এ জন্য বিরোধীদলীয় নেতাকে অভিনন্দন’ (বিশ্ব পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠানে রসিকতার সুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। এই বিষয়ে নীতিগল্পের অভাব পৃথিবীতে কখনো ছিল না। নীতিবাক্যও আছে অফুরান। যেমন—যা তুমি আজ করতে পারো, তা কালকের জন্য ফেলে রেখো না। এই বাক্যটাকে আমরা সংশোধন করে নিয়েছি, যা তুমি কাল করতে পারো, বোকার মতো তা তুমি আজ করতে যাচ্ছ কেন?
পরের কাজ আগে করাও ঠিক না। পরের কাজ আগে করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে এমন লোকের অভাবও তো গল্পকাহিনিতে কখনো ঘটেনি। কর্তা বললেন, বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবে। তোমাকে বলেছি, আমরা এখানে রান্না করে খাব, যাও, চাল-ডাল কিনে আনো, তুমি শুধু চাল-ডালই কিনবে, এখানে চুলা বানাতে হবে, চুলার লাকড়ি কে আনবে, আর হাঁড়ি-পাতিলই বা কই পাব, সেসব কিনবে না, তেল-নুন-হলুদ-মরিচ কিনতে আরেকবার বাজারে যাবে, গাধা কোথাকার? এরপর বাড়ির কর্ত্রীর জ্বর। কর্তা বললেন, যাও, ডাক্তার ডেকে আনো। ভৃত্য ডাক্তার তো আনল আনলই; কাফনের কাপড়, লাশ বহনকারী খাটিয়া, গোসল করানোর লোক, মায় জানাজা পড়ানোর হুজুর নিয়ে হাজির হলো। কর্তার নির্দেশ, সব কাজ আগে-ভাগে বুদ্ধি খাটিয়ে করতে হবে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের কেবল দুই বছর পাঁচ মাস চলছে। হেসেখেলে তাঁর আরও দুই বছর সাত মাস ক্ষমতায় থাকার কথা। তারপর আসবে নির্বাচন। সেই নির্বাচন সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শমতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেও হতে পারে, আবার রাষ্ট্রের গণপ্রজাতন্ত্রী চরিত্র ধরে রাখার জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে গঠিত সরকারের অধীনেও হতে পারে। কিন্তু এই মামলা তো এখনকার নয়। আরও দুই বছর পরের। দুই বছর পরেই এই প্রসঙ্গ আসতে পারত যে ছয় মাস পরে যে দেশে নির্বাচন হবে, সেটা কীভাবে করা যাবে, এই সরকারের অধীনে, নাকি সংবিধানের আগের রীতি অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। তখন বিরোধী দল বলত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই। তখন প্রশ্ন আসত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান কে হবেন, সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি নাকি অন্য কেউ? এই নিয়ে বিরোধ যে দেখা দিত, তা অবশ্যম্ভাবী। কারণ, দেশে আছে দুটি জোট, একটা সরকারি জোট, আরেকটা বিরোধী জোট, বিরোধী জোটের কাজই বিরোধিতা করা। তারা বিরোধিতা করবেই।
কিন্তু সরকারি জোটও কম যায় না। তারা রাজনীতির ভেতরে সব সময়ই একটা জিলিপির প্যাঁচ খেলে দেন। আর তাই নিয়ে বিরোধী দল ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকটা কান নিয়েছে চিলের মতো। সেই যে গল্প আছে না, আমি কিছুই করি নাই, একটু গুড় লাগিয়ে দিয়েছি মাত্র। তাতে কী হয়েছে? গুড়ের লোভে পিঁপড়া এসেছে, পিঁপড়া মারতে তেলাপোকা এসেছে, তেলাপোকা মারতে বিড়াল এসেছে, বিড়াল মারতে কুকুর এসেছে, কুকুর মারতে বিড়ালের মালিক এসেছে, কুকুর রক্ষা করতে কুকুরের মালিক এসেছে, তারপর এ-পাড়ার সবাই এক পক্ষ, ও-পাড়ার সবাই আরেক পক্ষ, তা থেকে কুরুক্ষেত্র।
