ভাষা উন্মুক্ত হবেই : মেহদী হাসান খান

আমি হয়তো চুপ থাকতাম, অন্য সব সময়ের মত মোস্তফা জব্বারের হুংকারে কান না দিয়ে অভ্রর পরের ভার্শনের জন্য কাজ করে যেতাম। কিন্তু এবার কৃতজ্ঞতা থেকে লিখতে বসেছি। যেসব সাহসী মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে চুপ করে ঘটনাটা বয়ে যেতে দেননি, কৃতজ্ঞতাটা তাদের প্রতি। সবাইকে অন্তত এটুকু তো বলতেই হবে যে তারা ঠিক পথেই আছেন।

পাইরেসীর অভিযোগের জবাবঃ

মোস্তফা জব্বার তার লেখায় ঢালাওভাবে পুরো অভ্র কীবোর্ডকেই “পাইরেটেড” হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। অভিযোগটা গুরুতর, একটা জাতীয় দৈনিকে অভিযোগটা কেউ করলে আমরা অবশ্যই ধরে নিব তিনি যা লিখছেন বুঝেশুনে লিখছেন। মজার ব্যাপার হল, মানুষজন অভ্র কীভাবে পাইরেটেড প্রশ্নটা করে তাকে চেপে ধরার পর তিনি বললেন অভ্র নিয়ে তার আপত্তি নেই, অভ্রতে ইউনিবিজয় নামে যে কীবোর্ড লেআউট আছে ঐটা তার বিজয় লেআউট থেকে চুরি করা। চমৎকার, আসুন দেখি কী করলে একটা কপিরাইটেড/পেটেন্ডেড লেআউট (অথবা সেটার প্রয়োগ) এ আমরা চুরির অভিযোগ দিতে পারি।

১) অবিকল লেআউট স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলেঃ

অনুমতির প্রসঙ্গ যখন উঠলই তখন বলি, ২০০৩ সালে অভ্র ডেভেলপের পরিকল্পনা করার সময় আমি ফোনে মোস্তফা জব্বারের কাছে বিজয় লেআউট ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছিলাম। তাকে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছিল, সফটওয়্যারটা যে কেউ বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারবে। বিজয় তখনও ইউনিকোড সমর্থন করত না, ইউনিকোড সমর্থন দেয়ার কোন পরিকল্পনাও তার ছিল না। এই সফটওয়্যারটা ইউনিকোড সমর্থিত হবে, সুতরাং তিনি বিজয় ফন্টের অপব্যবহারের চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। শুধুমাত্র লেআউট একই, এছাড়া সফটওয়্যার দুটোতে কোন মিল থাকবে না।

তিনিও তার জবাব জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাকে টাকা না দিলে তিনি অনুমতি দিবেন না। বেশ ভালো কথা, আমিও বিজয় কীবোর্ড অভ্রর সাথে দেইনি। জ্বী মোস্তফা জব্বার, অভ্র আপনার বিজয় কীবোর্ড ব্যবহার করে না। ইউনিবিজয় আর বিজয় কোনদিনই এক কীবোর্ড লেআউট ছিল না, এখনও নেই। যেখানে একটা কী এর পার্থক্য একটা আলাদা লেআউটের জন্ম দেয়, ইউনিবিজয়ের সাথে বিজয়ের সেখানে অন্তত ৮ টি কীতে পার্থক্য রয়েছে।

কীবোর্ড লেআউট যে সমস্ত কী এর একটা সেট, যেখানে একটা কী এর পার্থক্য হলে দুইটা সেট আলাদা হয়ে যায়, এটা বুঝতে পারেন মোস্তফা জব্বার? না পারলেও পড়তে থাকুন। “ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা” যাতে বুঝতে পারেন সেজন্য খুব সহজ করে নিচে লিখেছি।

২) ফিজিক্যাল লেআউট অনুমতি ছাড়া বিতরণ করলেঃ
প্রশ্নই আসে না। অভ্র কীবোর্ড একটা সফটওয়্যার মাত্র, এর সাথে বিজয় লেআউট ছাপানো কোন কীবোর্ড আমরা বিতরণ করি না।

৩) কীবোর্ড ইন্টারফেস প্রোগ্রামের কোড অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলেঃ
আবারো বলি, এই পয়েন্টও খাটে না। বিজয় ক্লোজড সোর্স, সেটার সোর্স থেকে অভ্র ডেভেলপ করা সম্ভব না। কীভাবে বিজয় হ্যাক করে অভ্র বানানো হল তার ব্যাখ্যা আপনার কাছে দাবী করছি। জবাব দেয়ার আগে দয়া করে “ইংরেজীতে হ্যাকিং লিখে গুগলে অনুসন্ধান” করে যে “মজার মজার সব তথ্য পাওয়া যায়“, সেগুলো নিয়ে একটু পড়াশোনা করবেন।

