দেশের সর্বনাশ করতে আ:লীগ ও বিএনপি উভয়েই সর্বদা সক্রিয়

যেভাবে সাম্রাজ্যবাদী গ্যাস কোম্পানির কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করছে, তার বিরুদ্ধে এরা একটি বাক্যও বলে না, এর কোন প্রতিবাদ তারা করে না। এর বিরুদ্ধে হরতাল জরুরি হলেও তারা এর ধারে কাছে যায় না। তারা এমন বিষয় নিয়ে হরতাল দিচ্ছে, যার সঙ্গে জনগণের কোন সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে শুধু তাদের নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারটি। এবং ক্ষমতায় যাওয়ার অর্থ এদের কাছে অবাধ লুটপাট ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এই লুটপাটের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোন শত্র“তা নেই!

১৬ জুন ২০১১ বাংলাদেশ সরকার মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে দুটি ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের ব্যাপারে প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট, পিএসসি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ঢাকার কারওয়ানবাজারের পেট্রো সেন্টারে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, এই মর্মে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের জানান। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় সেখানে সরকারের অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। গত ২৩ মে অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে এ চুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই এখন এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হল।

সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল ও তাদের পদলেহনকারী দুনিয়ার অনেক পশ্চাৎপদ দেশেই সাম্রাজ্যবাদীরা দেশীয় শাসকদের সঙ্গে যোগসাজশে ও লেনদেনের মাধ্যমে সেসব দেশের সম্পদ লুটপাট করে থাকে। কিন্তু এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মতো আর কোন দেশ আছে কিনা সন্দেহ। কারণ এদেশের শাসকশ্রেণীর প্রত্যেকটি সরকার দেশের সম্পদ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার করার জন্য যেভাবে উদগ্রীব থাকে এরকম আর কোথাও দেখা যায় না। এদের এমনই চরিত্র, এরা জনগণের সর্বনাশ করে দেশের সম্পদ বাইরে পাচার করে, নিজেদের পকেট ভর্তি করা ও ধনসম্পদ অর্জন করার জন্য এমন কিছু অপকর্ম এবং দেশবিরোধী-জনবিরোধী কাজ নেই যা করা থেকে বিরত থাকে। উপরন্তু এই লুটপাটের সুযোগ তারা নিজেরাই সৃষ্টি করে এবং সুযোগ হাতের কাছে আসামাত্র তার পূর্ণ ব্যবহার করে। বাংলাদেশের গ্যাসসম্পদের প্রশ্নেও দলমত নির্বিশেষে আমরা প্রত্যেকটি সরকারের ক্ষেত্রেই এটা দেখে আসছি।

নব্বইয়ের দশকে বিএনপি সরকারের সময় বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রকে ভূমিতে ২৩টি ব্লক ও বঙ্গোপসাগরে ২৮টি ব্লকে ভাগ করার পর ভূমির ৫টি ব্লক তারা বাইরের কোম্পানিকে ইজারা দিয়েছিল। এ কোম্পানিগুলোর মধ্যে ছিল মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল। তাদের দেয়া সিলেটের মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন এক দুর্ঘটনা ঘটে। সেই দুর্ঘটনায় পরিবেশের নিদারুণ ক্ষতিসহ এর পরিমাণ দাঁড়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অক্সিডেন্টাল এই ক্ষতিপূরণ সরকারকে না দিয়ে নিজেদের কোম্পানি ইউনিকলকে বিক্রি করে দিয়ে চলে যায়। ক্ষতিপূরণ না দিয়ে এভাবে অন্য কোম্পানিকে গ্যাসক্ষেত্র ইজারা বিক্রি করে দেয়া সরকারের নাকের ডগাতেই হয়েছিল। ইউনিকল মাগুরছড়া বিস্ফোরণের কোন দায়ভার গ্রহণ না করে ও ক্ষতিপূরণ না দিয়ে গ্যাসক্ষেত্র আরেকটি আমেরিকান কোম্পানি শেভরনকে বিক্রি করে চলে যায়। আজ পর্যন্ত এই শেভরন কোম্পানিও মাগুরছড়ার বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকারকে কিছুই দেয়নি এবং সেটা না দিয়েও তাদের কাজকারবার নির্বিঘ্নেই চালিয়ে যাচ্ছে।

এরপর বিএনপি সরকার সিলেটের ট্যাংরাটিলায় কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকোকে একটি গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দেয়। এই গ্যাসক্ষেত্রে মাগুরছড়ার মতোই এক প্রচণ্ড ও ধ্বংসাÍক বিস্ফোরণ ঘটে ২০০৩ সালে বিএনপির সরকারের আমলে। এতে যে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল, তার কোন ক্ষতিপূরণ নাইকো আজ পর্যন্ত দেয়নি। এ সত্ত্বেও তারা বেশ নিশ্চিন্তেই এখনও পর্যন্ত নিজেদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশী শাসকশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে লুটপাট শেয়ারিং কিভাবে করে যাচ্ছে, এসবই হল তার একেকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।

