ভুলের মধ্যে কে? হাসিনা নাকি খালেদা?

গোয়েন্দা সংস্থা- ডিজিএফআইর প্রধান পদে নিয়োগ করেছেন। অথচ খালেদা জিয়ার কাছে খবর আছে, উনি নাকি বিএনপির লোক। আর তাই তার খালাত ভাই শরীফ শাহ কামাল তাজকে নিয়োগ করা হয়েছে বিএনপির তথ্য প্রযুক্তি সম্পাদক পদে এবং এখন খালেদার সার্বক্ষণিক সহচর। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কে ভুলের মধ্যে আছেন- হাসিনা, নাকি খালেদা?

বিশ্বস্ততা ও যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালকের গুরুত্বপূর্ন পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০০১-৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির ৫ বছর ডিজিএফআই প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমী। তিনি পুরো পাঁচ বছর দায়িত্বে থেকে ডঃ ইয়াজউদ্দিনের কেয়ারটেকার কাল পর্যন্ত ছিলেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী জেনারেল মইনের অভ্যুত্থানের প্রাক্কালে মেজর জেনারেল সাদিক একটি অফিসিয়াল ট্যুরের নাম করে লন্ডনে গিয়ে সরে থাকেন। তার সকল দায়িত্ব পালন করেন ব্রিগেডিয়ার বারী। এই বারীকে একজন মেজর থেকে তুলে এনে পর পর পদোন্নতি দিয়ে ব্রিগেডিয়ার করা হয় এবং ডিজিএফআইর গুরুত্বপূর্ন পদ সিআইবি-র পরিচালক বানানো হয়। ব্রিগেডিয়ার বারীকে দিয়েই জেনারেল মইন ১/১১র যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করান। সেনা নিয়ন্ত্রিত জরুরী সরকারের আমলে দোর্দন্ড প্রতাপে দেশ চালিয়ে মইনের জন্য রাজণীতি নিয়ন্ত্রনের অপচেষ্টা করেন বারী। কিংস পার্টি গঠন করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। কোটি কোটি টাকা লুটপাটের জন্য হাজার হাজার মানুষকে অত্যাচার নির্যাতন করে বারীর দল। ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারায় ২০০৮ সালের মাঝামাঝি জেনারেল মাসুদের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে পদচ্যুত হন ব্রিগেডিয়ার বারী এবং পোষ্টিং নেন ওয়াশিংটন মিশনে সামরিক এটাশের।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্রিগেডিয়ার বারীর স্থলে বসানো হয় কর্নেল শেখ খালেদ মামুনকে। তিনি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার বাসিন্দা, আর বড় হয়েছেন খুলনার জোড়াকল বাজার এলাকায়। এই ব্রিগেডিয়ার মামুনকে দিয়েই জেনারেল মইন নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামীলীগের ঘরে জমা দেন, এবং বিএনপিসহ চার দলীয় জোটকে দেয়া হয় ৩০টি আসন- যা ছিলো পূর্বপরিকল্পিত। জানা গেছে, শেখ হেলালের মামাবাড়ি সুত্রের আত্মীয় শেখ মামুন খালেদ। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে ২০০৯ সালে খালেদ মামুনকে ব্রিগেডিয়ার পদে এবং ২০১০ সালে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেন।

অন্যদিকে ২০০৭ সালের রাজনৈতিক দুর্যোগের মধ্যে খালেদ মামুন তার খালাতো ভাই শরীফ শাহ কামাল তাজকে ঢুকিয়ে দেন খুলনা বিএনপিতে। ২০০৭-৮ সালে দেশের ক্ষমতা পূর্নভাবে দখল করার জন্য ডিজিএফআই সারাদেশ থেকে ৬০০ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে, যার মধ্যে আস্থাভাজন ৩০০ জনকে শর্তসাপেক্ষে বিভিন্ন দলের ব্যানারে সংসদ নির্বাচন করানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। নবাগত এসব ব্যক্তিরা রাজনীতিক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, আমলা, পেশাজীবী, ও ব্যবসায়ী ছিল। গুলশানে ভাড়া করা বাড়িতে এসব লোকের সমাবেশে ব্রিগেডিয়ার বারী রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতেন। শরীফ শাহ কামাল তাজ ঐ ৩০০ জন নবাগত প্রুপের একজন। ঐসময় রাজনীতি করা ছিল নিষিদ্ধ, এমনকি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছিলেন কারাগারে। তখন সরকারের সহযোগিতা নিয়ে তরুন তাজ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সেবামূলক কর্মকান্ডের নামে খুলনার রাজনীতিতে সক্রিয় হন-  এবং নির্বাচন প্রার্থী হবার প্রচারণা শুরু করেন। এসময় তাজকে দেখা যায়, বিভিন্ন স্কুল-কলেজে প্রধান অতিথি হিসাবে পুরস্কার বিতরন করতে, যেখানে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে থাকতে হতো বিশেষ অতিথি। সামরিক গোয়েন্দা সিআইবি প্রধান খালাত ভাই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মামুনের প্রভাব ও নির্দেশেই তাজকে এলাকায় ঐ হাই-প্রোফাইল দেয় প্রশাসন। শুধু তাই নয়, ভাইয়ের প্রভাবে তাজ নানা ব্যবসা বানিজ্য ও কমিশন বাবদ প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা উপায় করেন বলে ঘনিষ্টজনরা জানান।

১৯৮৭ সালে খুলনা কমার্স কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ বানিজ্যের ছাত্রটি বিএনপির কাছে পরিচয় দেয় আইটি বিশেষজ্ঞ বলে। যদিও আমেরিকায় জেসিপেনি নামক দোকানে কাজ করার অভিজ্ঞতাই যে একমাত্র আইটি জ্ঞান, তা অনেকের কাছেই জানা। পেশায় মার্কেটিং ব্যবসায়ী এবং Market Access Providers Limited (MAPL) এর কর্নধার। বাড়ি খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলায়, মুল বাড়ি গোপালগঞ্জে। চলচ্চিত্র জগতে সুপরিচিত শাহ কামাল তাজ, ২০০৯ সালে- সুপার হিরো সুপার হিরোইন- বিজয়ীদের নাম ঘোষণা ও পুরস্কার প্রদান করে বিশেষভাবে আলোচিত হন।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রুপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা-৪ আসনে তাজকে বিএনপির দলীয় প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দেয়া হয়-  প্রবীন নেতা সাবেক এমপি এম নুরুল ইসলাম দাদুকে বাদ দিয়ে। এ নিয়ে খুলনার নেতাদের অভিযোগ, ডিজিএফআইয়ের চাপেই পরীক্ষিত নেতাদের বঞ্ছিত করে বিএনপির কনফার্ম সীটে তাজকে নমিনেশন দেয়া হয়। তাজের পরিবারের লোকজন সকলেই আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত বলেও অভিযোগে প্রকাশ। ১/১১র পরে তাজের হঠাৎ উত্থানে খুলনা জেলা বিএনপির মধ্যে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে জেলা বিএনপির আহবায়ক মাজেদুল ইসলাম এবং হঠাৎ বনে যাওয়া যুগ্ম-আহবায়ক শরীফ শাহ কামাল তাজের পকেটের লোক দিয়ে কমিটি গঠনের প্রতিবাদে তুমুল আন্দোলন করে স্থানীয় বিএনপি ২০০৯ সালের শেষ দিকে। এ নিয়ে মানববন্ধন এবং মাজেদ-তাজের কুশপুত্তলিকা দাহ, অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা, এমনকি হরতালও পালিত হয়। সংবাদ সম্মেলন করে খুলনা জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা মাজেদ-তাজের কারণে খুলনা বিএনপি ধ্বংস হতে চলেছে বলে অভিযোগ করেন।

পয়সাওয়ালা তাজ সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় বিএনপির তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদ লাভ করেন ২০০৯ সালের কমিটিতে। তারও আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২ কোটি টাকার বিনিময়ে ও ডিজিএফআই লিষ্টেডে নমিনেশন নেন। আজকাল খুলনা শহরের প্রায় সবাই জানে, তাজ খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের বন্ধু এবং একসাথে পড়াশোনা করেছে। পার্টিতে প্রচুর ডোনেট করেছে। শুধু এতেই ক্ষান্ত হয়নি, বিএনপির প্রভাবশালী ভাইস চেয়ারম্যান শমশের মবিনকে মাসে ২ লাখ টাকা বেতনে নিজ ফার্মে চাকরী দিয়ে খুব শক্ত ভাবেই জেঁকে বসেন তাজ। সম্প্রতি বৃটেন ও আমেরিকা সফরের সকল ব্যয় বহন করার শর্তে তাজকে অফিসিয়াল টীম মেম্বার করেন শমশের মবিন। এমনকি সেখানকার বার ও হোটেলের সকল খরচ বহন করেন তাজ। ঐ সফরে তাজের বিশেষ এজেন্সি মিশন ছিলো বলে জানা যায়, যা তিনি সফলভাবেই সম্পন্ন করেন। সফরের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা থেকে শুরু করে খুটিনাটি পর্যন্ত অবহিত করেন গোয়েন্দা বিভাগকে। এ সময়ে তাজ দলীয় চেয়ারপারসনের আরো বিশ্বস্ত হন বলে শোনা গেছে। ঢাকায় ফিরে প্রচার করা হচ্ছে, তাজ নাকি খালেদা ও তারেকের যথেষ্ট আস্থাভাজন!

