নেত্রীগণ, দয়া করুন…

পরীক্ষার হলে বসছে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা। মধ্যরাতে পরীক্ষার হলে বসে শেষ রাতে হল থেকে বেরিয়ে কখন তারা বাড়ি ফিরবে, আর কখনই বা ঘুমুতে যাবে? বিমানবন্দরে এসে নেমেছেন যে যাত্রীরা, যাঁদের মধ্যে আছেন আমাদের প্রবাসী কর্মজীবী মানুষেরা, যাঁদের কষ্টার্জিত বিদেশি মুদ্রায় বাংলাদেশে আমরা টিকে আছি, এগিয়ে যাচ্ছি, তাঁরা বিশাল বিশাল বোঝা মাথায় নিয়ে হেঁটে হেঁটে চলেছেন গন্তব্যের দিকে, সংবাদপত্রের পাতায় এই ছবি দেখে চোখে জল আসে। ওই মানুষটির কথা একবার ভাবুন, তাঁর হয়ে। প্রবাসে, মধ্যপ্রাচ্যে কি ইউরোপে, কি পূর্ব এশিয়ায় গাধার খাটুনি খেটেছেন তাঁরা, একদিন বৃষ্টি হলে সেই বৃষ্টিতে ভিজেছেন, আর চোখের জল মিশিয়েছেন বৃষ্টির জলে, আহা রে আমার শ্যামল বাংলা, এখন কি বৃষ্টি হচ্ছে দেশে, গ্রামের বাড়ির টিনের চালে! ভেবেছেন, কবে দেশে ফিরতে পারবেন, যে দেশের কথা মনে পড়লেই মনের ভেতরটা হু হু করে ওঠে, সেই দেশের মাটিতে পা রেখে এই তাঁর প্রাপ্তি? মালামাল মাথায় তুলে হেঁটে হেঁটে অনিশ্চয়তার পথে হাঁটা।

কত মানুষের কত জরুরি কাজ থাকে। কারও বা অসুখ-বিসুখ, কারও বা অফিস-আদালতের কাজ, কারও বিদেশযাত্রা। কত জরুরি পণ্য বন্দর থেকে যাবে সারা দেশে, সারা দেশ থেকে যাবে বন্দরে। শহর থেকে যাবে গঞ্জে, গঞ্জ থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে আসবে শহরে। মাছের চালান পচছে নদীর ঘাটে, আমের চালান পচছে মহাসড়কে আটকা পড়ে। দোকানপাট বন্ধ, অর্থনীতির চাকা ঘুরছে না। কত ক্ষতি! কত ক্ষতি! বাংলাদেশটা দাঁড়িয়ে আছে একটা পথের মোড়ে, যার একদিকে আছে পতনের অন্ধকার খাদ, আরেক দিকে আছে উন্নতির শিখরে ওঠার বাস্তব সম্ভাবনা। আমরা কোন পথটাকে বেছে নেব? হরতালের পথ, সংঘাতের পথ, মারামারি-কাটাকাটির পথ আমাদের ঠেলে দেবে সর্বনাশের দিকে, সমূহ ধ্বংসের দিকে। অথচ আমরা স্বপ্ন দেখি একটা উন্নত আলোকিত বাংলাদেশের। আর দশ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের চেহারা পাল্টে যেতে পারে, এটা হয়ে উঠতে পারে একটা উন্নত শহর। দেশের মানুষের ভাগ্য পাল্টে যেতে পারে। আবার এই শহরটা হয়ে উঠতে পারে একটা পরিত্যক্ত নগর, একটা মৃত্যুপুরী। আমাদের সামনে বিকল্প মাত্র দুটো, হয় আমরা উন্নত হব, নয়তো আমরা ধ্বংস হব। হানাহানির পথ, হরতালের পথ আমাদের ধ্বংসের দিকেই কেবল ঠেলে দেবে। কাজেই আমরা হরতাল চাই না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা হরতাল চাই না। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, আমরা হরতাল চাই না।

তবে কথা হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও হরতাল চান না। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রীও হরতাল চান না। তাঁদের দুজনের অসংখ্য বচনামৃত আছে হরতালের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনার আছে, খালেদা জিয়ার আছে। তাহলে হরতাল হচ্ছে কেন? বিনা মেঘে কেন এই হরতাল-বজ্রপাত?

ব্যাপারটাও আমরা সবাই জানি। বিএনপি ও তার মিত্ররা আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের সরকারের অধীনে নির্বাচন মেনে নেবে না। এটাই বাস্তবতা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে রাষ্ট্রের গণপ্রজাতন্ত্রী চেতনার বিরোধী, এই কথাটা ১৯৯৫, ১৯৯৬ সালে অনেকবার বলেছেন বেগম খালেদা জিয়াই। তখন লাগাতার আন্দোলন দিয়ে শেখ হাসিনাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করে নিয়েছিলেন। সেই বিজয়কে জনগণের বিজয় আর সারা পৃথিবীর জন্য একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বলে তাঁরাই গৌরব করেছিলেন। আমাদের মতো কলামলেখকেরা তখন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। আজকে উচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানবিরোধী বলে ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী দুটো জাতীয় নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা যেতে পারে বলে আদালতের রায়েই সুযোগ রাখা হয়েছে। সেই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন এই মুহূর্তেই এ বিষয়ে এমন অচলাবস্থা তৈরি হবে যে দেশে ১২ ঘণ্টা হরতালের পিঠাপিঠি ৩৬ ঘণ্টা হরতালের ডাক এসে গেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায় নিশ্চয়ই যুক্তি আছে, যা অবৈধ, তাকে আর টেনে নেওয়া কেন! সে ক্ষেত্রে এই পাল্টা তর্কও তো পাড়া যায়, তাহলে এত দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচনগুলো হলো, তার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারও অবৈধ হয়ে যায় কি না। আর এই অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা এত আন্দোলন-সংগ্রামই বা করেছিলাম কেন?

