গ্রেফতার এড়াতে প্যারিসে তারেক রহমান

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টনক নড়েছে। জিয়া পরিবার ধংস করার লক্ষে সরকারী নানা কর্মকান্ড এবং বিচার বিভাগ দলীয়করনের প্রতিবাদে বর্হিবিশ্ব বিএনপি নামে একটি সংগঠন ১৬ তারিখে এ কর্মসূচি ঘোষনা করে।

কর্মসূচির খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে সরকার এর গুরুত্ব অনুধাবন করে অতি দ্রুততার সাথে কিছু রক্ষণাত্মক পদক্ষেপ নেয়। গত ১৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর অঘোষিত মুখপাত্র আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন জানান দেন, খালেদা জিয়ার দুপুত্রকে আর ধরে আনার জন্য ছুটবে না সরকার; উনারা আশা প্রকাশ করেন তারেক-আরাফাত নিজেরাই এসে আইন মোকাবেলা করুক। অথচ দুসপ্তাহ আগেই চিত্রটি ছিলো ভিন্ন- ওদের ধরে আনা হবে। প্রশ্ন উঠছে, হঠাৎ সরকারের কেনো এ পিছটান? জানা গেছে, কয়েকদিন আগে ঢাকাস্থ থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত প্রকাশ করেছেন, আরাফাত রহমান কোকো থাইল্যান্ড ছেড়ে মালয়েশিয়া চলে গেছেন। আর ওয়াশিংটনের বিএনপি নেতা শরাফত হোসেন বাবু যুক্তরাষ্ট্রে তার লোকদের জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার এড়াতে তারেক রহমান লন্ডন ছেড়ে প্যারিসে চলে গেছেন এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমশের মবিন চৌধুরী সেখানে কাগজপত্র ও থাকার বন্দোবস্ত করছেন। তার মানে দাড়ালো- পাখি খাঁচায় নেই। তাই আর চাইনা ধরতে। যখন ইচ্ছা ফেরত আসুক!

২২ তারিখের কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির টানাপোড়েনের খবর ইতোমধ্যে অনেক লেখা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি এ কর্মসূচি নিয়ে সরকারের চাঞ্চল্য লক্ষণীয়। সারা পৃথিবীতে একযোগে বাংলাদেশ দূতাবাস ঘেরাও হলে বর্হিবিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা অনুধাবন করে এ কর্মসূচি বানচাল করার জন্য সরকার নানমূখী পদেক্ষেপ নিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরের সাথে ৩/৪ দফা কথা বলেছেন বলে সূত্রটি জানায়। রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরও বিভিন্ন দূতাবাস ও মিশন প্রধানের সাথে কথা বলেছেন; এমনকি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির একটি গ্রুপের সাথেও যোগাযোগ হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালকরা দফায় দফায় কথা বলে চলেছেন বিভিন্ন দেশে। অন্যদিকে, আয়োজকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ও আন্তগ্রুপ কলহ সৃষ্টি করে অনুষ্ঠানটি ভন্ডুল করতে সচেষ্টা রয়েছে সামরিক গোয়েন্দা ডিজিএফআই। 

