গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ হলো হরতালের আগের দিনের অপরাহ্ন ও সন্ধ্যাটি। হরতালকে এখন দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। প্রথম ভাগ হরতালের আগের দিনের সাঁঝবেলাটি। দ্বিতীয় ভাগ হরতালের আসল দিনটি। আরও একটি পর্ব আছে, সেটি হরতালের সন্ধ্যাবেলা। ওই সন্ধ্যাটি হরতাল আহ্বানকারী বিরোধী দল এবং হরতাল অপছন্দকারী সরকারের পক্ষ থেকে হরতালের সফলতা ও ব্যর্থতা বিষয়ে বাহাস। এক পক্ষের বক্তব্য: হরতাল সফল। আরেক পক্ষের রায়: হরতালে জনগণ সাড়া দেয়নি।
বিবাহ অনুষ্ঠানের যেমন তিনটি পর্ব: গায়েহলুদ, বিয়ের অনুষ্ঠান ও বৌভাত; তেমনি হরতালেরও তিনটি পর্ব: হরতালের আগের বিকেল ও সন্ধ্যা, মূল হরতালের দিন বা দিনগুলো এবং হরতাল-উত্তর বাগ্যুদ্ধ। তবে হরতালের দিনটির চেয়ে তার আগের দিনের সন্ধ্যাটির কথা ভাবলে সাধারণ মানুষ, বাসমালিক ও প্রাইভেট এবং গাড়িওয়ালাদের রক্ত হিম হয়ে যায়।
কিছুকাল ধরে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা পাকিস্তানের সেই ২২ পরিবারের মতো অথবা সম্পদে তারা তাদেরও ছাড়িয়ে গেছে। সে জন্য এখন বিয়ের অনুষ্ঠানটির চেয়েও গায়েহলুদের অনুষ্ঠানটি জাঁকজমকের সঙ্গে হয়। কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নেওয়া হয়। হাজার খানেক অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। যে খানাপিনা হয়, তা ব্রিটিশ রাজপরিবারের ভোজসভার চেয়ে নিম্নমানের নয়। তারপর মধ্যরাতে বর ও কনেপক্ষের বাড়ির ছাদ উত্তাল হয়ে ওঠে। চার বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ওই রাতে কুম্ভকর্ণের পক্ষেও ঘুমানো সম্ভব নয়।
হরতালের পূর্ববর্তী সন্ধ্যাটিকে আমরা বলতে পারি হরতালের গায়েহলুদ। বিয়ের গায়েহলুদে হয় আনন্দ-উল্লাস আর হরতালপূর্ব সন্ধ্যাটিতে নগরবাসীর জীবনে নেমে আসে আতঙ্কের কালো ছায়া। পায়ে-চলা মানুষেরা জানে না, কখন কোন গলির ভেতর থেকে আবির্ভূত হবে একদল মানুষ। ফাটাবে হাতবোমা। গাড়িতে চলা মানুষেরা জানে না, ‘জ্বালো জ্বালো’ বলে কিছু লোক হঠাৎ ছুটে এসে সত্যি সত্যি জ্বালিয়ে দেবে তাদের মোটরগাড়ি ও বাস। পেট্রল-দেশলাই না থাকলে ইট দিয়ে চুরমার করবে গাড়ি।
চারদলীয় জোট সরকারের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ঘন ঘনই হরতাল ডাকত। একবার হরতালের আগের সন্ধ্যায় গানপাউডার দিয়ে ডবলডেকার বাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে পুড়ে কয়লা হয় বহু যাত্রী। মানুষের মৃত্যুতে কারও করুণা হলো না। ঝগড়া বেধে গেল আগুনের জন্য কে দায়ী, তা নিয়ে।
ষাটের দশকে হরতাল ছিল বড় রাজনৈতিক ঘটনা। তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। সহিংসতাও হতো হরতাল আহ্বানকারীদের পক্ষ থেকে। নিপীড়ন হতো সরকারের দিক থেকে। প্রাণও যেত। আহত হতো অসংখ্য। জেলে যেতেন বহু নেতা-কর্মী। নেতাদের মুক্তির দাবিতে আবার আধাবেলা হরতাল ডাকা হতো।
