৬৮ কারাগারে ৮৪হাজার বন্দির জন্য চিকিৎসক মাত্র ১০জন

এই বিপুল সংখ্যক বন্দির জন্য চিকিৎসক আছেন মাত্র ১০ জন। বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণ ক্ষমতা ৪শ’। বর্তমানে কয়েদি ও হাজতী মিলিয়ে সেখানে রাখা হচ্ছে প্রায় ১২শ’ বন্দিকে। কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে বিভিন্ন জেলা কারাগার থেকে দাগী আসামীদের পাঠানো হয় এ কারাগারে। বাকিদের আল্লাহর উপর ভরসা করে বন্দি জীবন পার করতে হচ্ছে। অনেক অসুস্থ বন্দি বিনা চিকিৎসায় গাদাগাদি করে কারাগারগুলোতে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এখানে চিকিৎসক থাকলেও চিকিৎসা দেয়ার কোনো যন্ত্রপাতি নেই। অসুস্থ কারাবন্দীকে দিনরাত শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা-নেয়ার কাজে ব্যস্ত কারারক্ষীরা। হাসপাতালের নীচতলায় স্থায়ী ভাবে খোলা হয়েছে প্রিজন সেল। সেখানে গড়ে ৮/১০ জন আসামী থাকছে। তারপরও চিকিৎসার অভাবে কারাগারে মারা যাচ্ছে বন্দিরা। অভিযোগ রয়েছে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা কারা হাসপাতালে থাকতে হলে কারা কর্তৃপক্ষকে উৎকোচ দিতে হয়। বিত্তবান বন্দি ছাড়া কেউ সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারছে না। এদের মধ্যে যাদের টাকা-পয়সা রয়েছে তারা অসুস্থ না হলেও উৎকোচের বিনিময়ে কারা হাসপাতালে মাসের পর মাস অবস্থান করছেন। সাধারণ গরীব, অসহায় বন্দিরা অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসার জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা।

কারাগার সূত্র জানায়, কারাহাসপাতালে কোনো পরীক্ষা-নীরিক্ষার যন্ত্রপাতি নেই। কারা হাসপাতালে যারা চিকিৎসাধীন থাকেন তারা নামেমাত্র অসুস্থ হয়ে এখানে ভর্তি হন। বন্দিদের অসুস্থতা পরিলক্ষিত হলেই কারাগারের বাইরের হাসপাতালগুলোতে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। গভীর রাতে কোনো বন্দি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। যানবাহন ও কারারক্ষী সংকটের পাশাপাশি কর্মকর্তাদের অলসতার কারণে এসব রোগীদের সকাল পর্যন্ত বন্দি অবস্থায়ই রাখা হয়। রাতে কারা চিকিৎসকের দেখা মিলে না। জরুরী চিকিৎসা শব্দটি অসুস্থ বন্দিদের কাছে স্বপ্নের মতো। যে কোনো সময়ে আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে কোনো বন্দি মারা গেলে কারা কর্তৃপক্ষের কিছুই যায় আসে না। কারা অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী গড়ে ৮ হাজার বন্দির জন্য একজন চিকিৎসক রয়েছে কারাগারগুলোতে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভাগীয় সদরে থাকা কারাগার ও কেন্দ্রীয় কারাগার মিলিয়ে মোট ১০টি কারাগারে চিকিৎসক রয়েছেন। বাকি সব কারাগারগুলোতে বন্দিদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন স্বাস্থ্য সহকারী ও ফার্মাসিস্টরা। অধিকাংশ জেলা কারাগারে বন্দিরা এসব ফার্মাসিস্ট ও স্বাস্থ্য সহকারীদের ডাক্তার হিসেবেই চিনেন ও জানেন। অথচ তারা সামান্য পেট ব্যাথা, ডায়রিয়া ও মাথাব্যাথা ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা দিতে অক্ষম। ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ-তিনগুণ বন্দি নিয়ে জেলা কারাগারের জরাজীর্ন স্যাতসেতে ভবনে বসবাসরত কয়েদীরা অসুস্থ হলে পাঠানো হয় শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

এ বিভাগের অধিনে থাকা জেলা কারাগার গুলো থেকে সরাসরি শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েদী কিংবা হাজতীদের চিকিৎসার জন্য ভর্তির নিয়ম নেই। এজন্য বন্দিদের বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রাথমিক ভাবে স্থানান্তর করা হয়। এখান থেকে আনুষ্ঠানিকতা সেরে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর হাজতী ও কয়েদীদের ভর্তি করা হয়। নানান আনুষ্ঠানিকতা সারতে গিয়ে জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজনীয় রোগীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে স্থানান্তর কিংবা হাসপাতালে নেয়ার পথে বন্দির মৃত্যু হয়ে থাকে। জটিল রোগে আক্রান্ত বন্দিদের বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। কারা কর্তৃপক্ষ নিজেরাই স্বীকার করেছেন দেশের কোনো কারাগারেই রোগ নির্নয়ের কোনো যন্ত্রপাতি নেই। এক্সরে, ইসিজি, ইকো, আলট্রাসনোগ্রাম, রক্ত ও প্রসাব পরীক্ষা করার মতো কোনো সাইন্টিফিক যন্ত্রপাতি কখনোই স্থাপন করা হয়নি। সে অনুযায়ী কারা হাসপাতালে নেই কোনো টেকনিশিয়ান। মাত্র ১০ জন চিকিৎসক দিয়ে চলছে এত বড় কারা সেক্টর। এই ১০ চিকিৎসক কারাগারের সেবা দেন অতিথি চিকিৎসক হিসেবে। অধিকাংশ সময় তারা নিজেদের প্রাইভেট ক্লিনিক ও চেম্বারে বাইরের রোগী দেখতে ব্যস্ত থাকেন। দিনে ২/১ বার কারা হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। মাঝে মধ্যে কোনো বন্দি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করলেও ডাক পড়ে এই কারা চিকিৎসকের। তিনি কারাগারে গিয়ে ঐ রোগীকে কোনো চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন না। শুধুমাত্র কোনো সরকারী হাসপাতালে ভর্তির জন্য একটি ছাড়পত্র দেয়াই তার প্রধান কাজ। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কারা অধিদপ্তরের ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার জানান, উল্লেখিত ১০জন চিকিৎসক দেশের বিভাগীয় কারাগারগুলোতে রয়েছেন। জেলা কারাগারগুলোতে সিভিল সার্জনরা বন্দিদের চিকিৎসা দেয়ার কথা থাকলে ব্যস্ততার জন্য তারা অনেক সময় কারা হাসপাতালে আসতে পারেন না। তাই অধিকাংশ সময় বন্দিদের হাসপাতালে পাঠানো হয়ে থাকে। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে চিকিৎসক, জনবলসহ কারাগারে যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। তাই কারাগারগুলোয় বন্দিদের চিকিৎসা সেবা কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। তবে বিনা চিকিৎসায় কোনো বন্দি মারা যাচ্ছে না বলে তিনি দাবী করেন।