নতুন দেশ দক্ষিণ সুদান

আত্মপ্রকাশ ঘটেছে গত ৯ জুলাই। আফ্রিকা মহাদেশের ৫৪তম দেশ এটি। আর জাতিসংঘের ১৯৩তম। আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম ৯,৬৭,৫০০ বর্গমাইল আয়তনের রাষ্ট্র সুদান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ২,৩৯,২৮৫ বর্গমাইল ভূখণ্ড। বিচ্ছিন্ন এ ভূখণ্ড আত্মপ্রকাশ করেছে দক্ষিণ সুদান বা রিপাবলিক অফ সাউথ সুদান নামে। এর জনসংখ্যা ২০০৮ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এক কোটি ১০ লাখ থেকে এক কোটি ৩০ লাখের মধ্যে। অখণ্ড সুদানের মোট জনসংখ্যা ছিল ৪,৩৯,৩৯,৫৯৮ এবং মাথাপিছু আয় ১৬৩৮ মার্কিন ডলার। দেশটির দৈনিক তেল উত্তোলনের পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ ২০ হাজার ব্যারেল, যা অবিশ্বাস্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং বছর জুড়ে গোলযোগ অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ভূখণ্ডটি কট্টর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বসতি বলে পরিচিত।

ভৌগোলিক বৈচিত্রের দেশ সুদান
আফ্রিকার অন্যতম সর্বাধিক ভৌগোলিক বৈচিত্রের অধিকারী সবচেয়ে বড় দেশ সুদান। খার্তুম এর রাজধানী। এর উত্তরদিক মরুময় পার্বত্যাঞ্চল, আর দক্ষিণাঞ্চল গাছ-গাছড়ায় ভরপুর শস্যশ্যামলা। পূর্ব-পশ্চিমে দেশটিকে ভাগ করেছে নীল নদ। তেল ও অন্য খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এ দেশটির জনসংখ্যা ৪ কোটি ৩৯ লাখ। বর্বর গণহত্যার জন্য সুদানের পশ্চিমাঞ্চল দারফুরের কথা সবারই জানা। দারফুরে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য সুদানের বর্তমান জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের প্রধান ওমর হাসান আল-বশিরের বিরুদ্ধে দ্য হেগে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে দু’টি আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। তবে বশির এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। যা হোক এ সুদানের ইতিহাস ঘরে ঘরে মারামারির, জাতিতে-জাতিতে, গোত্রে-গোত্রে সহিংসতায় ভরপুর।

বেশিরভাগ লোকই খ্রিস্টান
সুদানের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ লোক আরবি ভাষী মুসলমান। আর দক্ষিণ সুদানের বেশিরভাগ লোকই খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে ভৌগোলিক বিচারে যেমন পার্থক্য রয়েছে তেমনই ধর্ম ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও এ দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কোনো মিল নেই। ক্ষমতা ও ধনসম্পদ নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নেও দুই অঞ্চলের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে বিরোধ লেগেই থাকে। উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে এমনই দ্বান্দ্বিক, সাংঘর্ষিক রক্তক্ষয়ী অবস্থার অবসানে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় ২০০৫ সালে শান্তি চুক্তি হয়।
শান্তি চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ সুদানে ৯ থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত গণভোট হয়। উত্তর সুদান থেকে দক্ষিণ সুদান আলাদা হয়ে যাবে কি না এ সম্পর্কে দক্ষিণ সুদানের লোক গণভোটে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। প্রায় ৪০ লাখ ভোটারের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি লোক গণভোটে তাদের রায় দিয়েছেন। দক্ষিণ সুদান গণভোট কমিশন (এসএসআরসি) এ ভোটাভুটি পরিচালনা করে। এসএসআরসি ভোটার উপস্থিতি ৬০ ভাগেরও বেশি বলে মতপ্রকাশ করেছে।
দক্ষিণ সুদান গণভোট কমিশনের চেয়ারম্যান ইবরাহিম খলিল জানিয়েছেন, দক্ষিণ সুদানে মোট ভোটারের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি, উত্তর সুদানে শতকরা ৫৩ ভাগ এবং সুদানের বাইরে ৮টি দেশে বসবাসরতদের মধ্যে শতকরা ৯১ ভাগ ভোটার দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। জুবা এলাকায় ১০টি কেন্দ্রে ৯৫ ভাগেরও বেশি ভোট পড়ছে। একটি কেন্দ্রের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে শতকরা ৯৬ ভাগ ভোটার স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কমপক্ষে ৬০ ভাগ ভোটারের অংশগ্রহণে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ের ভিত্তিতে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

