আইনের শাসন বনাম জাতীয় চরিত্রের অবক্ষয়

গড়িয়ে যায় গোটা সকাল। এমনি এক সকালে ঢাকা হতে সাভার যাচ্ছি অফিসের কাজে। ড্রাইভার বার বার কমপ্লেইন করছিল ভিজিবিলিটি নিয়ে। উপায় ছিলনা ফিরে যাওয়ার, তাই চোখ কান খোলা রেখে সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে চালিয়ে যাওয়ার তাগাদা দিলাম। ১০ হাত দুরে কি হচ্ছে তা দেখার বা প্রেডিক্ট করার কোন উপায় ছিলনা। এমন একটা প্রেক্ষাপটেই ঘটল ঘটনাটা। এতদিন যা পত্রিকায় পড়ে আসছি, লোকমুখে শুনে আসছি, তাই ঘটল এবং ঘটল প্রায় চোখের সামনে। বোমা বিস্ফোরণের গগনবিদারী আওয়াজে কেঁপে উঠল গোটা ঢাকা-আরিচা হাইওয়ে (গরু আর রিক্সা চলাচলের রাস্তাকে যদি বলা যায়!)। আমার কাছে মনে হল কুয়াশার সমুদ্র হঠাৎ করে গর্জাতে শুরু করেছে। থর থর করে কেঁপে উঠল আমাদের গাড়ি। শব্দের সুনামি কিছুক্ষণের জন্যে স্তব্দ করে দিল চোখ, কান আর ইন্দ্র যন্ত্রের সবকটা লোহালক্কর। সেকেন্ড পার না হতে শুরু হল আকাশ ফাটানো চীৎকার। বোমা ফোমা আসলে কিছু না, যাত্রিবাহী দুটো বাসের সংঘর্ষ হয়েছে। কুয়াশার সমুদ্র হঠাৎ করে রূপ নিল রক্তের সমুদ্রে। আহত আর নিহতদের থেতলানো চেহারা গোটা রাস্তায় সৃস্টি করল এমন এক ভয়াবহ দৃশ্য যা কেবল হরর মুভির সাথেই তুলনা করা চলে। কিছু বুঝে উঠার আগে ড্রাইভার জানাল আমাদের পালাতে হবে। এমন দৃশ্যপটে পুলিশ আমাদের আবিস্কার করলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা আছে। এমনটাই নাকি তার ওস্তাদের শিক্ষা। এতকিছু ভাবার সময় ছিলনা। গাড়ি হতে বের হতেই শুরু হল ফ্রি স্টাইল বমি। কোথায় যাব আর কি করব তার কোন কুল কিনারা করতে পারলাম না। লাশ দুরে থাক সামান্য রক্ত দেখলেই আমার কর্ম সাবার। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলনা। কুয়াশার চাদর ভেদ করে গ্রামবাসীর পায়ের আওয়াজ কানে পৌছাতে অসুবিধা হলনা। ওরা আসছে। আমি নিশ্চিত হলাম সাহায্য আসছে। কিছু করতে না পারায় নিজকে ধিক্কার দিলাম। পাশাপাশি গ্রামের সাধারণ মানুষের আওয়াজ পেয়ে পৃথিবীটা নষ্ট হয়ে যায়নি ভেবে নিজকে সান্ত্বনা দিলাম।

ওরা এল, এবং তা দলে দলে। ম্যারাথন দৌড়ের শেষটার মত হাঁপাতে হাঁপাতে অতিক্রম করল শেষ কয়েক গজ। ভাবলাম দায়িত্ব নেয়ার এখনি সময়। কাকে কোথায় পাঠাতে হবে তারও একটা নক্সাও একে নিলাম। কিন্তু হায়, কি ভাবলাম আর কি হল দেখে শিউরে উঠলাম। পায়ের লোম আর মাথার লোম একাকার হয়ে দাড়িয়ে গেল। বোবা হয়ে গেলাম। বিবেকের সব কটা চেম্বার ঘেটে এমন লোমহর্ষক ঘটনা অতীতে দেখেছি কিনা মনে করতে পারলাম না। ওরা সবাই মিলে পাগলা কুকুরের মত ঝাপিয়ে পরল আহত আর নিহত যাত্রীদের উপর। দ্রুত গতিতে ব্যাগ আর পকেট হাতড়াল। লাশ হতে ছিনিয়ে নিল হাতঘড়ি। মহিলাদের অলংকার নিয়ে শুরু করল ক্ষুধার্ত শকুনের কামড়া কামড়ি। আমার মনে হল অন্য জগতে চলে গেছি আমি, থ্রী ডাইমেনশনের ডানায় চড়ে চলে গেছি পাথর যুগে। ছানাবড়া হয়ে গেল আমার অস্তিত্ব। কিছুক্ষণের ভেতর যোগ দিল লুটেরাদের দ্বিতীয় গ্রুপ। ৬/৭ বছরের শিশুরাও ছিল এ যাত্রায়। মাথায় ঘোমটা আর কোলে শিশু নিয়ে গ্রাম্যবালারাও জানান দিল নিজেদের শক্তি। মরা গরুর মত কিছুক্ষণের ভেতরই হাড্ডি বেরিয়ে এল আহত আর নিহত যাত্রীদের চামড়া ভেদ করে। যাত্রীদের শেষ পয়সাটা পর্যন্ত লুটে নিয়ে চলে গেল যে যার পথে। ড্রাইভার আবারও তাগাদা দিল। এবার নাকি পুলিশ আসবে এবং শুরু হবে নতুন পর্ব।

সবাই এল শেষ পর্যন্ত। পুলিশ, এম্বুলেন্স, গ্রাম্য মোড়ল, রাজনীতির বড় নেতা, ছোট নেতা, পাতি নেতা, ছটাক নেতা, সংসদ সদস্য, সাংবাদিক সহ লুটেরাদের অনেকে। এক কথায় কেউ বাদ গেলনা। ড্রাইভারের কথা মত আসলেই শুরু হল ঘটনার নতুন পর্ব। তবে এ পর্ব দেখার জন্যে আমাকে আরও কটা দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। লুটের মাল উদ্বারের নামে পুলিশ এলাকার নারী, পুরুষ আর শিশু নির্বিশেষে যাকে সামনে পেল তাকেই ধরে নিয়ে গেল। জামিনের নামে পয়সা খেল পুলিশ, উকিল, মোক্তার আর মেজিস্ট্রেট। কেস হল, যার শুনানি হলনা কোনদিন। লুটে নেয়া মালের অনেকটাই উদ্বার করল পুলিশ যা ভাগ বাটোয়ারা হয়ে দুর্বলদের হাত হতে চলে গিয়েছিল শক্তিশালীদের হাতে। যে ড্রাইভার দ্বয়ের কারণে এই মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেছিল তাদের কাছ হতেও আদায় হয়েছিল বিরাট অংকের নজরানা। আপনাদের হয়ত বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে কিন্তু আমার সূত্র মতে এই টাকার একটা অংশ রফতানি হয়েছিল ঢাকার পুলিশ হেড কোয়ার্টারে, পাতি আর উপ-নেতাদের হাত হয়ে স্থানীয় সাংসদের চেম্বারে। বলে রাখা ভাল, এই সাংসদকে নমিনেশন পেতে বেশ্যা এরশাদের হিসাবরক্ষক কাম লিগ্যাল ওয়াইফ রওশন এরশাদকে দিতে হয়েছিল বিরাট অংকের মেগা নজরানা।

বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে যখন কুকুরের মত মানুষ মরে আমি জানি কতটা হিল্লোর বয়ে যায়, বিশেষ করে আইন বানানো আর তার প্রয়োগকারীদের অনেকের ঘরে। ৪৫ জন শিশুর লাশ দেশের শাসকরা মাথাপিছু ৩ লাখ টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন। গণমৃত্যুকে টাকা দিয়ে কিনতে হয় নিজেদের ব্যর্থতা আর অবৈধ ব্যবসা ঢাকার জন্যে, এর কোন বিকল্প এখন পর্যন্ত আবিস্কার হয়নি জননী জন্মভূমিতে। সরকারী টাকা তো আর নিজের টাকা নয়! আমি জানিনা বিষাক্ত জনপদের দেশ বাংলাদেশে একজন পিতা তার সন্তানকে মানুষ করেন এরশাদ, শেখ হাসিনা অথবা খালেদা জিয়াদের কাছে লাখ টাকায় কংকাল বিক্রির জন্যে কিনা। দেশের মানুষ ভোট দিয়ে রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় পাঠায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে, নিরাপদ রাস্তাঘাটের জন্যে, নিজদের স্বাভাবিক জন্মমৃত্যু নিশ্চিত করার জন্যে। সরকারী টাকা আর ফাঁকা বুলি দিয়ে নিজদের অযোগ্যতা, অপদার্থতা আর চুরি চামারিতে কালো রং লাগানোর নাম দেশ শাসন নয়, এ স্রেফ জাতির সাথে উলঙ্গ প্রতারণা। যা ঘটছে চট্টগ্রামে, যা ঘটছে সাভারে আর বাংলাদেশের প্রতি জনপদে তা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। এমন নয় হঠাৎ ঘটে যাওয়া দৈব এসব ঘটনা যা দ্বিতীয়বার ঘটার সম্ভাবনা নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, এটাই বাংলাদেশ এবং এসব ঘটনা মহামারীর মত প্রসারিত হচ্ছে। এসবকে যারা দুরের কোন ঘটনা ভেবে শান্তি পাচ্ছেন তাদেরকে বলছি, আপনি কি নিশ্চিত আগামীকাল আপনার বাবা, মা, ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন, কাকা, মামা সহ পরিবারের বাকি সবাই নিরাপদের ঘরে ফিরবে? আপনার প্রিয়জনকে কুকুরের মত প্রকাশ্যে হত্যা করলেও আপনি বিচার পাবেন এরই বা নিশ্চয়তা কোথায়? আপনি কি জানেন দেশের রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত দুয়ার খুলে বসে থাকেন খুনের আসামীকে মুক্তি দিয়ে নিজের চেয়ার পাকাপোক্ত করার কাজে?

হ্যা, উপরের যে দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করলাম সেটাও ঘটেছিল আমিনবাজারের অদূরে সাভারের বলিয়ারপুরে। আপনি কি বুক হাত দিয়ে বলতে পারবেন গোটা বাংলাদেশ এখন সাভার নয়। আইনের শাসন হয়ত একদিন ঠিকই প্রতিষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে। অন্তত এ নিয়ে আশা করতে ভয় লাগে না। কিন্তু এ ফাকে জাতীয় চরিত্রের যে অবক্ষয় ঘটে গেল তা-কি ফিরিয়ে আনা যাবে সহজে?

ওয়াচডগ – আমি বাংলাদেশী
AmiBangladeshi.Org