জানা গেছে, বর্হিবিশ্ব বিএনপির আহবায়ক যিনি একাধারে ৭ বছর যাবৎ যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সভাপতি- আবদুল লতিফ সম্রাট এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন জুলাই মাসে প্রথম দিকে। প্রথমে খবর বের হয় ২৮ তারিখে হবে প্রোগ্রামটি। খবরটি বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান অবহিত হয়ে এর প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন বলে যুক্তরাজ্য সূত্রে জানা গেছে। এতে আয়োজকদের তোড়জোর বেড়ে যায়। তারিখ এগিয়ে ২২ জুলাই করা হয়। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে তুমুল উত্তেজনা ও লড়াই আগে থেকেই চলছিলো। বিতর্কের একদিকে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির বর্তমান সভাপতি আবদুল লতিফ সম্রাট, অন্যদিকে তার কমিটির অন্যতম সহসভাপতি যিনি নিজেকে জিয়া পরিবারের সদস্য বলে পরিচয় দেন- শরাফত হোসেন বাবু। খালেদা জিয়ার মে মাসের সফরের আগে থেকেই সম্রাটকে হ্যাচকা টানে ফেলে দিয়ে নিজে ওই পদ দখল করতে সচেষ্ট ছিলেন বাবু। অন্যদিকে সম্রাটও নানা কৌশলে পদ আঁকড়ে আছেন। প্রতিদিনই নিত্য নতুন খবর ও গুজব তৈরী হচ্ছিল। বর্তমানে বাবু মরিয়া হয়ে উঠেছে সম্রাটের আয়োজিত দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি যে কোনো মূল্যে বানচাল করতে। ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের এ সুযোগটি ব্যবহার করে কথা বলেন- শরাফত বাবুর সাথে। বাবু প্রয়োজনীয় সাপোর্ট পেয়ে উঠে পড়ে লেগে যান ২২ তারিখের কর্মসূচি পন্ড করার কাজে। কারন তিনি ভালো করেই জানেন- সম্রাটের প্রোগ্রাম সফল হলে তার নিজের ভবিষ্যত অন্ধকার। এ নিয়ে তিনি সাহায্য চান তার দাবীকৃত আত্মীয় তারেক রহমানের স্ত্রী ডাঃ যুবাইদা ও ভাইস প্রেসিডেন্ট শমশের মবিনের। সম্প্রতি শমশের মবিন বেগম জিয়ার কাছে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার মৌখিক সম্মতি আদায় করার একটি গুজব রটালেও আইনগত জটিলতার কারণে বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস থেকে এ সংক্রান্তে অফিসিয়াল আদেশ পাঠাতে অপারগ হয়। এরি মধ্যে ২২ তারিখের কর্মসূচির পক্ষে ম্যারাথন টেলিকন্ফারেন্স চালিয়ে যান সম্রাট এবং ১৬ তারিখে নিউইয়র্কে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। নিউইয়র্কে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক সম্পাদক নাজিমুদ্দিন আলমকে যুক্তরাজ্য বিএনপির এক নেতার মাধ্যমে তারেক রহমানের নির্দেশনা পৌছানো হয়- কোঅর্ডিনেশন করে ২২ তারিখের কর্মসূচি সফল করার জন্য। অন্যদিকে সরকারী গোয়েন্দা ডিজিএফআই এ প্রোগ্রাম বানচাল করতে তাদের সকল শক্তি মাঠে নামায়। বিএনপিতে তাদের প্রধান এজেন্ট খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসকে নির্দেশ দেয়া হয়- ঘেরাও কর্মসূচি বন্ধ করার। শিমুল বিভিন্ন স্থানে নির্দেশ পাঠায় প্রোগ্রাম বন্ধ করতেএ প্রোগ্রামে কেন্দ্রের সমর্থন নাই বেগম জিয়া মহাক্ষুব্ধ সম্রাটের উপর, ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু ততক্ষণে কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। একদিকে শিমুল-শমশের ও অন্যদিকে বাবু তার দলবল নিয়ে একাট্টা হয়ে ময়দানে নেমেছেন একই মিশনে। শুরু হয় খালেদা জিয়াকে কান ভারী করার পালা। এর সাথে বিভিন্ন বিদেশ কমিটিকে হুমকি দেয়া হয়- ২২ তারিখের প্রোগ্রামে থাকলে নিশ্চিত শাস্তি। অবস্থা বেগতিক দেখে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব আমানউল্লাহ আমান ফোনে তার শিষ্য নাজিমুদ্দিনকে হুশিয়ার করেন, শিমুল বিশ্বাসদের কথা অমান্য করে যুক্তরাষ্ট্রে বেশী কিছু করে দেশে ফিরলে এরেষ্ট বা পদ হারানোর ঝুঁকির কথা। সব মিলিয়ে ২২ তারিখের প্রোগ্রাম নিয়ে বিদেশ বিএনপি এবং চেয়ারপার্সনের অফিস এখন বেশ সরগরম।  