ব্রিটিশ-মিসরীয় যৌথ শাসনের অবসানের পর থেকেই বিরোধ চলে
১৯৫৬ সালে সুদানে ব্রিটিশ-মিসরীয় যৌথ শাসনের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘোষণার পর থেকেই স্বাধীন এ দেশটিতে দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের বিরোধ দেখা দেয়। মূলত ১৯৫৫ সাল থেকেই সুদানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সুদানে প্রথম দফার এ গৃহযুদ্ধ ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চলে। সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন প্রেসিডেন্ট জাফর নুমিরির সরকার ১৯৭২ সালে দক্ষিণ সুদানে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার ব্যাপারে রাজি হলে প্রথম দফার গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। ১৯৮৩ সালে আবার গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত এ গৃহযুদ্ধ চলে। দীর্ঘদিন দর কষাকষির পর বিদ্রোহী গোষ্ঠী ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে সরকারের সঙ্গে একটি সমন্বিত শান্তি বা ‘নাইভাসা’ চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তিতে গণভোটের ভিত্তিতে দক্ষিণ সুদানে পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে।
সুদানে দু’দফার গৃহযুদ্ধে ১৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আর দারফুরে জাতিগত দাঙ্গায় ২ লক্ষাধিক লোক মারা যায়, বাস্তুচ্যুত হয় আরো ২ লাখ মানুষ। দশকের পর দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধে সুদানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো একেবারে ভেঙে পড়ে। দুর্ভিক্ষ আর হানাহানিতে সুদানে সব সময়ই রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতিগত অস্থিতিশীলতা লেগেই থাকে।

দুই দশকের গৃহযুদ্ধে অন্তত ২২ লাখ লোক নিহত হয়
প্রায় দুই দশক ধরে চলা সুদানের গৃহযুদ্ধে অন্তত ২২ লাখ লোক নিহত হয়। বিশেষ করে আশি ও নব্বই দশকে দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সুদান সরকারের মদদে এসব তৎপরতা চলে বলে অভিযোগ ওঠে।

‘দেশ পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক সহনশীলতা দক্ষিণ সুদানের নেই’
ছাব্বিশ বছর ধরে সুদানের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির বলেছেন, ‘গণভোটের ফলাফল যা-ই হোক, আমি তা মেনে নেব।’ বিশ্ব নেতৃত্ব তার এই উদার আহ্বানকে স্বাগত জানিয়েছিল। যদিও নির্বাচনের মাত্র দুই দিন আগে হঠাৎ করে প্রেসিডেন্ট বশির দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবা পরিদর্শনে যান এবং ফিরে এসে বলেন, একটি দেশ পরিচালনার জন্য যে ধরনের একতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং যোগ্যতা থাকা দরকার তা দক্ষিণ সুদানের নেই। দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হলে ওখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে, যার প্রভাব উত্তরাংশে এসে পড়বে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। দেশবাসীকে একতার আহ্বান জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির অখণ্ডতার পক্ষে ভোট দিতে অনুরোধ করেন।

‘আবিই’ প্রদেশ নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সমাধান হয়নি
গণভোটের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ সুদান আলাদা রাষ্ট্র হলেও তেলসমৃদ্ধ ‘আবিই’ প্রদেশ নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সমাধান হয়নি। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ এলাকায় রয়েছে বিশাল তৃণভূমি যেখানে উত্তর সুদানের মুসলিম কৃষকরা তাদের গবাদিপশু চরায়। এখানকার মাটিও অনেক উর্বর। উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যকার এ সীমান্ত এলাকাটি নিজ দখলে রাখতে উভয় অংশই মরিয়া। দক্ষিণ সুদানিরা গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে মত দিলেও এ এলাকার মালিকানা নিয়ে আবারো শুরু হতে পারে বিরোধ। উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে এটিই এখন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এর মালিকানার প্রশ্নে আবারো এ এলাকার অধিবাসীরা গণভোটে অংশ নেবে : তারা কি উত্তরের সঙ্গে থাকবে না দক্ষিণের সঙ্গে যাবে।

