রুমানা মঞ্জুর এবং আমরা

বছর তিনেক হলো, তার সাথে পরিচয়। অতীব সুন্দরী মেয়ে। ফেসবুকে তার ছবি দেখলে, অনেকেরই মাথা খারাপ হবে। ফেসবুকে অনেক ভূয়া একাউন্ট থাকে। সে যখন আমাকে প্রথম ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট পাঠায়, ভূয়া একাউন্ট ভেবে অনেক দিন সেটা আমি এক্সেপ্ট করিনি। আমার রিকোয়েষ্ট বক্সে আরো অজস্র রিকোয়েষ্টের সাথে ওটাও পরে থাকলো।

কিন্তু কিছুদিন পর, সে আমাকে ম্যাসেজ পাঠালো এই বলে যে, সে ভূয়া কোনও মানুষ নয়, তার একাউন্টটি সত্যি। সে আমাকে কিছু বলতে চায়। আমি তার রিকোয়েষ্ট এক্সেপ্ট করি। এবং তার কথা শুনতে থাকি। সময়ে বন্ধুত্বে দূরত্ব বাড়ে, আবার সময়ে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। ওর সাথে গাঢ়ত্ব বাড়তে থাকে। সে তার অতি ব্যক্তিগত কিছু কথা আমাকে জানায়, এবং আমার পরামর্শ চায়। আমিও আমার কিছু একান্ত কথা তার সাথে শেয়ার করি।

এবারে পাঠকদের জন্য দুটো প্রশ্ন করতে চাই-

১. ফারাহ তার ব্যক্তিগত জীবনের যে কথাগুলো আমাকে বিশ্বাস করে বলেছে, সেটা কি আমার স্ত্রীকে বলা ঠিক হবে?

২. আমি যে কথাগুলো ফারাহকে বলেছি, সেটা কি তার স্বামীর সাথে শেয়ার করা তার উচিৎ হবে?

উত্তরগুলো ভাবতে থাকুন। এই ফাঁকে আমি মূল লেখায় চলে যাই। লেখার শেষ প্রান্তে উত্তরগুলো দিয়ে দিব।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুর তার স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়ে চোঁখ হারাতে বসেছেন। তার চুক্তিবদ্ধ স্বামীটি পশুর মতো ঝাপিয়ে পড়ে মেয়েটির নাক কামড়ে ছিড়ে ফেলেছে। অত্যাচারের নমুনা থেকে মুটামুটি ধারনা করা যায় যে, অবস্থা আরো খারাপের দিকে যেতে পারতো। রুমানা প্রাণে বেঁচে আছে, সেটাই যেন অনেকটা সান্তনার বিষয়। ও আজকে বেঁচে না থাকলে (যা খুব অস্বাভাবিক নয়), আমাকে লেখাটি অন্যভাবে লিখতে হতো।

আমি যখন মেয়েটির ভিডিও দেখি, আমার দু'চোখ বেয়ে তখন টপটপ করে পানি পড়ছে। ভিডিওটি দ্বিতীয় বার দেখার মতো সাহস আমার হয়নি। আমি সত্যি সত্যি আর কখনই প্লে-বাটনটি চাপিনি। বিষয়টি আমাকে এতই ত্বারিত করলো যে, আমি আমার সমস্ত কাজ ফেলে, এটার পেছনে লেগে পরলাম। এবং কিছুক্ষনের ভেতরই ফেসবুকের কল্যানে মেয়েটির এবং ছেলেটির পরিবারের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হলো। তার সাথে ফেসবুকে জমা হতে থাকলো অজস্র কমেন্টস। মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ঝাপিয়ে পড়লো। বিভিন্ন ফোরাম এবং "পেজে" এটা নিয়ে মত প্রকাশ চলতে থাকলো আগুনের ফুলকির মতো।

হাসান সাঈদ সুমন নামের সেই লোকটিকে আজ পুলিশ আটক করতে পেরেছে। তাতে আমাদের আলোচনা কমছে না; বরং বাড়ছে। পেছনের ঘটনা নিয়ে আমি লিখতে বসিনি। আমার লেখার মূল বিষয় হলো, মানুষের চিন্তার জায়গাটাকে একটু সাহায্য করা। ফেসবুকে কিছু কিছু মানুষের মত প্রকাশ এবং তাদের চিন্তা-চেতনা দেখে আমি হতভম্ব। আমি বুঝতে পারছিলাম না, এটা কি ২০১১ সাল, নাকি ৫০০ সাল যখন আরবে মেয়েদেরকে মাটিতে জীবন্ত পুতে ফেলা হতো!