আজ পর্যন্ত একের পর এক বাংলাদেশ সরকার যেভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশ ও জনগণের প্রকৃত ক্ষতিসাধন, এমনকি সর্বনাশ করছে তা এই গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দেয়া এবং এগুলো তাদের দায়িত্বহীনভাবে পরিচালনার সুযোগ-সুবিধা করে দেয়া থেকে খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার মধ্যে না গিয়ে এই মুহূর্তে বঙ্গোপসাগরে ১০ ও ১১ নম্বর ব্লক মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপসকে ইজারা দেয়ার যে ব্যবস্থা করেছে সরকার, সে ব্যাপারে ফিরে এসে বলা যায়, এর মাধ্যমে নতুন করে সেই পুরনো ও পূর্ববর্তী ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদীদের লুটপাটের সহযোগী হিসেবে বর্তমান সরকার যে চুক্তি কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে করেছে, তাতে তারা এই দুই ক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত গ্যাসের ৮০ শতাংশ রফতানি করতে পারবে। বাংলাদেশকে তাদের দিতে হবে মাত্র ২০ শতাংশ। সরকার পক্ষে অর্থমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাসহ অন্যরা বলছেন, কনোকো ফিলিপসের থেকে বাংলাদেশ যদি পুরো গ্যাস নিতে চায় তাহলে বাংলাদেশকেই অগ্রাধিকার দেয়া হবে এবং বাইরে রফতানি করা হবে না। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ যতটা নিতে পারে ততটা তাকে দিয়েই বাকি অংশ রফতানি করা হবে। কিন্তু এসবই হল মুখের কথা। চুক্তিতে এ ধরনের কিছু নেই। সেখানে শুধু আছে এ কথা যে, বাংলাদেশকে ২০ শতাংশ বিক্রি করতে হবে।

এক্ষেত্রেও এমন এক মস্ত ফাঁকি এবং সরকারের বেঈমানীর ব্যাপার আছে, যা সরকারি বাগাড়ম্বর ও প্রতারণাপূর্ণ কথাবার্তার মধ্যে অনুল্লেখিতই থাকে। কথাটি হল এই যে, বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরের গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস দেশে ব্যবহারের জন্য নিয়ে আসতে হলে বাংলাদেশকেই পাইপলাইন তৈরি করতে হবে! আমেরিকান কোম্পানি গ্যাস বাংলাদেশে পৌঁছে দেয়ার কোন ব্যবস্থা করবে না!! এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে যে গ্যাস তোলা হবে, তার পুরো অংশই কনোকো ফিলিপস রফতানি করতে পারবে এবং বাংলাদেশ এই গ্যাসের সামান্য অংশও ব্যবহার করতে পারবে না। বাংলাদেশ যে সংকটজনক জ্বালানি পরিস্থিতিতে রয়েছে তাতে নিজেদের দেশের গ্যাসও যে তাদের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না এর থেকে বিপজ্জনক ব্যাপার আর কী হতে পারে? এ ব্যাপারটি ঘটছে বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ সম্মতিক্রমেই।

এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং চুক্তি সই হলেও দেশের স্বার্থবিরোধী-জনবিরোধী এই চুক্তি বাতিলের জন্য সর্বস্তরের জনগণের এগিয়ে আসা আজ এক জরুরি কর্তব্য। এটা জরুরি এ কারণে যে, দেশের সম্পদ যেভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার করা হচ্ছে, সেটা যদি প্রতিরোধ করা না হয় তাহলে পরবর্তীকালে এ একই ব্যাপারের পুনরাবৃত্তি হবে এবং বাকি গ্যাসক্ষেত্রগুলোও এভাবে বেঈমান দেশীয় লোকজন ও সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে দেশের বাইরে চালান করবে। এই কাজ যে শুধু শাসকশ্রেণীর বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারই করছে তাই নয়, এটা বিএনপিও আগে করেছে। ভবিষ্যতেও সুযোগ পেলে করবে এবং প্রথমে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে শত্র“তা থাকলেও এ বিষয়ে কোন বিরোধিতা করছে না। কিভাবে নিজেরা তাড়াতাড়ি ক্ষমতায় যাবে তার ফন্দিফিকিরেই তারা ব্যস্ত আছে। এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তারা হরতালের পর হরতাল দিচ্ছে। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সম্পদ জনগণের সঙ্গে বেঈমানী করে যেভাবে সাম্রাজ্যবাদী গ্যাস কোম্পানির কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করছে, তার বিরুদ্ধে এরা একটি বাক্যও বলে না, এর কোন প্রতিবাদ তারা করে না। এর বিরুদ্ধে হরতাল জরুরি হলেও তারা এর ধারে কাছে যায় না। তারা এমন বিষয় নিয়ে হরতাল দিচ্ছে, যার সঙ্গে জনগণের কোন সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে শুধু তাদের নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারটি। এবং ক্ষমতায় যাওয়ার অর্থ এদের কাছে অবাধ লুটপাট ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এই লুটপাটের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোন শত্র“তা নেই! এক্ষেত্রে তারা পরস্পরের বুবুজান ও ভাইজান!! এই ভাইজানরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি থেকে দেশের হাজারও সমস্যা নিয়ে চিন্তিত নয়। তারা এর মোকাবেলার জন্য কিছুই করে না। এ নিয়ে তারা হাত ধরাধরি করে চলে। কারণ বাসভাড়া বৃদ্ধি, সব রকম নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি, দেশের নিরপরাধ লোকজন খুনখারাবি ইত্যাদির সঙ্গে এরা দলমত নির্বিশেষে সবাই জড়িত। বঙ্গোপসাগরের গ্যাসক্ষেত্র আওয়ামী লীগ এভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানি কনোকা ফিলিপসকে ইজারা দেয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের পরম শত্র“ হিসেবে বিএনপি যে নীরব আছে, এর এটাই হল ব্যাখ্যা। এরা উভয়েই সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে একইভাবে স্বার্থের গাঁটছড়ায় বাঁধা। এই বন্ধনে আবদ্ধ থেকে এরা একইভাবে দেশের ও জনগণের সর্বনাশ করার জন্য সর্বদাই প্রস্তুত, সর্বদাই সক্রিয়!

-প্রিয় ডটকম