২২ তারিখের দূতাবাস ঘেরাও কর্মসুচি বানচাল করতে মরিয়া শরাফত বাবু যা ইচ্ছা তাই বলে বেড়াচ্ছেন। কর্মীদের ধরে রাখতে অহর্নিশি তিনি বলে থাকেন, “আমি জিয়া পরিবারের লোক। তারেকের স্ত্রী যুবায়দা আমার বোন। এক সময় বিয়ের কথা হযেছিলো। কিন্তু তারেক বিয়ে করায় তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে ওর সাথে আমার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ঘন্টার পর ঘন্টা আমার কথা হয়। তারেকের সাথে সকাল-বিকাল টেলিফোন হয়।” সম্রাট সম্পর্কে বাবুর অভিযোগ, “সম্রাট গোপালগঞ্জের লোক, শেখ কামালের বডিগার্ড ছিলো, চাঁদাবাজ, খারাপ লোক, বেগম জিয়া তাকে দুচোখে দেখতে পারে না।” গত সপ্তাহ জুড়ে ঢাকার পত্রপত্রিকায় খবর উঠে- সরকার ২১ আগষ্ট গ্রেনেড মামলায় তারেক রহমানকে লন্ডন থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে। গতকালই বাবুর নিকটস্থ লোকজন সুত্রে প্রকাশ হয়, বাবুর ভাষায় তারেক রহমান লন্ডন ছেড়ে প্যারিস চলে গেছেন এবং তাকে দেখভালের জন্য শমশের মবিন আগে থেকেই ওখানে আছেন। মোটকথা তারেক রহমানের কোনো খবরই এখন আর গোপন থাকে না। বাবুর কল্যানে রাস্তায় চলে আসছে। বাবুর এহেন বিতর্কিত কর্মকান্ডে ওয়াশিংটনভিত্তিক কিছু ডাইহার্ড কর্মীরা ক্ষেপে উঠেছে। তারেক রহমানের স্ত্রী যুবাইদাকে নিয়ে বাবুর বিরামহীন আপত্তিকর মন্তব্য, এমনকি ১/১১র পরে যুবাইদা বাবুর হেফাজতে চাঁদপুরে ছিলো এমন প্রচার নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে এরা। যে কোনো সময় বাবুকে লাঞ্ছিত করতে পারে এমন সম্ভাবনার কথাও বলছেন কেউ কেউ। তারেক রহমানের সাথে নিজের নৈকট্য জাহির করতে জিয়া পরিবারের গোপন তথ্যাদি তার মাধ্যমে ফাঁস হওয়ায় অনেকের সন্দেহ- বাবু কি তারেক রহমানের বন্ধু, নাকি শত্রু ?