এই সরকারের মেয়াদ এখনো আড়াই বছর রয়ে গেছে। নির্বাচন তো ঢের দেরি। এখনই এই বিষয় নিয়ে পানি ঘোলা না করে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার পরিচালনার দিকে মনোযোগ দেওয়াই ছিল কাম্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও আমরা এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৪৮ ঘণ্টা হরতালের স্টিমরোলার দুর্বল অর্থনীতির দেশটির ওপর দিয়ে চালিয়ে দিলাম। এবং আশঙ্কা হচ্ছে, কোনো রকমের মীমাংসা হবে না, আগামী আড়াই বছর মারামারি-কাটাকাটিই আমরা করতে থাকব। তার পরিণতি কী হবে? অর্থনীতির পরিণাম কী হবে? শিক্ষাদীক্ষার অবস্থা কী দাঁড়াবে? গণতন্ত্রের পরিণতি কী হবে? নেতানেত্রীদের পরিণতি কী হবে? দেশের ভাগ্য কোথায় গিয়ে ঠেকবে?

এই মহা আশঙ্কার মধ্যে দেশের মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কাজেই আমাদের নেতানেত্রীদের শুভবোধের কাছে, বিবেকের কাছে আমাদের আকুল আবেদন, সংঘাতের পথ ছেড়ে দিন। ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করুন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন, দেশের মানুষ আপনাকে নির্বাচিত করে ক্ষমতায় বসিয়েছে, দেশের মানুষকে ভালো রাখার ও তাদের ভবিষ্যৎকে আশঙ্কামুক্ত রাখার প্রধান দায়িত্ব আপনার ওপরই। গোস্সা করা বিরোধী দলের সাজে। সরকারের পক্ষে বুদ্ধিমত্তা ও মুনশিয়ানার পরিচয় হলো, মীমাংসার পথ রচনা করা। ফয়সালার দিকে যাওয়া। হরতাল দেশের জন্য ভয়াবহ রকমের ক্ষতিকর, এ কথা বুঝিয়ে কোনো দিনও কোনো বিরোধী দলকেই হরতাল ডাকা থেকে নিরত করা যায়নি। সেটা আওয়ামী লীগই হোক, আর বিএনপিই হোক। আমরা আর হরতালের দিনগুলোয়, রাজপথে হানাহানির দিনগুলোয় ফিরে যেতে চাই না। মোটের ওপর দেশ তো ভালোই চলছিল। ছয় শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েই চলেছে। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে অনেক বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার সুফল আমরা পেতে শুরু করেছি। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। গ্যাস ও জ্বালানিবিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত নিয়ে নেওয়া দরকার। ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধানে নানামুখী প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নততর হওয়া, বন্দর ঠিকভাবে পরিচালিত হওয়া, বিদ্যুৎ পানি গ্যাস জ্বালানির সরবরাহ ঠিক রাখা, সার কৃষিপণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখা, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি—এই কটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অগ্রগতি হলে দেশ এগিয়ে যাবেই। অর্থনীতি উন্নততর হবেই। তখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতেও অগ্রগতি হতে বাধ্য। এর সঙ্গে দরকার সুশাসন, দুর্নীতিমুক্তি, মানবাধিকার। এই তো আমাদের অগ্রাধিকার তালিকা। এর মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য রচনা ও হানাহানির সুযোগ কই? হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ দেশ চাই, চাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এসব বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি হলে এই মহাজোট সরকার পরের মেয়াদে নির্বাচিত হবে না, এই দুর্ভাবনা আড়াই বছরের মাথায় আসবে কেন?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসমেত সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রতি আমাদের আকুল আবেদন, জনগণকে হরতালের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া থেকে বাঁচান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতার বাস্তব উদ্যোগ নিন। দেশের মানুষ আপনাদের প্রাণভরে দোয়া করবে। গণতন্ত্রে জনগণের শুভেচ্ছাই রাজনৈতিক দলের প্রধান শক্তি। সেই জনগণের ওপরই যেন নেতারা ভরসা রাখেন। আওয়ামী লীগকে মনে করা হয় আমজনতার দল। জনগণের মনের ভাষা নাকি সবচেয়ে ভালো পড়তে পারে আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি জনগণের ওপর ভরসা না করে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর না করে বেসামরিক-সামরিক অবসরপ্রাপ্ত পরামর্শক, বিশেষজ্ঞ, এজেন্সির ওপর বেশি নির্ভরতা দেখায়, তাহলে মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আওয়ামী লীগের মতো আন্দোলন-সংগ্রামে অভিজ্ঞ জেল-জুলম নিপীড়ন সহ্যকারী দলের নেতৃত্বকে এ কথা বলাই বাহুল্য যে রাজনৈতিক সংঘাত বা আন্দোলন কোনো আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যায় না, রাজনৈতিকভাবেই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান খুঁজে পেতে হয়। হরতালের বিরুদ্ধে কঠোর পুলিশি ব্যবস্থা আরও হরতালই কেবল ডেকে আনে। সেই কারণেই আমরা চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছি। আমাদের বাঁচাতে সরকার পক্ষ ও বিরোধী পক্ষ উভয়েই এগিয়ে আসুন। দয়া করুন। লাগাতার আন্দোলন-সংগ্রামের হুমকিতে পাবলিকের আত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। শিল আর নোড়ার ঘষাঘষিতে দেশের ভবিষ্যৎ নামক মরিচের জীবন যে যায় যায়!

-প্রিয় ডটকম