উন্নয়নের থাবায় হারিয়ে যাচ্ছে বরিশালের পুকুর-নদী-খাল

আর উজার করা সৌন্দর্য দেখে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ লিখেছেন ‘তোমার যেখানে সাধ চলে যা- আমি এই বাংলার পরে রয়ে যাব’। জীবনানন্দ যে বাংলায় থাকতে চেয়েছিলেন সেই বাংলা প্রকৃতির ছবিটি দৃশ্যপট থেকে ধূয়ে মুছে গেছে। ধান-নদী-খাল আর নারিকেল সুপারির সবুজ দ্বীপ বরিশাল থেকে নদী-খাল-জলাশয়ের চিহ্ন মুছে যেতে বসেছে। এঁকে বেঁকে যে খালগুলি ছিলো নগরীর জন ও পণ্য পরিবহণের অন্যতম মাধ্যম তার কবর রচিত হয়েছে। এখন যা দুয়েকটি অবশিষ্ট রয়েছে তাকে খাল বলার উপায় নেই মোটেই। নগরীর বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়ে সে নিজেই এখন পরিবেশ দূষন করছে। অবৈধ দখলদারদের কারণে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে বরিশালের নদী-খাল-পুকুর। ফলে হুমকীর মুখে রয়েছে দেশীয় প্রজাতির নানান মাছ ও জলজ প্রাণী।

কীর্তণখোলা নদী আজ দখলদারের বন্ধনে হাস ফাস করছে। শিল্প সৃষ্ট দূষণের কারণে কীর্তণখোলায় কেমিক্যাল দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নগরী সংলগ্ন বৃহৎ দীঘি দূর্গাসাগর আজও মনোরম স্থান হলেও এই দীঘিটি ১৯৭৩ সালের পর আর কোন খনন বা উন্নয়ন হয়নি। ১৯৯৬ সালে এটিকে পাখিদের অভয়ারণ্য ঘোষনা করা হলেও এখানে নানা উপদ্রবে অতিথি পাখিরা আর আসছে না। বরিশাল নগরীর সর্বত্র পানির জল ও মৎস্য চাষের জন্য শত শত বছর আগেই দীঘি, পুকুর, খনন করা হয়েছিলো। অনেক দয়ালু সমাজ হিতৈষী, জমিদার, রাজন্যবর্গ, জনসাধারণের পানীয় জলতেষ্টা নিবারণের চেষ্টায় বা অনেক ক্ষেত্রে নিজ কীর্তিকে ধরে রাখতে দীঘি খনন করেছিলেন। চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশ নেই, তাদের প্রাসাদও মিশে গেছে ভূমিতে। কিন্তু রানী দূর্গাবর্তী খননকৃত দূর্গাসাগর আজও সেই রাজত্বের ইতিহাস বহন করছে।

এমনিভাবে সমাজ হিতৈষী উইলিয়াম কেরীর পালিত কন্যা বিবি জান্নাত জনসাধারণের পানীয় জল সংরক্ষণের জন্য যে বিবির তালেব (তালেব ফার্সী শব্দ, যার অর্থ পুকুর) খনন করেছিলেন তাই আজকের বিবির পুকুর নামে দুশো বছরের ইতিহাস ধারণ করে আছে। এমনিভাবে সাধক ও মানব কল্যাণে উৎসর্গকৃত ছবি খাঁ গৌরনদী-আগৈলঝাড়া অঞ্চলে বহু দীঘি খনন করেছিলেন। এমনিভাবে গজনীরদীঘিও অতীত স্মৃতি বহন করে। কিন্তু কালের বিবর্তনে এসব বিখ্যাত দীঘি ও জলাশয় টিকে গেলেও উন্নয়নের থাবায়, পরিবেশ সম্পর্কে অসচেতনতায়, অত্যাধিক জনসংখ্যাহেতু বাসস্থানের চাপের জন্য নগরীর অধিকাংশ পুকুর জলাশয় ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। গত এক দশকের মধ্যেই, এক সময়ের খাল-নদী-পুকুরের শহর বরিশাল থেকে এসব প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট জলাধারগুলো খুব দ্রুত হারিয়ে গেছে। তাই স্রোতস্বিনী নদী ক্রমশ দূষিত, ভরাট হচ্ছে। পুকুর, দীঘি ভরাট হয়ে উঠেছে, মার্কেট, স্কুল, কলেজ, শিক্ষাবোর্ড, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা কার্যালয় প্রভৃতি। আমাদের চোখের সামনেই শ্যামল বরিশাল কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে মানবসৃষ্ট লোভের মাশুল দিতে জলাশয়গুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। উদ্যান-জলাশয়-নদী খাল না থাকলে বরিশালের মতো নদী বিধ্যেত অঞ্চলটিতে পানির স্তর বহু নীচে নেমে যেতে পারে।