৪) ট্রেডমার্ক লঙ্ঘন করলেঃ
বিজয় শব্দটি আপনার রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্ক। সেটা যাতে লঙ্ঘন করা না হয় এবং ইউনিবিজয় যে পরিষ্কারভাবে আলাদা একটা লেআউট সেটা বোঝাতেই এর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। আমরা কোনদিনই অভ্রর সাথে বিজয় নামে কোন লেআউট ব্যবহার করিনি। উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, SlideShow শব্দটা মাইক্রোসফটের রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্ক (এখানে লিস্ট দেখুনঃ http://www.microsoft.com/about/legal/en/us/IntellectualProperty/Trademarks/EN-US.aspx), অন্য একটা প্রতিষ্ঠান যখন DVD SlideShow Builder (http://www.photo-to-dvd.com/dvd-slideshow-builder.html) নামে একটা সফটওয়্যার বানায়, তখন মাইক্রোসফটের লেজে কামড় বসানো হয় না। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে ইউনিবিজয় বা ইউনিজয় লেআউটগুলো বের হয়েছে ২০০৩ সাল বা তারও আগে, ১৯৮৭ সালে ডিজাইন করা হলেও আপনি বিজয়ের পেটেন্ট পেয়েছেন ২০০৮/২০০৯ সালে। সেক্ষেত্রে পেটেন্টের আগের থেকেই থাকা এই লেআউটগুলো কীভাবে পেটেন্ট বিরোধী হয়ে গেল আমাদের বোঝাবেন?

আপনি যদি এখনও কিছু না বুঝে থাকেন-
ধরুন একজন ব্যবসায়ী মঙ্গলগ্রহটা কিনতে চাইলেন, বাংলাদেশের পেটেন্ট অফিস তাকে মঙ্গলগ্রহের পেটেন্টও দিয়ে দিল। একদিন সেই ব্যবসায়ী অবিষ্কার করলেন তার গ্রহে কেউ যায় না। এদিকে বাংলাদেশের গাজীপুর নামের একটা জায়গায় গিজগিজ করে মানুষ। মঙ্গলগ্রহের মাটি লাল, গাজীপুরের মাটিও লাল। তিনি রেগে জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘোষণা করে দিলেন, গাজীপুরে কেউ থাকতে পারবে না। কারণ গাজীপুরের মাটি মঙ্গলগ্রহ থেকে চুরি করা হয়েছে। চুরি যদি নাই করা হবে তাহলে এটা লাল কেন? তার মাথায় একবারও আসল না মঙ্গলগ্রহে থাকার পরিবেশ নেই দেখে মানুষ থাকে না, যাওয়ার খরচও অনেক। আবার গাজীপুরে লাল মাটির লোভেও কেউ থাকে না, বেঁচে থাকার জন্য সেখানে আরো উপাদেয় উপকরণ আছে। ব্যাপারটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? গাজীপুরের মানুষের প্রতিবাদ করার অধিকার আছে, তাদের দেখতে চাওয়ার অধিকার আছে সেই ব্যবসায়ীর পেটেন্টের কাগজ, সেখানে কোথায় লেখা আছে লাল মাটি হলেই সে জায়গা ব্যবসায়ীর হবে। সেটা যদি লেখাও থাকে, বাংলাদেশের পেটেন্ট অফিস কিভাবে দেশের সব লাল মাটি বিক্রি করে দিতে পারে সে প্রশ্ন করার অধিকারও তাদের আছে।

মোস্তফা জব্বার, আমি আপনার মত কখনই ভাবি না মানুষ সারাজীবন বিজয় বা অভ্রই ব্যবহার করে যাবে। নতুন দিনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারলে অন্য প্রযুক্তির জন্য যায়গা ছেড়ে দিতে হয়, এটা ধ্রূব সত্য। বাংলা কীবোর্ড নিয়ে গবেষণা থেমে থাকবে না। আপনি আপনার পেটেন্টের কাগজ সবার কাছে প্রকাশ করুন। দেখিয়ে দিন ঠিক কোন রাস্তাগুলো দিয়ে হাঁটা আপনি বন্ধ করে দিতে চান। বারবার একেকজন কাজ করার পর আপনি বলতে পারেন না এই রাস্তায় তো বেড়া দেয়া ছিল। আবার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে দাবিও করতে পারেন না বাংলা কম্পিউটিং এর ইতিহাসে আপনার বিশাল অবদান, আপনি ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা ।