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, শরাফত বাবু তারেক রহমানের কোনো আত্মীয় নন। তারেক রহমানের শ্বাশুড়ি ইকবাল বানুর বাসায় তাহের নামে এক কেয়ারটেকার আছে। এই তাহেরের ভাতিজা হলেন বাবু। এটাই হলো যুবায়দার সেই “খালাত ভাই”! সপ্তাহখানেক আগে বিএনপি ঘরানার “নেড়ি কুকুর” খ্যাত সম্পাদক শফিক রেহমান এসেছিলেন আমেরিকায়। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি পরিস্কার বলে গেছেন, শরাফত বাবু তারেকের কোনো আত্মীয় হয় না, তারেক তাকে পছন্দও করে না। সে উনার নাম ভাঙ্গিয়ে খায়। আরো জানা গেছে, বাবু মেট্রিক পাশও করতে পারেনি, যুক্তরাষ্ট্রে এসে ট্যাক্সি-লিভারী চালিয়ে জীবন ধারন করে। ইদানিং তিনি ওয়াশিংটনে লিমো চালান। অবশ্য লোকজনের কাছে বলে বেড়ান, লিজিং ফার্ম আছে তার। মাঝে মধ্যে ২/১দিনের জন্য রেডি অফিস ভাড়া নিয়েও কাউকে দেখিয়েছেন- কত বড় ব্যবসা তার! তার একমাত্র কাজ তারেক রহমানের আত্মীয় নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদা আদায়। জানা যায়, দুটি বিয়ে করেছেন তিনি। অত্যাচারের চোটে প্রথম জন বিদায় নিয়েছে, পরে ৩ বাচ্চাসহ আরেকজনের স্ত্রীকে অধিগ্রহন করেছেন তিনি। মাঝখানে এক মহিলাকে সেক্রেটারী-কাম-মনোরঞ্জক বানিয়েছিলেন যার দ্বারা হোটেলে নানাবিধ সার্ভিসও নাকি দিয়েছেন।  

জোট সরকারের সময়ে ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূত ছিলেন মেজর জিয়ার মুক্তিযুদ্ধসঙ্গী শমশের মবিন, এখন বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান যিনি পররাষ্ট্র বিষয়াদি দেখভাল করেন। শমশের মবিনের সাথে ওয়াশিংটনবাসী শরাফত বাবুর যোগ ঘটে রাষ্ট্রদূত থাকাবস্থায়। তারেক রহমানের স্ত্রীর আত্মীয় বাবু, এমন কথা জেনেই বাবুকে পাত্ত‍া দেন শমশের। বিএনপির জন্য ওয়াশিংটনে লবিষ্ট ফার্ম নিয়োগ করা নিয়ে দুজনের সম্পর্ক আরো গভীর হয়। এ সূত্র ব্যবহার করে বাবু সমর্থ হন সম্রাটকে কাবু করতে। আর সেটা হয় মে মাসে খালেদা জিয়ার যুক্তরাষ্ট্র সফরকে কেন্দ্র করে। নিউইয়র্কে খালেদাকে সম্বর্ধনা দেয়ার জন্য সম্রাটকে সাইডে রেখে ডাঃ মজিবুর রহমানকে প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক করে দেন শমশের। বাবু এ কমিটির ২য় প্রধান ব্যক্তি হলেও মূলত পুরোটাই নিয়ন্ত্রন করতেন। কোনোমতে সম্রাট ঐ রিসেপশনে মান-ইজ্জত রক্ষা করে দেরী না করে আক্রমন করে বসেন বাবুকে। বাবুর নেতৃত্বাধীন ওয়াশিংটন মেট্রো কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নতুন আরেকটি কমিটি নিয়োগ দেন জুন মাসে। এরপর থেকেই রাজনীতির ময়দানের টিকে থাকার সংগ্রামে চুড়ান্ত লড়াইয়ে আর সেটা সম্রাটকে খেয়ে ফেলার। 

জিয়া পরিবারের রক্ষার আন্দোলনে “জিয়া পরিবারের সদস্য” বলে দাবীদার শরাফত বাবু নেই, বরং যে কোনো মূল্যে এটা পন্ড করবেন- এ ঘটনাটা মিলাতে পারছেন না যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা কর্মীরা। অনেকেই দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে গেছেন, ২২ তারিখের অনুষ্ঠানে সামিল হবেন, নাকি বাবুর সাথে থাকবেন। জানা গেছে, সম্রাটও ছাড়বার পাত্র নয়, জানবাজি রেখে প্রোগাম করবেন, আর সে লক্ষে প্রচার-প্রস্তুতি নিচ্ছেন সমানে। অন্যদিকে, শমশের-শিমুল-বাবু একাট্টা হয়েছে সম্রাটকে খেয়ে ফেলতে, সেটা জিয়া পরিবারের স্বার্থের বিনিময়ে হলেও।