২০০৮ সালে বিএনপি চেয়ারপার্সনের জন্য গুলশানের ৮৬ নম্বর রোডে একটি অফিস নেয়া হয়। বিভিন্ন ব্যবস্থায় এ ভবনটিকে চেয়ারপারসনের জন্য সুরক্ষিত ও গোপনীয় করা হয়। খালেদা জিয়ার কাছে অনেকদিন থেকেই মনে হয়েছে, ঐ ভবনটি এখন আর নিরাপদ নেই। ওখানকার খবরাখবর খুব দ্রুততার সাথে সরকারের কাছে চলে যাচ্ছে। অনেকদিন থেকেই লক্ষ করা গেছে, বিএনপির গুরুত্বপূর্ন আলোচনা ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গেই সরকারের প্রতিক্রিয়া ও কঠোর ব্যবস্থা শুরু হয়ে যায়। এরপর থেকেই দলের নীতিনির্ধারকরা ‍সন্দেহ করতে থাকেন- খালেদা জিয়ার তাবৎ কর্মকান্ড যে কোনো উপায়ে সরকার জেনে যাচ্ছে। ডেইলী স্টার সাম্প্রতিক একটি ঘটনা রিপোর্ট করে। ঘটনাটি খালেদা জিয়ার কাছেই ধরা পড়ে। এতে দেখা যায়, গত ৩৬ ঘন্টার হরতালের সিদ্ধান্তটি খালেদা জিয়া ৯ জুন তারিখে সিদ্ধান্ত নেন তার ঘনিষ্ট সহকারীদের সাথে পরামর্শ করে, যা স্টান্ডিং কমিটির সদস্যরা জানতেন না। ‍কিন্তু সহকারীদের মধ্য থেকে কেউ ঐ সংবাদটি মিডিয়ায় ফাঁস করে দেয় সাথে সাথেই। এ নিয়ে বেগম জিয়া মহা ক্ষুব্ধ হন বলে পত্রিকাটি লিখেছে। জানা যায়, ২০০৯ সালেই গুলশানস্থ বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে দোতলার একটি বৃহ‍দ কক্ষে বেশ কিছু কম্পিউটার ও যন্ত্রপাতি নিয়ে তথ্য সেল খোলা হয়। ওই তথ্য সেলের একক কতৃত্বে আছেন শাহ কামাল তাজ। কৌশলে খালেদা জিয়াকে দিয়ে সেটি উদ্বোধনও করানো হয়। অভিযোগ উঠছে- গুলশান অফিসে একান্তে যত আলাপ করেন খালেদা, তার সবটাই এ কক্ষ থেকে উচ্চ প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিএফআই তথা সরকার মনিটর করে থাকে। গুলশানে খালেদার বাসা ও অফিসে এ সকল উচ্চ প্রযুক্তি স্থাপনের প্রয়োজনীয় ওয়ারিং ও মেরামত নিজস্ব তদারকিতে সম্পন্ন করা হয় বলে জানা গেছে। সম্প্রতি গুলশান অফিসে এক ব্যক্তি বেগম জিয়ার সাথে একান্তে কথা বলে বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই একজন সহকারী চার্জ করে বসেন, কেন এসব বলে এসেছেন। একথা শুনে সাক্ষাৎপ্রার্থীটি রীতিমত হতবাক হয়ে যান। এই হলো বেগম জিয়ার ‍অফিসের গোপনীয়তার হাল।

শরীফ তাজের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য একজন বিশেষ সহকারীর মাধ্যমে অনেক আগেই বেগম জিয়াকে জানানো হয়, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মামুন বেগম জিয়ার বিশেষ ভক্ত এবং বিএনপির লোক। তাহলে প্রশ্ন উঠে, শেখ হাসিনা তাহলে কি বিএনপির অনুগত একজন জেনারেলকে ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক নিয়োগ করলেন? নাকি বেগম জিয়া ডিজিএফআইয়ের লোক নিয়ে সাথে ঘুরছেন?  নাকি দু’জনেই বোকা, আর ধুর্ত শাহ কামাল তাজ এবং তার ভাই?