নতুন রাষ্ট্রটির কোনো সমুদ্রসীমা নেই
দক্ষিণ সুদান একটি ভূবেষ্টিত রাষ্ট্র। এর উত্তরে থাকবে বর্তমান সুদান, পূর্বে ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া, পশ্চিমে লিবিয়া ও দক্ষিণে উগান্ডা। এর কোনো সমুদ্রসীমা নেই। ভূবেষ্টিত দেশ সাধারণত পূর্ণ বিকাশের সুযোগ পায়না। দক্ষিণ সুদানের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। দেশটিকে সমুদ্র যোগাযোগের জন্য প্রতিবেশীদের ওপর নির্ভর করতে হবে। তাতে আমদানি-রফতানি ব্যয় বাড়বে। এসব দিক থেকে বিবেচনা করলে ওই এলাকার জনগণের আবেগী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ভালো হয়নি। এখন ভবিষ্যৎই বলবে দক্ষিণ সুদান সত্যিকার অর্থে কতটুকু স্বাধীন থাকে অথবা পাশ্চাত্যের শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়।

গৃহযুদ্ধকালে শিশুদের বর্ণনা দেয়া হয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’ হিসেবে
দক্ষিণ সুদানের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিপীড়ন যখন চরমে এবং বিদ্রোহীদের দমন করার নামে বাড়াবাড়ি যখন সাধারণ মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করছিল এবং প্রায় ৪০ লাখ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নিয়েছিল ইথিওপিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা ও মিশরসহ আরো কয়েকটি প্রতিবেশি দেশে, তখন শরণার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষেও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। কারণ তারা শরণার্থীদের প্রয়োজনীয় আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা দিতে পারছিল না। শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের রিপোর্টে বঞ্চিত এই শিশুদের বর্ণনা দিয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’ হিসেবে।

তেল নিয়ে চুক্তি হলেও সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ ছিল বিদ্রোহীদের
২০০৩ ও ২০০৪ সালে বিদ্রোহী ও সরকারের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনার পর পরিস্থিতির কিছুটা অগ্রগতি হলেও চোরাগোপ্তা হামলা অব্যাহত ছিল। ২০০৫ সালে নাইরোবীতে দুই পক্ষ সম্মত হয় যে তাদের মধ্যে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির আওতায় সুদানের দক্ষিণাঞ্চল ছয় বছরের জন্য স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে নিজেদের দ্বারা শাসিত হবে। এরপর তারা অখণ্ড সুদানের অংশ থাকবে, না স্বাধীন হবে তা নির্ধারিত হবে গণভোটের মাধ্যমে। এ সময় সুদানের অন্যতম রফতানি পণ্য তেল থেকে যা আয় হবে তা সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টন করা হবে।
চুক্তি সত্ত্বেও সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ ছিল বিদ্রোহীদের মধ্যে। এ সময়ে দারফুরের পশ্চিমাঞ্চলে দু’টি বিদ্রোহী গ্রুপ সুদান লিবারেশন মুভমেন্ট আর্মি এবং জাস্টিস অ্যান্ড ইক্যুয়ালিটি মুভমেন্টের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। বিদ্রোহীদের অভিযোগ ছিল সরকার দারফুরকে অবহেলা করছে। তাদের উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ ছিল যে তারা কি দক্ষিণাঞ্চলের উন্নতি চায়, নাকি সুদান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক দেশ গড়তে চায়। হত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়নের অভিযোগ ছিল উভয় পক্ষ থেকেই, তবে বেশি দোষারোপ করা হচিছল আরব মিলিশিয়াদের, যারা সরকারপন্থী। বহু লোক পাশ্ববর্তী দেশ শাদে পালিয়ে যায়।

