জাতীয় বাজেট ২০১১-২০১২ স্টেপসের এর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া

এবারের বাজেটে নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। গত বছরের ১০টি মন্ত্রণালয়ের স্থলে এবার ২০টি মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছে। এ জন্যে স্টেপস্ টুয়ার্ডস্ ডেভেলপমেন্ট সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। সেই সঙ্গে আমরা মনে করি জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে আগের বছরে নারী উন্নয়ন ও নারী-পুরুষ বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কতটা অগ্রগতি হয়েছে তার বিশ্লেষণ থাকা দরকার। এর পাশাপাশি আগামী অর্থ বছরের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক খাতসমূহ চিহ্নিত করা এবং সেসব খাতে কতটুকু অর্জন করতে চাই তার সুনির্দিষ্ট টার্গেট নির্ধারণ করা জরুরি। এবারের জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে নতুন যেসব মন্ত্রণালয় যুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তথ্য, ভূমি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। ২০১১-১২ অর্থ বছরের বাজেটে জেন্ডার প্রেক্ষিতে লক্ষণীয় কিছু বিষয় হচ্ছে:

১.    ঝরে পড়া রোধকল্পে ৭ থেকে ১৪ বৎসর বয়সী দরিদ্র শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার জন্য ৬ টি বিভাগীয় শহর এবং নির্বাচিত ৮৯টি উপজেলায় ২৬ হাজার ৬৪৬ টি শিখন কেন্দ্রে ৯ লাখ ১৬ হাজার শিশুর শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। আশা করা যায় এক্ষেত্রে ৫০ ভাগ আসনে মেয়ে শিশুরা ভর্তির সুযোগ লাভ করবে।  

২.    পুষ্টি কার্যক্রম এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নের লক্ষে সারা দেশে ৯৭টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র,  ৩ হাজার ৯০০টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ৩০ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক মা, শিশু ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কার্যক্রমে আগামী ৫ বৎসরের জন্য সরকার ২৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এ বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যবহৃত হলে তা উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। এতে মা ও শিশু মৃত্যু হার আরও কমিয়ে আনা সম্ভব যা এমডিজি’র লক্ষ অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
৩.    ২০১১-১২ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য তিন ধাপে মোট ১৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী জনসংখ্যার তুলনায় এই বরাদ্দ খুবই কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ। উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে নারীরা বেশি উপেক্ষিত।   
৪.    নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে নারী অধিকার, জেন্ডার সমতা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেটে বিশেষ জোর দেয়ার কথা বলা হয়েছে যা নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
৫.    কৃষকদের প্রশিক্ষণে ৫০% নারী অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি কৃষক ক্লাব ও বিপণন দলে নারীদের সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কৃষি উপকরণ, উন্নত বীজ, ভর্তুকি ও ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা গেলে তা কৃষক হিসেবে নারীদের স্বীকৃতি আদায়ে সহায়ক হোতো। উল্লেখ্য যে, গ্রামীণ নারীদের প্রায় ৭০ শতাংশই বিভিন্নভাবে কৃষি কাজে নিযুক্ত।
৬.    বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সামাজিক বনায়নের ওপর প্রশিক্ষণের ১৫০০০ উপকারভোগীর মধ্যে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডরষফষরভব ংঁৎাবু রহ ঃযব ঈযরঃঃধমড়হম যরষষ ঃৎধপঃং শীর্ষক প্রকল্পের সার্ভে কার্যক্রমে স্থানীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মহিলা কাজ করবে।
৭.    স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় ১০০% জন্ম নিবন্ধীকরণের লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে যা নারীর আইনগত অধিকার নিশ্চিত ও বাল্য বিয়ে রোধে সহায়ক হবে।
৮.    বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বাজেটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কেন্দ্রের কার্যক্রমে নারীদের সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ শ্রম বাজারে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে।
৯.    ২০১১-১২ সালের বাজেটে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুকুলে ১ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে উন্নয়ন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬১ কোটি টাকা এবং অনুন্নয় ব্যয় ৭৫ কোটি টাকা। ২০১০-১১ সালের বাজেটে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৪০ কোটি যার মধ্যে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল ২০৯ কোটি টাকা।
১০.    বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের জন্য দুঃস্থ ভাতা ৩৩১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা, হতদরিদ্র মায়েদের স্বাস্থ্য পুষ্টি এবং নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য ৪২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা (সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৮০ হাজার থেকে ৯২ হাজারে উন্নীত করা), শহরের অঞ্চলে কর্মজীবী দরিদ্র মায়েদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা বাবদ ৩২ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা, এসিডদগ্ধ মহিলা ও শারীরিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন ও মহিলাদের আত্ম-কর্মসংস্থান তহবিলে ১১ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

স্টেপস্ টুয়ার্ডস্ ডেভেলপমেন্ট ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটের বিস্তারিত জেন্ডার বিশ্লেষণ খুব শীঘ্রই মতবিনিময়ের মাধ্যমে জনগনের সামনে তুলে ধরা হবে।

লেখক: রঞ্জন কর্মকার, নির্বাহী পরিচালক, স্টেপস্ টুয়ার্ডস্ ডেভেলপমেন্ট।