হরতালের অনেক সংস্করণ হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে হরতাল-সংস্কৃতিতে। প্রথম দিকে হরতালের ঘোষণা দিয়ে নেতারা বসে থাকতেন। বড়জোর পথের মোড়ে সমাবেশ করতেন। হাটবাজারে কানেস্তারা টিন বাজিয়ে ঘোষণা দেওয়া হতো: ভাইসব, আগামী মঙ্গলবার সকাল-সন্ধ্যা…। শহরে মাইকে সারা দিন ভাইসব ভাইসব করা হতো। এখন কাগজে, রেডিওতে ও টিভি চ্যানেলে ব্যাপক প্রচার হয়। তার পরও নেতারা রাস্তায় নামেন।
এতকাল দেখা যেত কবিরাজি ঔষধালয়ের অব্যর্থ দাওয়াই ও ধন্বন্তরি চিকিৎসার লিফলেট দুস্থ নারী-পুরুষ পথচারীদের মধ্যে বিতরণ করতে। এখন হরতাল আহ্বানকারী দলের নেতারা একইভাবে পথচারীদের হাতে হরতালের সপক্ষে নসিহত করা প্রচারপত্র ধরিয়ে দেন। যেন ওটি পড়েই পথচারী সিদ্ধান্ত নেবেন—হরতাল পালন করতেই হবে।
গত দশকে আওয়ামী লীগ অনাগত হরতাল আহ্বানকারীদের একটি কার্যসিদ্ধমূলক উপায় শিখিয়ে দিয়ে গেছে। যেকোনো দিন হরতাল ডাকলে হবে না। হরতাল ডাকতে হবে সাপ্তাহিক ছুটির হয় আগের দিন অথবা পরের দিন। যাতে হরতাল ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে গোটা চারেক দিন উপভোগ করা যায়। বাড়িতে বাবার অসুখ। ছুটি চাইলে বস ছুটি দেন না। বিশ্বাস করেন না যে বাবা বাতের ব্যথায় ভুগছেন ৪০ বছর ধরে। হরতাল হলে চার দিনের জন্য বাড়ি যাওয়া যায়। দুর্নীতির মতো ফাঁকিবাজিতেও বাঙালি চ্যাম্পিয়ন। সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে হরতাল, তাই সরকার-সমর্থকদের কাছেও আজ উপভোগ্য। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম ব্যাহত করতে কারসাজির শেষ নেই।
বিরোধী দল হরতাল ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমতাসীন দল হাহাকার করতে থাকে। প্রতিপক্ষ চিত্তহরণকারী কর্মকাণ্ড শুরু করার আগেই সরকারি দলের নেতারা আস্তিন গোটাতে থাকেন। কে হরতাল পালন করবে আর কে করবে না, তা তার গণতান্ত্রিক অধিকার। বেশি ধরপাকড়ে সরকারের স্নায়বিক দুর্বলতা ধরা পড়ে। সরকার দমননীতির আশ্রয় নিচ্ছে, বিরোধী দলের এই অভিযোগ যে অমূলক নয় তা প্রমাণিত হয়।
আগে এ দেশের মানুষ হরতাল করেছে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে। তারপর পাকিস্তান আমলে ভাষার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, স্বায়ত্তশাসনের জন্য, স্বাধিকারের জন্য এবং স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীনতার পরে হরতাল হয়েছে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য। এখন হরতাল কেন—তা মানুষ সুস্পষ্টভাবে জানে না। আজ হরতাল কারও কাছে আতঙ্কের—কারও কাছে উপভোগের।
-প্রিয় ডটকম