দারফুর এলাকায় মোতায়েন করা হয় শান্তিরক্ষী বাহিনী
২০০৬ সালের আগস্ট মাসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং গোলযোগপূর্ণ দারফুর এলাকায় মোতায়েন করার উদ্দেশ্যে ১৭ হাজার ৩০০ শান্তিরক্ষী পাঠায়। কিন্তু সুদান সরকারের আপত্তির কারণে শান্তিরক্ষীদের ফিরিয়ে আনতে হয়। শেষ পর্যন্ত আফ্রিকান ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যৌথবাহিনী সেখানে মোতায়েন করা সম্ভব হয়। অন্যদিকে পাঁচ বছর ধরে সীমান্ত সংঘর্ষের পর ২০১০ সালে সুদান ও শাদের মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হলে শাদ থেকে সুদানী শরণার্থীরা ফিরে আসে। সুদান সরকার ২০১০ সালে দারফুরের বিদ্রোহী গ্রুপ জাস্টিস অ্যান্ড ইক্যুয়ালিটি মুভমেন্ট’র সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার পর দারফুরে দীর্ঘদিন ধরে চলা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

বশীরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর হয়নি
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর-আল বশীরের বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে  তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এটি কার্যকর না হওয়ায় ২০১০ সালে আইসিসি পুনরায় তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা নবায়ন করে। ২০০৫ সালের শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী দক্ষিণ সুদান ছয় বছর স্বায়ত্ত্বশাসিত থাকার পর চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় এবং ৯৮.৮ শতাংশ ভোটার ভোট দেয় রিপাবলিক অফ সাউথ সুদানের পক্ষে। স্থির হয় নতুন দেশের রাজধানী হবে জুবা এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন সালভা কির মেয়ারদিত (ঝধষাধ কররৎ গধুধৎফরঃ)। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর-আল বশীর গণভোটের ফলাফল মেনে নেন। কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যবর্তী অঞ্চল আবেয়িতে গত জুন মাসে বিদ্রোহী ও সরকারি সৈন্যদের মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়। কারণ, এলাকাটি কোন পক্ষে যাবে তা মীমাংসার বাইরে ছিল। পুনরায় আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ২০ জুনের মধ্যে আবেয়ি এলাকা থেকে উভয় পক্ষ সৈন্য প্রত্যাহার করবে এবং সেখানে মোতায়েন থাকবে ইথিওপীয় শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা। পরবর্তীতে কোনো এক সময়ে আবেয়ি’র ভাগ্য নির্ধারিত হবে।

সুদানে বৈষম্য ও অবহেলার বীজ বপন করেছিল ঔপনিবেশিক শাসকেরা
দক্ষিণ সুদান কেন্দ্রীয় সরকারের উপর বৈষম্য ও অবহেলার যে অভিযোগ তুলে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, তার বীজ বপন করে গিয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসকেরা। ১৯৫৬ সালে সুদানের স্বাধীনতার আগে ১৯৫৩ সালে বৃটিশ কর্তৃপক্ষ দক্ষিণ সুদান থেকে ৮০০ সরকারি পদ খালি করে দিলে সেই শূন্য পদগুলোর মাত্র চারটিতে দক্ষিণ সুদানের অধিবাসীকে নিয়োগ করা হয়। উত্তর ও দক্ষিণ সুদান পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে শাসিত হলেও বৃটিশ কর্তৃপক্ষ ১৯৪৬ সালে দেশটির উভয় অঞ্চলকে এক সরকারের অধীনে আনে। স্বাধীনতার সময় অস্থায়ী সংবিধান অনুসারে সুদানে ফেডারেল পদ্ধতি চালু হওয়ার কথা থাকলেও প্রথম সরকার সেই বিধান থেকে সরে আসে, এবং প্রতিবাদে দক্ষিণের সেনা অফিসাররা বিদ্রোহ করে। এ বিদ্রোহ ক্রমে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয় যা অব্যাহত থাকে ১৭ বছর। উত্তরাঞ্চলের যেসব লোক দক্ষিণ সুদানে বসবাস করতো তাদের অধিকাংশ তখন নিহত হয়। এসময়ে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে এবং দেশ জুড়ে যে বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়ে তা থেকে সহজে বের হওয়া হয়তো সম্ভব ছিল না। দক্ষিণাঞ্চলের স্বাধীনতার পর সেখানে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা কতটা সম্ভব হবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল।