আমরা বিজয় কীবোর্ডকে প্রমোট করার জন্য মাঠে নামিনি। নেমেছি বাংলা ভাষা নিয়ে ব্যবসার শিকার হওয়া থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে। আপনি যদি প্রমাণ করতে পারেন অভ্রতে আপনার ডিজাইন করা বিজয় কীবোর্ড লেআউট আছে, আমি সে মুহূর্তে সেটা বাদ দিব। আর যদি প্রমাণ ছাড়া আসেন, তাহলে নতুন কিছু বলেন। এক গান এতবার শুনতে আমাদের কারোই ভালো লাগছে না আর।

নির্বাচন কমিশন ও ইউএনডিপির সাথে অভ্রর অবৈধ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের জবাবঃ
ইউএনডিপি কে, কেন, কোথায়, কীভাবে এবং তাদের সাথে অভ্রের কী সম্পর্ক এসব বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, আশা করি আপনি যা বলেছেন সেটা ব্যাখ্যা করতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন থেকে সরাসরি ডাক পেয়েই আমি গিয়েছিলাম। অভ্রকে সেখানে ব্যবহার করাতে কোন রকম লবিং বা প্রভাব খাটানোর মত কাজ করতে হয়নি। নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল দেশের টাকা বাঁচানো। যারা জানেন না তাদের জন্য বিস্তারিতভাবে বলি।

নির্বাচন কমিশন ডাটা এন্ট্রি, ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ করা এসবের জন্য প্রথম যে সফটওয়্যারটা ব্যবহার করেছিল সেটায় সরাসরিই বাংলা লেখা যেত, অভ্র বা বিজয়ের মত কোন কীবোর্ড ইন্টারফেস প্রয়োজন হত না। সমস্যা হল প্রতিটা ল্যাপটপের জন্য সেটার একটা আলাদা লাইসেন্স কিনতে হত, হাজার হাজার ল্যাপটপের জন্য হাজার হাজার লাইসেন্স। বুঝতেই পারছেন, বিশাল খরচের ব্যাপার। সে খরচ কমানোর জন্য কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় এরকম একটা সফটওয়্যার তারা নিজেরাই ডেভেলপ করে নিবেন। বুয়েটের একজন শিক্ষককে সে দায়িত্ব দেয়া হয়। তারা সেটাই করেন, শুধুমাত্র বাংলা লেখার অংশটা ছাড়া। যেহেতু অভ্র আগের থেকেই বিনামূল্যে পাওয়া যায় এবং ততদিনে একটা স্টেবল প্রজেক্ট হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, তারা একই চাকা আবার আবিষ্কার করে সময় নষ্ট করতে চাইলেন না। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরীতে তারা অভ্র ব্যবহার করলেন, বিনিময়ে তাদের কাছে আমি একটা জিনিসই চেয়েছিলাম- অভ্র যে নির্বাচন কমিশনে ব্যবহৃত হল তার একটা সনদ। সেটা তারা দিয়েছেন। এর বেশি কোন ঘটনা এখানে ঘটেনি।

আপনার ভাষ্যমতে আপনি যদি নির্বাচন কমিশনের কাছে অভ্রর জন্য ৫ কোটি টাকার বিজয়ের লাইসেন্স বিক্রি করতে ব্যর্থ হন, এক কথায় বলি, আমাদের সমস্ত পরিশ্রম সার্থক। এ দেশের মানুষের ৫ কোটি টাকা নর্দমায় ভেসে যায়নি, বরং অন্য কোন কাজে লেগেছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে আরেকবার কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য।

শেষ কথাঃ
অনেকদিন আগে আমার কম্পিউটারে একটা ভাইরাস এসেছিল। খুবই বিরক্তিকর ভাইরাস। রাইট ক্লিক করলে সেখানে মেনুতে লেখা থাকতো – “If freedom is outlawed, only outlaws will have freedom”। ভাইরাসটা কে বানিয়েছে জানিনা, তাদের এসব কাজের প্রতিও আমার কোন সমর্থন নেই। কিন্তু মেসেজটার কথা আমি কখনই ভুলিনি। ফেসবুকে আমার প্রিয় উক্তির ঘরে সেটা লিখে রেখেছি। স্বাধীনতাকে শেকলবন্দী করা যায় না, মরিয়া মানুষ সেটাকে যেভাবেই হোক ছিনিয়ে আনে- এর চেয়ে বড় সত্যি কথা আর কী হতে পারে? কথাটার মানে আপনি বুঝতে পারবেন বলে মনে হয় না। সবারই সীমাবদ্ধতা থাকে, এতে দুঃখ করার কিছু নেই। মায়ের ভাষা নিয়ে এত চমৎকারভাবে কীভাবে ব্যবসা করা যায় সেটাও আমরা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারিনি।

ভালো থাকুন।


অভ্র টীম এর পক্ষে-
মেহ্‌দী হাসান খান