শেখ হাসিনা কিছুই বলেননি, তিনি আইনের শাসনে বিশ্বাসী, সংবিধানের মহান রক্ষক সুপ্রিম কোর্টের আদেশ মানতে তিনি বাধ্য, সে কথাটাই মনে করিয়ে দিয়েছেন, আর তাতেই লেগে গেছে লঙ্কাকাণ্ড। বিরোধী দল হরতাল আহ্বান করেছে।
বিরোধী দল হরতাল আহ্বান করেছে, তাতে বাস পুড়েছে গোটা দশেক, ককটেল ফুটেছে কয়েক ডজন, একজন রিকশাচালক ককটেলের বারুদে পুড়ে কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে, আর কাতরাচ্ছে আমাদের মুমূর্ষু অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতির চাপে যার জিভ বের হয়ে আসার জোগাড় হয়েছে।
এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, শেখ হাসিনা কেন দুই বছর পরের হরতালটাকে দুই বছর আগে সেধে ডেকে আনলেন? ৬ জুন ২০১১ প্রকাশিত নিউ এজ-এর একটা খবর থেকে এই প্রশ্নের একটা উত্তর পাওয়া গেল। ঢাকার বাতাস পৃথিবীর সব বড় শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত। এর ফলে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষ এই শহরে অকালে প্রাণ হারাবে। ২০১১ সালের জানুয়ারি ১৩ থেকে ফেব্রুয়ারি ১৫ পর্যন্ত এই এক মাসের জরিপের ফলে দেখা যাচ্ছে, এই শহরের বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড আর নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে ঢের ঢের বেশি। এই খবরের উৎস হলো সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়।
এখন আমাদের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার। গত পরশু ছিল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ঢাকার বাতাসে যাতে ক্ষতিকর গ্যাস না থাকে, সে জন্য দরকার ছিল যানবাহন, কলকারখানা, অফিস-আদালত বন্ধ রাখা। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, আমরা তো আদালতের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারব না। তিনি জানতেন, এই কথা বললেই বিরোধী দল হরতাল ডেকে বসবে। তা-ই হলো। বিরোধী দল হরতাল ডাকল। ঢাকার রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা ছিল হরতালের দিন। ওই দিনই ছিল পরিবেশ দিবস। পরিবেশ দিবসে ঢাকার পরিবেশ ছিল অনাবিল সুন্দর।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে আমাদের আকুল আবেদন, আপনি এই রকমের বাণী আরও দিন। বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান, প্রধানমন্ত্রীর বাণী উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনারা হরতাল আহ্বান করুন। পরিবেশ বাঁচান। প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু কেবল হরতাল ডেকেই রোধ করা যায়।
শুধু দেখলাম, ফেসবুকে একজন নাগরিক দুঃখ প্রকাশ করেছেন, সরকারি দল কী চায় আমরা শুনছি, বিরোধী দল কী চায়, কী চায় না, তা-ও আমাদের জানা। কেবল, আমরা দেশের মানুষ, দেশের মালিক যারা, তারা কী চাই, কেউ শুনতে চাইল না!
দেশের মালিক আপনারা? আমজনতা? ধৃষ্টতা বৈকি! দেশের একজন নগণ্য নাগরিক নিজেকে দেশের মালিক বলে দাবি করেছে, এর প্রতিবাদে বিরোধী দল কি একটা হরতাল ডেকে বসতে পারে না? কিংবা তাকে ক্রসফায়ারে নেওয়া যায় না? সাহস কত! এই ধরনের বিষবৃক্ষ অঙ্কুরেই কি বিনষ্ট করে দেওয়া উচিত নয়?
-প্রিয় ডট কমের সৌজন্যে