মহানগর ঢাকায় যা বাস্তব সমস্যা। তাছাড়া বাতাসে কার্বনের অস্তিত্ব বেড়ে গিয়ে বায়ুদূষণ ও পরিবেশ উত্তপ্ত করতে পারে। সর্বোপরি জলাশয়গুলো ঘিরে অসংখ্য জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব আমাদের ইকো সিস্টেমকে টিকিয়ে রেখেছিলো। এগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুধুমাত্র মৎস্য সম্পদ কমবে না অতিক্ষুদ্র থেকে বড় ধরণের জলজ প্রাণীর অভাবে পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। ভূ-গর্ভস্থিত পানি উত্তোলন করে পানীয় জল, চাষাবাদে লাগানো হয়। জলাশয়গুলির পানি মাটিতে আবার সেই পরিমাণে পানি প্রবেশ করিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখে। জলাশয়ের ভরাট প্রক্রিয়া তাই মাটির স্তর নামিয়ে দেয়। বলতে গেলে জলাশয় ভরাট আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। জেল খাল ও সাগরদী খাল বাদে অন্যসব খালের মধ্যে অধিকাংশের মৃত্যু হয়েছে। এখন জীবনানন্দ সড়কের (বগুড়া রোড) পাশে কোথাও কোথাও খালের বাধানো ঘাট সেই খালের অস্তিত্ব জানান দেয়। বরিশালের বগুড়া খাল, বটতলা খাল আর কোনদিন ফিরে আসবে না। জেলা পরিষদের পাকা ড্রেন ও স্টলের নীচে বটতলা খাল চিরদিনের মত ঘুমিয়ে আছে। এখনও প্রবীণ মানুষেরা যারা এই খাল দিয়ে নৌকায় কড়াপুর, শিকারপুরসহ গ্রাম দেশে যাতায়াত করেছিলেন তারা বেঁচে আছেন। তাদের কাছে এই খাল স্মৃতি হয়ে আরো কিছুদিন বেঁচে বর্তে থাকবে। ভাটার খাল তার খালের সকল বৈশিষ্ট্য লুপ্ত করে বেঁচে আছে ভাটার খালের বস্তি হিসেবে নামকরণের মধ্য দিয়ে। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বজরা ১৯০৬ সালে এই ভাটার খাল পর্যন্ত এসেছিলো।

