ব্রিটেনে হুমকির মুখে বাংলাদেশী কারি শিল্প

তবে সব খাবারের মধ্যে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টগুলোর খাবার শীর্ষে অবস্খান করছে কয়েক যুগ ধরে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশী কুজিন গত ২০০ বছর ধরে ব্রিটেনে রেস্টুরেন্ট খাবার অঙ্গনে অনন্য ইতিহাস লালন করে আসছে। এ কারণে লন্ডন মহানগরীর বাংলাদেশী অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের ব্রিকলেইনন্, যাকে বাংলা টাউন বলা হয়ন্, সেটা আজ সমগ্র ব্রিটেনে কারি ক্যাপিটল নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এই কারি ক্যাপিটলকে নিয়ে মূল ধারার মিডিয়ায় টিভি সিরিয়াল নির্মিত হয়েছে। ব্রিকলেইন সর্বদা পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকে। সারা বিশ্ব থেকে ভোজনবিলাসীরা ব্রিকলেইনে চলে আসেন বাংলাদেশী খাবারের স্বাদ নিতে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও কারি ক্যাপিটল মুখর থাকে।

ব্রিটেনে প্রায় ১২ হাজার বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট আছে, যেখানে প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্খান হয়েছে। এসব রেস্টুরেন্ট ব্রিটিশ অর্থনীতিতে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন পাউন্ড টার্নওভার করে দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টগুলো থেকে ব্রিটিশ সরকার ট্যাক্স বাবদ ২৫০ মিলিয়ন ও ভ্যাট বাবদ ৬০০ মিলিয়ন পাউন্ড আয় করে।

জানা যায়, ব্রিটেনে বাংলাদেশী কারি ব্যবসা শুরু হয় ১৮০৯ সালে। লন্ডনের জর্জস্ট্রিটে দীন মোহাম্মদ নামে একজন বাংলাদেশী তৎকালীন অখণ্ড ভারত থেকে এসে ‘হিন্দুস্তানি কারি হাউস’ নামে রেস্টুরেন্টের যাত্রা শুরু করেছিলেন। আরেকটি সূত্রে জানা যায়, ১৮০৯ সালে ইংল্যান্ডের লিভারপুলে প্রথম বাংলাদেশী ভাত-তরকারির রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন বৃহত্তর সিলেট থেকে আগত মো: সিদ্দিকউল্লাহ । সেই শুরু। বর্তমানে ব্রিটেনে এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে বাংলাদেশী মালিকানাধীন রেস্টুরেন্ট নেই।

ব্রিটেনের কারি ব্যবসা সাধারণত চার ভাগে ভাগ করা হয়। ফুললি লাইসেন্সড রেস্টুরেন্ট (মদ পরিবেশন ব্যবস্খাসহ), টেকওয়ে (শুধু ডেলিভারির মাধ্যমে ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া হয়), হালাল ফুড রেস্টুরেন্ট (ইসলামসম্মত পন্থায় খাদ্য তৈরি ও পরিবেশন) এবং চিকেন (বাংলাদেশী খাবারসহ ফাস্টফুড)। এর মধ্যে হালাল বাংলাদেশী মুসলিম খাবার ব্রিটেনে ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, যার ফলে অনেক অমুসলিম রেস্টুরেন্টও হালাল সেকশন চালু করেছে। যেখানে ব্রিটেনের বিখ্যাত মালটি রিটেইলার কোম্পানি টেসকো-আইসল্যান্ড ও সেইনবারেতে হালাল বিভাগ চালু হয়েছে।

এ-ই যখন অবস্খা তখন দুই শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশী ক্যাটারিং ব্যবসা তথা কারি শিল্প আজ হুমকির সম্মুখীন। অবৈধ শ্রমিক ধরার নামে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টগুলোতে ব্রিটিশ বর্ডার এজেন্সির ঘন ঘন পুলিশি অভিযানের কারণে ব্যবসার পরিবেশ ও সুনাম মারাত্মক বিঘ্নিত হচ্ছে এবং ব্যবসায় তীব্র কাস্টমার সঙ্কট শুরু হয়েছে। পুলিশের আকস্মিক অভিযানে রেস্টুরেন্টের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ থাকার ফলে রেস্টুরেন্ট মালিক অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ ছাড়া অভিযানের সুযোগে অনেক কাস্টমার পয়সা না দিয়ে চলে যায়। পাশাপাশি উপস্খিত কাস্টমাররা বিব্রত ও বিরক্তি বোধ করেন এবং তারা ভবিষ্যতে ওই রেস্টুরেন্টে আর আসেন না। কেননা ব্রিটিশ কারি কাস্টমাররা সব সময় নীরবে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ভোজন সম্পন্ন করতে চায়। এসব কারণে ইদানীং ব্রিটেনে বাংলাদেশী কারি ব্যবসা তীব্র সঙ্কটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে ব্রিটেনে অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট ও অবৈধ শ্রমিকদের কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টগুলোকে টার্গেট বানানো হয়েছে। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে পুলিশি অভিযান চালানো হয়। ইউকে বর্ডার এজেন্সি বলেছে, রেস্টুরেন্টে অবৈধ শ্রমিক ধরার অভিযান চলবে। কেননা, এসব রেস্টুরেন্টে প্রচুর অবৈধ শ্রমিক কাজ করছে।

এ ব্যাপারে আলাপকালে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান, ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের অন্যতম নেতা বজলুর রশীদ তরফদার  বলেন, ব্রিটিশ বর্ডার এজেন্সির ঘন ঘন অভিযানের ফলে ব্রিটেনে এশিয়ান তথা বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট ব্যবসা তীব্র হুমকির সম্মুখীন। অপপ্রচারের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত অভিযানে এশিয়ান তথা বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টগুলোকে টার্গেট বানানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা সাধ্যানুযায়ী সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে, সব কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিয়োগ দেই। এর পরও ব্যতিক্রম হলে বুঝতে হবে, আমরা পুলিশ অথবা ইউকে বর্ডার এজেন্সি নই। তবে এ কথা আমরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই আমাদের রেস্টুরেন্টগুলোতে বৈধ শ্রমিকরাই কাজ করেন। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ব্রিটিশ সরকারের এ ব্যাপারে এমন কোনো ব্যবস্খা নেয়া উচিত, যাতে আমাদের কারি শিল্পে প্রভাব না পড়ে।

এ ব্যাপারে ইউকে নিউজ বাংলার CHAIR MAN বখতিয়ার মিয়া বরকত আরেক কমিউনিটি লিডার UKNB পরিচালক সিরাজল ইসলাম সেলিম বলেন, হিথরো বিমানবন্দর ও ডোবার সমুদ্রবন্দরে কর্মরত ইমিগ্র্যান্ট কর্মকর্তারাই যদি অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের ধরতে না পারেন, তাহলে রেস্টুরেন্ট মালিকদের কী করার আছে। যদি ব্যারোনেস স্কটল্যান্ড ভুল করতে পারেন তাহলে রেস্টুরেন্টগুলোও ভুল করতে পারে। কেননা এ দেশে ভিজিটররাও ড্রাইভিং লাইসেন্স ও হেলথ কার্ড বের করতে পারেন। অতএব আমাদের পক্ষে কে বৈধ আর কে অবৈধ শ্রমিক, তা যাচাই করা কঠিন।

এ ব্যাপারে ইউকে বর্ডার এজেন্সির কর্মকর্তা বলেন, রেস্টুরেন্টগুলোকে কর্মচারী নিয়োগ করার ব্যাপারে আরো সতর্ক হতে হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে কাগজপত্র কয়েক দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিয়োগ দেয়া উচিত। এ দিকে নব্য পয়েন্টভিত্তিক ইমিগ্রেশন পদ্ধতিতে কেবল ইংরেজি জানা দক্ষ শেফ বিদেশ থেকে আনা যায়। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়া থেকে শেফ আনতে গিয়ে রেস্টুরেন্ট মালিকদের প্রচণ্ড সমস্যায় পড়তে হয়। কেননা এতদঞ্চলে শেফদের মধ্যে ইংলিশ জানা লোক বিরল। আবার ব্রিটেনেও এমন কোনো ব্যবস্খা নেই, যাতে দক্ষ কারি শেফ বানানো যেতে পারে।

অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, একজন কারি শেফের ইংলিশ জানার প্রয়োজন নেই। কেননা ইংল্যান্ডের ফুটবল ম্যানেজার ফ্যাবিও ক্যাপেলো ইংলিশ জানেন না। তাতে যদি সমস্যা না হয় তাহলে বাংলাদেশ থেকে ইংলিশ না জানা শেফ আনলে সমস্যা হবে কেন? এ ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের কিছুটা ছাড় দেয়া প্রয়োজন। কেননা বাংলাদেশী কারি শিল্প ব্রিটিশ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আর বাংলাদেশ সরকারের এ ব্যাপারে কূটনৈতিক লবিং করা উচিত। কারণ ব্রিটিশ বাংলাদেশী কারি শিল্প সেক্টরে কর্মরত মানুষের মাধ্যমে বাংলাদেশ মিলিয়ন মিলিয়ন রেমিট্যান্স লাভ করে।