আমি গত দুটো দিন ধরে ভাবছিলাম, এই দেড় হাজার বছরে কতটা এগিয়েছে পৃথিবী?! আর কত হাজার বছর পার হলে, আমরা সভ্য হবো!?

সেই সব মন্তব্যের কিছু উত্তর না দিলেই নয়। আমি চেষ্টা করছি, কিছু বেসিক বিষয়ের অবতারণা করতে। দেখা যাক, কতটা পারি।

ক). প্রথমেই কেউ কেউ রিএ্যাকশন দেখালেন এভাবে – ডাল মে ক্যুছ কালা হ্যায়। যার অর্থ হলো, নিশ্চই মেয়েটি এমন কিছু করেছে, যে কারণে স্বামীটি এমন খর্গ হস্তে আভির্ভূত হয়েছেন।

তাদের জন্য উত্তর হলো – আপনি একজন মানসিক রোগী। সেজন্য আপনার মাথায় প্রথমেই এমন একটি চিন্তা এসেছে; এবং সেটা পাবলিক ফোরামে প্রকাশ করেছেন। আপনার মতো এমন অসুস্থ্যতা নিয়ে আমাদের চারপাশে অনেক দু'পায়ী জীব ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং আপনি এতটাই অসুস্থ্য যে, আমার লেখা পড়ে আপনার সেই রোগ ঠিক হবে না। তাই আমার বাকি লেখাটুকু পড়ার প্রয়োজন নেই। আমি উপরে যে গল্পটা অর্ধেক বলে রেখেছি, আপনি বরং ওটা নিয়ে ভাবুন। অনেক রঙ্গিন জিনিস পত্র দেখতে পাবেন।

খ). আরেক দল আছেন যারা মনে করছেন, মেয়েটি কেন এতোদিন এমন একটি ছেলেটির সাথে ছিল। তাই মেয়েটিরই দোষ। এখন ভোগ করো শাস্তি।

আমরা বাংলাদেশে মেয়েদেরকে যেভাবে বড় করি, যেভাবে গড়ে তুলি, তাতে কয়টা মেয়ের পক্ষে সম্ভব সংসার ছেড়ে চলে যাওয়া? সে পিএইচডি করুক, আর হাই স্কুল পাশ করুক – বাস্তবতা হলো এই যে, আমরা ছোট বেলা থেকেই মেয়েদের মাথার ভেতর কিছু জিনিস এমনভাবে ইনপ্লান্ট করে দেই, সেটা সে সারা জীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারে না। তার সেই সাহস আমরা ছোট বেলাতেই মেরে ফেলেছি। সেই সাহস সঞ্চয় করতে হলে, তাকে অনেক বেশি সাহসী মানুষ হতে হবে। ছোট বেলায় কারো পা ভেঙ্গে দিলে, সেই ভাঙ্গা পাঁয়ে আর কতটা দৌড়ানো যায়! রুমানাও ব্যতিক্রম নয়। সে-ও আমাদের সমাজে বেড়ে ওঠা একজন নারী। সেও হয়তো নানান কারণে ভেঙ্গে আসতে পারেনি সেই অচলায়তন। কিন্তু তাই বলে কি তার এই শাস্তি ভোগ করতে হবে? অবশ্যই না।

গ). হাসান একটি নোংরা গল্প ফেঁদেছে, যা দিয়ে আমাদের সমাজে একটি মেয়েকে খুব সহজেই কাবু করা যায়। শুধু মেয়েটিকে নয়, মেয়ের পরিবার, বন্ধু বান্ধব এবং আশেপাশের সবাইকে ধরাশায়ী করা যায় – সেটা হলো, মেয়েটির নামে একটি কুৎসা রটনা করা।

আমাদের বাঙালী কুৎসা পেলে এমনভাবে গিলতে থাকি, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমরা শুয়রের চেয়েও অধম প্রাণী – মলমুত্র থেকেও খুব সুন্দর খাবার সংগ্রহ করতে পারি। বত্রিশ দাঁত বের করে লাজ-লজ্জার পরোয়া না করে, রসিয়ে রসিয়ে বলতে থাকি, "আগেই বলেছিলাম; দেখলে তো এবার। তলে তলে কত কিছু।"