নগরীর শোভা রানীর খাল অবৈধ দখলদারদের কড়াল গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে বড় বড় অট্টালিকা। অন্য যে খালটি চিরতরে শেষ হয়েছে সেটি মলাগিরি খাল। এই খালে বাঁধ দিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান, বাজার দোকানপাট গড়ে তোলেন। অন্যান্য খালগুলির অস্তিত্ব একেবারে শেষ পর্যায়ে। খালগুলির মধ্যে শুধুমাত্র ভাটার খাল, শোভা রানীর খাল, জেল খাল, নাপতার খাল,  সিটি কর্পোরেশনের। বরিশাল নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে ১০টি করে পুকুরের হিসাব ধরলে অন্তত ৩শ’ ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরের অস্তিত্ব থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তব সত্য এর এক তৃতীয়াংশও নেই। খোদ কাউনিয়া ব্রাঞ্চ রোডের এক রাস্তাতেই ৬টি পুকুরের অস্তিত্ব ছিলো। এখন এর অনেকগুলিই নেই। কাউনিয়া ক্লাব রোড এক সময়ে ৬টি পুকুর থাকলেও এখন মাত্র ১টি টিকে রয়েছে। পুকুর ভরাট হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মার্কেট, শিক্ষাবোর্ড, আনসার কার্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। নিম্নে বেশ কিছু পুকুর ও ভরাটকারী প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হলো, বঙ্গবন্ধু উদ্যানের পুকুর ভড়াট করে মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, কাউনিয়া ব্রাঞ্চ রোডের পুকুর ভড়াট করে শের-ই-বাংলা দিবা ও নৈশ্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে অবস্থিত দীঘি ভড়াট করে আনসার ভিডিপি কার্যালয় ও ইউনিসেফ স্কুল, সদর রোড ফকির বাড়ি মুখ সংলগ্ন পুকুর ভড়াট করে পৌর সুপার মার্কেট, নতুন বাজার পুকুর ভড়াট করে কালি মন্দির নির্মাণ করা হয়, বাজার রোডের পুকুর ভড়াট করে খাজা মঈন উদ্দিন মাদ্রাসা, মুনসুর কোয়ার্টার ওয়াক্ফ এস্টেট পুকুর ভড়াট করে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন, কাশিপুর লেক ভড়াট করে নির্মাণ করা হয়েছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড, নিউ সার্কুলার রোডের পুকুর ভড়াট করে নির্মাণ করা হয়েছে হার্ড ফাউন্ডেশন, মেডিকেল কলেজ লেন কুপুর ভড়াট করে ১১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কে এম শহিদুল্লাহ নির্মাণ করেছেন প্রাসাদময় বাড়ি। মহানগরী বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের পৌর এলাকায় প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ আইন ২০০০  আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনের ৫নং ধারায় বলা হয়েছে প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেনী পরিবর্তন করা যাবে না।  উক্তরূপ জায়গা অন্য কোনভাবে ব্যবহার করা যাবে না।

পানি আমাদের জীবন, জলাশায়গুলো আমাদের আশ্রয়, জীবন ও খাদ্যের সংস্থান, আমাদের দেহের ফুসফুস যেমন সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি জলাশায়গুলো পরিবেশের ফুসফুস স্বরূপ। এ ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ সময় জলাশয় নদী-খালের বরিশাল থাকলেও আজ হতশ্রী অবস্থা। নদী ভরাট করে এমনকি ক্যামিকেল দূষণও বাড়ছে। দূষণের ফলে খালের পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। যা জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার সকল সম্ভাবনা শেষ করে দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে খাল দখল, পুকুর ভরাট বরিশালের পরিকল্পিত নগরায়নের জন্য চরম হুমকি স্বরূপ। যদি পরিকল্পিত আমরা সকলে বাস করতে চাই, তাহলে প্রকৃতি ও জলাদারগুলো রক্ষা করতে হবে।

এ ব্যাপারে বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আসাদুল হক জানান, তার ক্ষোভের কথা। পরিবেশ আইন আছে, কিন্তু আমরা পর্যাপ্ত জনবল না থাকার কারণে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারছি না। যখনই আমরা শুনি কোন যায়গায় পুকুর খাল দখল কিংবা ভরাট হচ্ছে তখন তামরা তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে গিয়ে দখলদারদের বোঝাতে চেষ্টা করি। যদি না বুঝে তাহলে আমরা তাদেরকে নোটিশ প্রদান করি। এর পর সাময়িক সময়ের জন্য ভড়াট কাজ বন্ধ থাকে। এর পরে আইনের ফাক ফোকর থেকে বেড়িয়ে পুনঃরায় ভরাট কাজে লিপ্ত হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের জন্য বরিশালে কোন আদালত নেই। তাই মামলা করেও তেমন কোন ফল পাচ্ছি না। আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ দিবসকে সামনে রেখে বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি।