দলে ও দলের বাইরে নানান প্রশ্ন – তৃণমূল নেতারা নিষ্ক্রিয় কেন?

থেকে পিকেটিং না করে নিষ্ক্রিয় কেন, এ  নিয়ে দলে ও দলের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানান প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলায় এর প্রকৃত কারণ বেড়িয়ে এসেছে। সকলের প্রশ্ন সামনের হরতালগুলোতেও কি বিএনপির নেতাকর্মীরা এমন নিষ্ক্রিয় থাকবে।

মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অভিমত, বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা হরতাল ডেকে রাস্তায় না নেমে বাসায় ঘুমান কিংবা বিদেশ চলে যান। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ কোনো কোনো নেতা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এয়ারকন্ডিশন রুমের বাইরে বেরুতে চাননা। কেউ কেউ বাসায় বা অন্যত্র অবস্থান করে প্রেস ব্রিফিংয়ের সময়ে ব্রিফিং রুমে এসে মিডিয়ার সামনে হাজির হন। সিনিয়র, মধ্যম ও মাঠ পর্যায়ের নেতাদের এ ভূমিকা নিয়ে দলের সাধারণ কর্মী সমর্থকদের মধ্যে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। নানান প্রশ্নের উদ্রেগ হয়েছে রাজনৈতিক সচেতন সাধারণ মানুষের মধ্যে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক নেতাই এর কারণ হিসেবে পুলিশ ও র‌্যাবের মারমুখী ভূমিকা ও সাম্প্রতিক ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে তাৎক্ষনিক সাজা প্রদানের ঘটনাকে দায়ি করেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, হরতালে মাঠে দলীয় নেতাকর্মীরা নেই এটা সঠিক নয়। মাঠে নেতাকর্মীরা না থাকলে গত ৪৮ ঘণ্টার হরতালে সাড়ে ৫শত নেতাকর্মী গ্রেপ্তার ও সাড়ে ৬শত আহত হলেন কিভাবে।  

মির্জা ফখরুলের এ কথা যে সর্বাংশে সত্য নয় তা পরিষ্কার হয়ে গেছে যুবদলের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সম্পাদক আনোয়ার হোসেন লাল্টুর কথায়। লাল্টু বলেন, ঢাকা মহানগরীতে হরতাল পালন করতে পিকেটিং করতে হবে। মহানগর কমিটির আহ্বায়ক  ও সদস্য সচিব কোথায়? পিকেটিং করতে তারা রাস্তায় নামেন না কেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এক এগারোর সুবিধা ভোগীদের আবারো মহানগর কমিটির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ডেমরার সালাউদ্দিন বা কাইয়ুম কমিশনারকে দায়িত্ব দিলে কি এমন ক্ষতি হতো। যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে হরতালে মাঠে না থাকায় তাদের অযোগ্যতা আবারো প্রমানিত হয়েছে। শুধু লাল্টু নয় এমন অভিযোগ দলের মাঠ পর্যায়ের অনেক সাধারণ নেতাকর্মীর।

মৎস্যজীবি দলের মহানগরীর যুগ্ম সম্পাদক আলতাফ হোসেন সরদার বলেন, রাজনৈতিক দলের হরতাল পালনে পিকেটিং সমাবেশ মিছিল একটি প্রচলিত রীতি। কিন্তু বিএনপি এ লাইনে হাটতে নারাজ। তারা হরতাল ডেকে নিজেরাতো নামেনই না  সাধারণ নেতাকর্মীদেরও মাঠে নামতে সাহস যোগাননা।

তাদের ভাষ্য দলের দায়িত্ব হরতাল আহ্বান করা। পালনের দায়িত্ব জনগণের। আলতাফ বলেন, জনগণতো দায় ঠেকেছে তোমরা ঘরে থাকবা আর রাস্তায় নেমে তারা পুলিশের পিটুনী খাবে ও জেলের ঘানি টানবে।

আলতাফ আরো বলেন, নেতারা মাঠে নামলে সাধারণ কর্মীরা অবশ্যই মাঠে থাকতো। তাতে পুলিশ র‌্যাব যতো অত্যাচার করুক কিংবা গ্রেপ্তার করুক। আলতাফের বক্তব্য পুলিশ কতজনকে মারবে? কতজনকে গ্রেপ্তার করবে। দলের সিনিয়র নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামলে হাজার হাজার নেতাকর্মী তাদের সঙ্গে থাকতো পুলিশের কি সাধ্য এতো লোকের সামনে আসা।

জাসাস ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক ডা. আরিফ মোল্লা বলেন, যতোদিন দলের মধ্যে সিনিয়র নেতারা ঐক্যবদ্ধ না হবে ততোদিন বিএনপি কোনো আন্দোলন মাঠে জমাতে পারবেনা। তার ভাষায় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করবো আমরা, মাঠে পুলিশের সঙ্গে মারামারি করবো জেল খাটবো আমরা আর কোনো কিছু না করে আরামে থেকে নির্বাচনের সময় নমিনেশন ও দল ক্ষমতায় আসলে মন্ত্রী হবেন ওনারা তা হবেনা। আমাদের মাঠে নামাতে হলে ওনাদেরও মাঠে নামতে হবে। আরিফ বলেন, দেশে এখন আর কেউ বোকা নেই, নিজের ভালোমন্দ সবাই বোঝে।