যারা এমনটি ভাবছেন, এবং মত প্রকাশ করছেন, তাদের জন্য বলছি – আপনিও অসুস্থ্য; তবে আমার লেখার নীচের অংশটুকু পড়লে আপনার একটু উন্নতি হলেও হতে পারে; কারণ আপনার জন্ম ভুল করে এই শতাব্দিতে হয়ে গেছে। আসলে আপনার জন্ম হওয়ার কথা আরো দেড় হাজার বছর আগে।

আপনি এখনো একটি নারীকে মানুষ ভাবতে শিখেননি – আপনার ভেতর এখনো তারা মেয়ে মানুষ; তাদেরকে বাজার থেকে দাম দিয়ে কিনে এনে ঘরে বন্দি করে রাখা যায়। তারপর ইচ্ছে মতো ঘরের বাসন-কুশনের মতো ব্যবহার করা যায়। যতদিন না, আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন, নারীও একটি মানুষ, ততদিন আপনার এই আউটলুক ঠিক হবে না। আপনার নিজের জন্য, আপনার পরিবারের জন্য এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য হলেও আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করুন – নারীরা একজন মানুষ। আমার আপনার মতো একজন পরিপূঙ্গ মানুষ।

যখনই আপনি নারীকে একজন মানুষ ভাবতে পারবেন, তখন আপনার চিন্তাগুলো অনেক সহজ হবে। যুক্তির পাখাগুলো অনেক বেশি মেলে ধরতে পারবেন। আপনি মেয়েদেরকে সন্মান করতে শিখবেন। আর যখনই একটি মানুষকে আপনি সন্মান করবেন, তখন তার প্রতি ব্যবহার ভিন্ন হবে – সেটা বাড়ির কাজের বুয়াই হোক, আর আপনার গার্ল ফ্রেন্ডই হোক, কিংবা লিভিং পার্টনার হোক, নয়তো বিবাহিত স্ত্রীই হোক।

প্রথমেই আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে, তারা মানুষ। আর যখুনি, আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করবেন, আপনি একটি মানুষের সাথে কথা বলছেন, একজন মানুষ সম্পর্কে কথা বলছেন – তখুনি আপনার ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ্যনীয় হবে। আপনি তখন যা-তা ভাবতে এবং প্রকাশ করতে সংকোচ বোধ করবেন। আর যদি সেটা না আসে, বুঝতে হবে আপনি মানুষ হিসেবে খুবই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি প্রাণী – আপনার মানসিক অবস্থান বানর বা শিম্পাঞ্জী থেকে এখনও ততটা উন্নত হয়নি।

এই পৃথিবী নামক গ্রহের প্রতিটি প্রাণীই একেকটি সত্তা। আমি, আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে, আমার বন্ধুরা, আমার পাঠক – সবাই একেকটি আলাদা সত্তা। আমরা কেউ কারো মালিক নই। আমরা কেউ কারো প্রভু নই। আমি আমার জীবন নিয়ে এই গ্রহে এসেছি, আমি আমার জীবনকে শেষ করে এই গ্রহ থেকে চলে যাবো। চলতি পথে কারো কারো সাথে আমাদের উঠাবসা হবে, ভালোবাসা হবে, বিরহ হবে, অভিমান হবে, রাগ হবে – কিন্তু তাই বলে আমরা একজন আরেক জনের উপর চড়াও হবার অধিকার নেই। যার জীবন, তার জীবন। আপনি যদি আজকে মনে করেন, আপনি ডাল দিয়ে ভাত খাবেন, সেটা যেমন আপনার সিদ্ধান্ত, ঠিক তেমনি ভাবে আপনি যদি মনে করেন, আজকে নদীতে গোসল করবেন – সেটাও আপনার সিদ্ধান্ত। আমরা শুধু বলতে পারি, নদীতে  কুমির থাকতে পারে। কিন্তু আমরা আপনার সিদ্ধান্তকে বাঁধা দিতে পারি না। মানুষ হিসাবে আপনার চিন্তা এরকমই হতে হবে। তখুনি আপনাকে একজন মানুষ বলা যাবে, তার আগে নয়। তার আগ পর্যন্ত আপনার অবস্থান শিম্পাঞ্জী আর মানুষের মাঝামাঝি কোনও এক অবস্থানে।

রুমানা যা-ই করে থাকুক (যদিও এগুলোর কোনও ভিত্তি নেই), যা ইচ্ছা তাই— হাসানের এক বিন্দু অধিকার নেই তার গায়ে হাত তোলার। এক বিন্দুও না। রুমানার কোনও কাজে যদি হাসান বিরক্ত হয়, সেটা সে রুমানাকে বলতে পারে। তারপরেও যদি সেটা মানতে না পারে, তাহলে তাকে ছেড়ে যাবে – কিন্তু গায়ে হাত তোলার ক্ষমতা সে কোথায় পেলো? এই প্রভুত্ব তাকে কে দিয়েছে? পুরুষত্ব? নাকি একটি কাবিননামার স্বাক্ষর? (যার বিনিময়ে একটি নারীকে সহসাই কিনে ফেলা যায়)।