সুদানও অসংখ্য গোত্র ও বহু ভাষাভাষী মানুষের সমষ্টি
সুদান অধিকাংশ আফ্রিকান দেশের মতোই অসংখ্য গোত্র ও বহু ভাষাভাষী মানুষের সমষ্টি। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী অখণ্ড সুদানে মোট ৫৯৭টি বিভিন্ন গোত্রের মানুষ চারশ’র অধিক ভাষা ও উচ্চারণে কথা বলে। জনসংখ্যার ৩৯ শতাংশ আরব, ৫২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ, ৬ শতাংশ বেজা, ২ শতাংশ বিদেশি এবং ১ শতাংশ অন্যান্য। স্বাধীন দক্ষিণ সুদানেও এ সমস্যা একই ধরণের থাকবে তা সহজে অনুমেয়। নতুন দেশ হিসেবে বরং আরো কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে দক্ষিণ সুদানকে। কারণ, এটি হতে যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম অনুন্নত একটি দেশ, যেখানে মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন এবং নতুন করে সংঘর্ষ বেধে যাওয়ার আশংকা ব্যাপক। দারিদ্র্য বড় সমস্যা, কারণ অধিকাংশ মানুষ দিনে এক ডলারের সমপরিমাণ অর্থে কোনোমতে দিন কাটায়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের পরিস্থিতিও অভিন্ন। জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে  দক্ষিণ সুদানে গবাদি পশু অপহরণ থেকে শুরু করে বিদ্রোহীদের অন্তর্কলহে ২,৪০০ লোক নিহত হয়েছে। এখনো সেখানে সাতটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ তৎপর। এছাড়াও সমস্যা রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণের সীমান্তের কাছকাছি তেল ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে দক্ষিণ সুদান। কিন্তু উত্তর সুদানের পাইপ লাইন ব্যবহার করে তা বিশ্ববাজারে রফতানি করতে হবে। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কিভাবে নিষ্পত্তি করা সম্ভব তা দক্ষিণের নেতা ও আন্তর্জাতিক মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।

আশাবাদী হওয়ার পক্ষেও মত রয়েছে
অবশ্য আশাবাদী হওয়ার পক্ষেও মত রয়েছে। ব্রাসেলস ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, দক্ষিণ সুদানে যারা সরকার চালাচ্ছে তারা আসলে গত ছয় বছর ধরেই প্রশাসনে আসীন এবং স্বায়ত্ত্বশাসিত কাঠামোর অধীনে সরকার পরিচালনা করেছেন। তারা যখন শুরু করেন তখন লোক বলতে ছিলেন মাত্র দু’জন, প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট। এখন ৩২টি মন্ত্রণালয়, ১৭টি কমিশন ও ১০টি রাজ্য পর্যায়ের সরকার রয়েছে। নতুন সরকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে আনা, তেলভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বের হয়ে এর বহুমুখীকরণ এবং বিভিন্ন গোত্র ও সামরিক উপদলের মধ্যে রাজনৈতিক শক্তি বণ্টন করার উপায় বের করতে হবে।
রিপাবলিক অফ সাউথ সুদান একটি খসড়া সংবিধানের অধীনে পরিচালিত হবে, যার অধীনে ২০১০ সালের এপ্রিলে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট ও আইনসভা। প্রথম বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটি অন্তবর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হবে।
‘রাজধানী জুবা’র রাস্তার মোড়ে মোড়ে এখন শোভা পাচ্ছে রঙিন ব্যানার, যাতে লিখা ‘কষ্টার্জিত এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ব্যালট ও বুলেটের সমন্বয়ে।’ কিন্তু অনেক সাবেক গেরিলাকে গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত গণভোটে বিচ্ছিন্নতার পক্ষে ভোট দিয়ে অশ্রু বিসর্জন করতে দেখা গেছে বলে বার্তা সংস্থা এপি’র সংবাদদাতা লিখেছেন। কারণ তারা লড়েছেন বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে, দেশকে খণ্ড-বিখণ্ড করার জন্য নয়।

স্বাধীনতা উৎসবে উচ্চারিত হয় আশার বাণী
পাঁচ দশকের গৃহযুদ্ধ ও কেন্দ্রীয় শাসনের নিপীড়নে আনুমানিক বিশ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের পর দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতা উৎসব জাঁকজমকপূর্ণ হবে এটাই স্বাভাবিক। কয়েক ডজন বিশ্ব নেতা এতে যোগ দেন, যাদের মধ্যে ছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী কলিন পাওয়েল, জাতিসংঘে মার্কিন দূত সুজান রাইস, যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকা কমান্ডের প্রধান জেনারেল কার্টার হ্যাম এবং দক্ষিণ সুদানে অত্যন্ত নিন্দিত সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর-আল বশীর। উৎসব থেকে উচ্চারিত হয় আশার বাণী এবং নতুন দেশকে গড়ে তোলার অঙ্গীকার।

শান্তিরক্ষী রাখার আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় দেশটির সহিংস এলাকাগুলোতে জাতিসংঘের শান্তি সেনা রাখার পক্ষে মত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটির জন্য এ সংক্রান্ত একটি খসড়া প্রস্তাবও প্রস্তুত করা হয়েছে। গত ৮ জুলাই ২০১১ দেশটিতে জাতিসংঘের শান্তি মিশন শেষ হয়েছে। জাতিসংঘের একজন রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, নিরাপত্তা পরিষদে নতুন কোনো প্রস্তাব পাস না হলে ১০ জুলাই থেকেই সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে। এ প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সুসান রাইচ ৭ জুলাই ওয়াশিংটনে এক বক্তব্যে এ কথা বলেছেন।
সুসান রাইচ বলেছেন, স্বাধীনতার পর দক্ষিণ সুদানের সহিংস এলাকা বলে পরিচিত দক্ষিণ কোরদোফান ও ব্লু নাইল এলাকায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের অবস্থান করা উচিত। সুদান থেকে জাতিসংঘের সব সেনা তুলে নিয়ে আসা একটি উদ্বেগের বিষয়। সাধারণ নাগরিকদের রক্ষা ও মানবিক সহায়তার জন্য সেখানকার সহিংস এলাকায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জাতিসংঘের শান্তি সেনাদের অবস্থান করা দরকার।

দক্ষিণ সুদানে নতুন মিশন সৃষ্টি করা হতে পারে
২০০৫ সালে উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে শান্তি চুক্তি হওয়ার পর তা পর্যবেক্ষণের জন্য সেখানে জাতিসংঘের শান্তি সেনারা অবস্থান করছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, সাত হাজার জাতিসংঘ শান্তি সেনা ও অতিরিক্ত ৯০০ বেসামরিক পুলিশ নিয়ে দক্ষিণ সুদানে নতুন একটি মিশন সৃষ্টি করা হতে পারে। এ নিয়ে একটি খসড়া প্রস্তাবও তৈরি করা হয়েছে। প্রস্তাবটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটির জন্য তোলা হবে।
তবে খার্তুম এই প্রস্তাবের বিরোধী বলে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। তারা বলেছে, নতুন চুক্তি না হলে উত্তর সুদান থেকে জাতিসংঘে শান্তি সেনাদের চলে যেতে হবে।

স্বাধীনতার আকাঙ্খার পাশাপাশি রয়েছে মার্কিন স্বার্থ
দক্ষিণ সুদানে তেমন কোনো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। ৪০ কিলোমিটারও পাকা রাস্তা নেই সেখানে। জনসংখ্যার প্রায় সবাই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ৮৩ লাখ মানুষের দেশ সুদানের গড় মাথাপিছু আয় এক হাজার ৪০০ ডলার এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তিন দশমিক আট শতাংশ। দেশটির প্রধান খনিজ সম্পদ জ্বালানি তেল যার ৭৫ শতাংশই দক্ষিণ সুদানে অবস্থিত, যদিও শোধনাগারগুলো অবস্থিত উত্তর সুদানে। সুদানে প্রতিদিন পাঁচ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করা হয়। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, দক্ষিণ সুদানের অধিবাসীদের স্বাধীনতার আকাঙ্খার পাশাপাশি রয়েছে মার্কিন স্বার্থ।