বিএনপির এসব নেতাকর্মী ছাড়াও নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের অনেক নেতাকর্মী সিনিয়র নেতাদের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। অনেক নেতাকর্মী বলেন, যেদেশের মানুষ সেনাশাসন কিংবা কার্ফুকে উপেক্ষা করে মিছিল সমাবেশ করে সেদেশে একটি নির্বাচিত সরকারের পুলিশ আর র‌্যাবতো নশ্যি।  

বিএনপির সিনিয়র নেতারা কেন মাঠে নামেন না এ বিষয় নিয়ে কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা বিষয়টি অস্বীকার করেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, সিনিয়র নেতারা মাঠে থাকেননা এ কথা সত্য নয়।

তিনি বলেন, গত ৪৮ ঘণ্টা হরতালে (৬-৭ জুলাই) দলের প্রচার সম্পাদক ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নাল আবদীন ফারুককে যেভাবে বর্বরোচিতভাবে পুলিশ পিটিয়ে আহত করেছে। সাড়ে ৫শত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে,সাড়ে ৬শতকে পিটিয়ে আহত করেছে।

তার আগের হরতালে দুই ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মহিলা দল সভানেত্রী নূরী আরা সাফা, সাবেক সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম, হাবিবুর রহমান হাবিব, এডভোকেট আবেদ রাজা, কৃষক দলের যুগ্ম সম্পাদক শাহজাহান মিয়া সম্রাট, ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক খোকন এমনকি বর্তমান সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদকে পর্যন্ত অফিসের সামনে চেয়ারে বসা অবস্থা থেকে পুলিশ চ্যাংদোল করে নিয়ে আটক করে রাখে।

তিনি বলেন, দলের মধ্যে কোনো কোন্দল নেই, আন্দোলন সংগ্রামের জন্য নেতাকর্মীরা প্রস্তুত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যেকোনো সময় যেকোনো কর্মসূচির জন্য প্রস্তুত থাকে। এরজন্য তাদের নতুন করে প্রস্তুত করার প্রয়োজন হয়না। সিনিয়র নেতারা মাঠে নেই এটাও অস্বীকার করে তিনি বলেন, একটি দলের সবনেতাকর্মী সব কর্মসূচিতে অংশ নেন না। কিছু কিছু নেতা সেক্টর ওয়াইজ কাজ করেন।

বিএনপির সিনিয়র নেতারা যাই বলেন ৩৮৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশকে সদস্যকেই দলীয় কর্মকান্ডে দেখা যায় না। হরতাল কর্মসূচিতো দুরের কথা দলীয় বিক্ষোভ সমাবেশ কিংবা আলোচনা সভার মতো কর্মসূচিতে তারা অংশ নেন না। নেতা কর্মীদের সক্রিয় হওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছেন দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এমনকি নিষ্ক্রিয় নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুমকি দেয়া হলেও এসব নেতারা সক্রিয় হচ্ছেন না।

কেন তারা সক্রিয় নয় এমন প্রশ্নের ও পাওয়া গেছে নানান জবাব। কেউ কেউ বলছেন, সরকারের মেয়াদের এখনো অনেক সময় বাকি। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার এখনো উপযুক্ত সময় হয়ে ওঠেনি। এ মূহুর্তে আন্দোলনে নামা আর আত্বহত্যা সমান।

কারো মতে, আন্দোলনে নেমে শারিরিকভাবে ও মানষিকভাবে নাজেহাল হলেও দলের পক্ষ থেকে কোনো ধরণের খোঁজ খবর নেয়া হয় না। পাওয়া যায়না আইনী সহায়তাসহ কোনো ধরনের সহায়তা। পরিবারকেই সব ঝামেলা পোহাতে হয়। এমনকি দীর্ঘদিন কারাগার বা হাসপাতালে থাকতে হলে দল আপদ মনে করে ভুলে যায়। সুতরাং এ অবস্থায় কেউই ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় হতে চাচ্ছেনা। কারো কারো মতে, দলে পদ পেতে আন্দোলন সংগ্রামের কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন হয় না। সময় মতো কিছু নেতার পেছনে প্রয়োজনীয় টাকা খরচ করলেই পদ পাওয়া যায়। সুতরাং ঝুঁকি নিয়ে লাভ কি?।

একই অবস্থা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ও সমমনা দলগুলোর নেতাকর্মীদের। তারা শুধু মিডিয়া কভারেজ ও বিএনপি সরকারে থাকলে হালুয়া রুটির ভাগ পেতে যেটুকু করার প্রয়োজন এর বাইরে তারা কিছু করতে রাজি নয়।

বিএনপি, জামাত, বিজেপি ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে সমমনা দল হিসেবে রয়েছে আরো ৮টি দল। এদের মধ্যে রয়েছে-প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি (প্রগশ), প্রগতিশীল ন্যাশনালিষ্ট পার্টি (পিএনপি), লেবার পার্র্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মতিন), খেলাফত মসলিস, মুসলিম লীগ, ন্যাপ ও এনডিপি।