হাসান যা করেছে, তা যে কোন বিচারে চরম অপরাধ। এবং তাকে সেই বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে। যারা হাসানকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করছেন, দয়া করে সেটা আর করবেন না। তাতে আপনিও সেই অপরাধের ভাগী হবেন।

ঘ). আমি আরেকটা বিষয় দেখে খুব মর্মাহত হয়েছি – কিছু মেয়ে হাসানের হয়ে যুক্তি-তর্কে নেমেছেন। তারা হাসানকে সমর্থন করছেন।

আমি জানি না, স্রষ্ট্রা তাদেরকে কী দিয়ে তৈরী করেছেন। তবে আমি এটা জানি, তাদের লেখাপড়া, জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছুতে ক্ষুদ্রতা দিয়ে ভরা। সেই নোংরা মানুষগুলোর জন্য কী-বোর্ডের বোতাম চাঁপতে আর ইচ্ছে করছে না। সাধারন পাঠকদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা দয়া করে এইসকল মানুষ থেকে দূরে থাকবেন। এবং এরা যেন তাদের নোংরামী দিয়ে সবাইকে কুলসিত না করে, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। তাদের সাথে বিতর্কে গিয়ে, কাঁদাটাকে চারিদিকে ছড়াবেন না।

ঙ.) পরিশেষে আরেকটি কথা না বললেই নয়। আমরা অনেকেই হাতে কী-বোর্ড পেলে আর খালি একটা জায়গা পেলে মনের মাধুরী (আসলে নোংরামী) মিশিয়ে যা ইচ্ছা তাই লিখে যাই। পাবলিক ফোরামে কিছু লিখবার আগে, দয়া করে একটু ভেবে নিবেন। নিজেকে নোংরাভাবে সবার সামনে তুলে ধরার তো কোন প্রয়োজন নেই। আপনার ভেতরের নোংরামীটা আপনার ভেতরই থাকুক। অন্যদের একটু সুস্থ্য থাকতে দিন।

 

৩.

বলেছিলাম, লেখার শেষে আমার প্রথমাংশের দুটো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাবো। উত্তর দুটো হলো – "না"।

ফারাহ আমাকে বিশ্বাস করে যে ব্যক্তিগত কথাগুলো আমাকে বলেছে, সেটা সে কেবল আমাকেই বলেছে। আমার কোনও অধিকার নেই, সেটা দ্বিতীয় আর কারো সাথে শেয়ার করার। সেটা হতে পারে আমার স্ত্রী কিংবা মা-বাবা, কিংবা ছেলে-মেয়ে। ফারাহ আমাকে সেই অনুমতি দেয়নি। একইভাবে, আমি যে কথাগুলো ফারাহকে বলেছিলাম, আমিও তাকে কোন অনুমতি দেইনি সেগুলো অন্য কারো সাথে শেয়ার করার।

এখানে আমরা কোনও চুক্তিতে আবদ্ধ হইনি। কিন্তু এই অলিখিত চুক্তি ভাঙ্গাটা একটি অন্যায়। আপনি যখন এই চুক্তিটি ভাঙবেন, তখন আপনি আর মানুষ নেই। সভ্যতার মাপকাঠিতে আপনার অবস্থান অনেক নীচে। কীট-পতঙ্গেরও জীবন থাকে। আপনারও একটি জীবন আছে। পার্থক্য কি?

নিজেকে যখন মানুষ ভাববেন, তাহলে মানুষের মতো ব্যবহার করতে শিখবেন। হাসানের মতো নয়।

 

ফাইন প্রিন্ট:
গল্পটা যদি আমি ফারাহকে নিয়ে না বলে, ফরহাদকে নিয়ে বলতাম, তাহলে কি ভিন্ন হতো? আপনার চিন্তাটি কি ভিন্নভাবে প্রবাহিত হতো? আপনি কি ফেসবুকে আমার ফ্রেন্ডলিষ্টে ফারাহ নামের কাউকে খুঁজতে শুরু করেছেন?


জাকারিয়া স্বপন, স্যান্টা কারা, ক্যালিফোর্নিয়া