্গী ট্রাফিক পুলিশ অফিসার তাকে লাল সিগন্যাল পার করানোর চেষ্টা করতেই গাড়ি থামিয়ে তাকে মৃদু ভর্ত্সনাও করেছেন। একসময় পুলিশের নির্মম নির্যাতনে মহাকরণের সামন থেকে বিতাড়িত হওয়া মমতা মহাকরণের গেটে কর্তব্যরত পুলিশসহ সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন তাকে স্যালুট করার প্রয়োজন নেই। তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতোই থাকতে চান। তার জন্য নাগরিকদের কোনো রকম অসুবিধা হোক, সেটা তিনি চান না।

এবার একটু তাকাই আমাদের দেশের উপরতলা, মধ্যমতলা কিংবা কিছুটা নিচতলার জনদরদী জনসেবকদের দিকে। নালায়েক পাবলিকের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে কিংবা মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে সিংহভাগ রথী-মহারথীদের পদ যত বড় বা উঁচু তাঁর তত দামি ও সর্বশেষ মডেলের গাড়ি থাকা চাই। তত বেশি আমলা-কামলা সিকিউরিটি চাই। গাড়ি বহর তত লম্বা চাই। অনেকক্ষণ আগে থেকে রাস্তাঘাট ব্লক করে এক্কেবারে ফকফকা করে আম জনসাধারণের মূল্যবান সময় বরবাদ করে বিশেষ ব্যক্তির আসন অলঙ্কৃত মহামূল্যবান শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি ও সামনে-পেছনে থাকা গাড়ি বহরের সহি-সালামতে প্রস্থানের পর তবেই আবার বেহুদা পাবলিকের চলাচলের জন্য রাস্তা খুলে দেয়া চাই। যার পদ যত বড় তার তত জৌলুসপূর্ণ সরকারি বাড়ি ও বাড়ির আসবাবপত্র চাই। বেতন-টেতনও সেভাবে বাড়িয়ে নিতে চাই। দেশের আম-জনতার সময়ের মূল্যের খুব একটা দরকার আছে বলে মনে হয় না। তাদের আবার সময় বাঁচানোর কোশেশ করার কী দরকার। নিজের সময়টা বাঁচাতে পারলেই কেল্লা ফতে। উত্সুক জনতা থ মেরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখুক সাহেব যাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে মেশার, তাদের দর্শন মুবারক দেয়ার বা তাদের অভাব-অভিযোগ শোনারও সময়-সুযোগ বের করা যেন একটি বাড়তি আপদ।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতাসীন দলের এক নেতাকে ওই দলের প্রবাসী আরেক নেতা বললেন, বিগত সরকারের এমপি নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার সময় অত্যাধুনিক পাজেরো জিপের সামনে কয়েকজন পুলিশসহ পুলিশের গাড়ি এবং সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি গাড়ির লম্বা লাইন থাকতো এবং সামনে একঝাঁক মোটরসাইকেল, যেগুলোয় দু’তিনজন করে ক্যাডার থাকত এবং সবাই হর্ন বাজিয়ে নানা কিসিমের মিছিল দিয়ে লিডারকে গন্তব্যস্থলে নিয়ে যেত। এ ধরনের সংস্কৃতি পরিহার করে আমাদের এমপি মহোদয় সাধারণ মানুষের মতো চলাচলের ব্যবস্থা করার রীতি ফিরিয়ে আনলে মনে হয় জনগণ খুশি হতো। ভবিষ্যতে আবারও ভোটাররা মূল্যায়ন করত। উত্তরে এই নেতা বললেন, এ ধরনের হলে মানুষ ওই ব্যক্তিকে আর বড় নেতা বা বড় এমপি হিসেবে মূল্যায়ন করবে না। এমপি আসার সময় সামনে-পেছনে লম্বা গাড়ির বহর থাকলে এবং ঝাঁকে ঝাঁকে মোটরসাইকেল থেকে হুইসেল ও স্লোগান দিলে তখন মানুষ বলবে বাহ! এই তো বোঝা যাচ্ছে এমপি সাহেব তশরিফ আনতেছেন। তখন মানুষের মূল্যায়নের মাত্রাটাও ততটা বাড়বে। এখন কথা হলো, যেসব কবির-ছগীর নেতা-পাতিনেতা তথা রথী-মহারথীরা নিজের মূল্যবান সময় কোরবানি করে লিডারকে এসকর্ট করে স্থানে স্থানে নিয়ে যায় তাদের আয়ের উত্স কি কোনো দিন খতিয়ে দেখেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ? সিলেটের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর গল্প শুনে কিছুটা তাজ্জব বনে গেলেও খবর নিয়ে জানলাম গল্পটা নিছক গল্প নয় বরং সত্যি এক আজব খবর। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি নির্বাচনী এলাকায় আসেন। প্রথম প্রথম কয়েকদিন নাদুস-নুদুস বিভিন্ন বয়সী নেতা-পাতিনেতা গাড়ির সঙ্গে তাদের নিজস্ব মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে খোশ মেজাজে সঙ্গ দেয়া শুরু করলেন। মন্ত্রী মহোদয় তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। হঠাত্ গাড়ি থামিয়ে পুলিশি নিরাপত্তা উপেক্ষা করে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানদার কিংবা বিভিন্ন শ্রেণীপেশার দুঃখী মানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় শুরু করে দেন। মোটরসাইকেল আরোহী নাদুস-নুদুস নেতা-পাতিনেতাদের ভীষণ বিরক্তি লাগে। কপাল কুচকে বলতে থাকেন, এমন নেতার পেছনে পেছনে দৌড়ে লাভ হবে নারে ভাই। সময় থাকতে কেটে পড়ি। মোটরসাইকেলের সংখ্যা কমতে থাকে। বাকি যারা থাকে তারাও কোনো লাভের আশা না দেখে ধীরে ধীরে কেটে পড়ে। ওই মন্ত্রী মহোদয় পোশাক-আশাকেও অত্যন্ত সাদা-সিদে চলাচল করতে দেখা যায়। কয়েকবারের এমপি এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার পরও কোট কিংবা টাই খুব কমই পরতে দেখা যায়। এই নেতার জনপ্রিয়তাও কমে না। এ ধরনের নেতার বড়ই অভাব আমাদের দেশে। শুধু রাজনৈতিক নেতা নয়, দেশের কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা তাদের বৃহত্ অংশের দাপট ও চালচলনের ধরন দেখে আমাদের দেশের অনেক অসহায় মুক্তিযোদ্ধা আক্ষেপ করে বলেন, এজন্যই কি একাত্তরে নিজের জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে সোনার এদেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম!

PriYo.com