অর্ধেক কাজ বাকি থাকতেই ঠিকাদার পেলেন ৫০ লাখ টাকার চূড়ান্ত বিল

প্রকল্পের অধীনে বরিশালের গৌরনদী পৌরসভার শেষ অংশ দিয়াশুর থেকে কালনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্রিজ পর্যন্ত দেড় কিলো মিটার সড়ক নির্মান (কার্পেটিং) কাজে অনিয়ম, দূর্নীতি ও নিন্মমানের নির্মান সামগ্রী ব্যাবহারসহ বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে ঠিকাদারের বিরুদ্বে একাধিকবার গৌরনদী উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলীর কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরেও কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারের বিরুদ্বে কোন ব্যাবস্থা নেননি। বরং কাজ শেষ না করার পূর্বেই ঠিকাদার ও যুবলীগ নেতা ক্ষিতিশ চন্দ্রকে চূড়ান্ত বিল প্রদান করেছেন্ উপজেলা প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন। বর্তমানে কাজটি অসমাপ্ত অবস্থায় পরে থাকায় সাধারন মানুষকে যাতায়াতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

স্থানীয় লোকজন ও সংস্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের এলজিইডির গ্রামীন অবকাঠামোগত উন্নয়ন (জি আই ডি পি) প্রকল্পের অধীনে গৌরনদী উপজেলা এলজিইডি গৌরনদী  পৌরসভা শেষ অংশ দিয়াশুর  থেকে কালনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্রিজ পর্যন্ত দেড় কিলো মিটার সড়কটির নির্মান (কার্পেটিং) পাকা করন নির্মাণের জন্য ২০০৯ সালের জুলাই মাসে দরপত্র আহবান করা হয়।

প্রকল্পটির প্রাককলিত ব্যায় নির্ধারন করা হয় ৪৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। ২০০৯ সালের ১৮ আগষ্ট মেসার্স সান্টু টেডার্স নামের একটি  ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্প বাস্থবায়নের জন্য কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। কার্যাদেশ অনুযায়ী ২০০৯ সালের ১৮ নভেম্বর কাজটি শেষ করার কথা ছিল। সময়মত কাজ শেষ না করে ঠিকাদার সময় বৃদ্বির আবেদন করলে কর্তৃপক্ষ সর্বশেষ তাকে ৩০ মে ২০১১ প্রকল্প বাস্থবায়নের জন্য সময় সীমা নির্ধারন করেন। ঠিকাদারি  প্রতিষ্ঠানের সত্বাধিকারী ও গৌরনদী উপজেলা আওয়ামীলীমী যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য ক্ষিতিশ চন্দ্র ২০১০ সালের ১৬ নভেম্বর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য  কাজ শুরু করেন। ঠিকাদারের গাফলতি ও খামখেয়ালীর কারনে নির্ধারিত সময় সীমা পার হওয়ার পরে দীর্ঘ দিনেও প্রকল্পটি বাস্থবায়ন সম্পন্ন হয়নি। অথচ ঠিকাদারকে গত মার্চ মাসে চলতি বিল হিসেবে ৩৪ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয় এবং গত ১৫ জুন (২০১১ইং) ৪৯ লক্ষ ৪৮ হাজার ১৯ টাকা চূড়ান্ত বিল প্রদান করা হয়েছে।

স্থানীয় খোকন মল্লিকসহ একাধিক ব্যাক্তিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রকল্পটি বাস্থবায়নে দূর্নীতি অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ ও  অর্ধেকের বেশী কাজ বাকি থাকার পরে ঠিকাদারকে কি করে চূড়ান্ত বিল প্রদান করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, সড়ক নির্মান কাজের শুরু থেকেই ঠিকাদার অনিয়ম ও দূর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। সড়কে এক ফুট বালু ভরাট করে বেড করার কথা থাকলেও ঠিকাদার ৩/৪ ইঞ্চি বালু ভরাট করেছেন। সিডিউল মোতাবেক  সাব বেইজ করা হয়নি। সোয়া ফুট সাব বেইজের স্থলে ৫/৬ ইঞ্চি করা হয়। এ ছাড়া সড়কের ওয়াটার বাউন্ড মেকাডম (ডব্লিউ বি এম) করতে গিয়ে ঠিকাদার পুরাতন ইটের পচা খোয়া ও নিম্নমানের নির্মান সামগ্রী ব্যবহার করেছেন। স্থানীয়  কালনা গ্রামের  গ্রামের মো. আঃ রাজ্জাক, আ. মালেক  সরদার, মোঃ মিরাজ হোসেন, দিয়াশুর গ্রামের মোঃ হিরন মিয়া মো. মাসুদ সরদার, মো. সেকান্দার হোসেনসহ স্থানীয় ও এলাকাবাসি অনেকেই অভিযোগ করেন, ঠিকাদার ও আওয়ামী যুবলীগ নেতা ক্ষিতিশ চন্দ্র ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কোন কিছুকে তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামাফিক কাজ করেছেন। এ নিয়ে এলাকাবাসির সাথে ঠিকাদারের বিরোধ সৃষ্টি ও সংঘর্ষের ফলে একাধিকবার কাজ বন্ধ করা হয়। তারা আরো জানান, ঠিকাদার ক্ষিতিশ চন্দ্রে নিন্মমানের মালামাল অপসারন করে নিয়ে মান সম্মত সামগ্রী দিয়ে কাজ শুরুর ওয়াদা দেয়ার পর কিছুদিন যেতে না যেতেই ঠিকাদার পুনরায় পচা ইটের খোয়া দিয়ে কাজ শুরু করেন।

বিষয়টি এলাকাবাসি গৌরনদী এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলীর কাছে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোন ব্যাবস্থ নেননি। ঠিকাদার তার মত করেই কাজ করে যাচ্ছেন। ঠিকাদার পুনরায় গত ফেব্রুয়ারী মাসে পচা ইটের খোয়া দিয়ে ডব্লিউবিএম কাজ শুরু করেন। এলাকাবাসি পচা খোয়া দিয়ে কাজ করতে বাধা দিলে তা উপেক্ষা করে ঠিকাদার কাজ অব্যাহত রাখেন। এ নিয়ে ঠিকাদারের সাথে এলাকাবাসির বিরোধের ফলে আবার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। গত ১১ জুন শনিবার সকাল আটটায় ঠিকাদার শ্রমিক নিয়ে সড়কের কার্পেটিং (পিচ ঢালাইয়ের) কাজ শুরু করেন। নামে মাত্র পিচ দিয়ে ৩২ মিলি কার্পেপিং এর স্থলে ১০/১২ মিলি কার্পেটিং শুরু করে। এ সময় গৌরনদী উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য খোকন মল্লিক ও তার ছোট ভাই ইলিয়াছ মল্লিকসহ স্থানীয়রা ঘটনাস্থলে পৌঁছে এভাবে কাজ না করতে অনুরোধ জানান। ঠিকাদার তা উপেক্ষা করে কাজ করতে গেলে এ নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে স্থানীয় লোকজনের সাথে নির্মান শ্রমিকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে শ্রমিক সর্দার সিরাজ হাওলাদার (৩২), শ্রমিক শাহাবুদ্দিন বেপারী (৩০), শাহে আলম (২৮) ৮ জন আহত হয়। এ ঘটনায় ওই দিন (শনিবার) স্থানীয়রা উপজেলা প্রকৌশলীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। দীর্ঘ দিন কাজ বন্ধ রাখার পর ঠিকাদার গত ৫ আগষ্ট বৃষ্টির মধ্যে নতুন করে সড়কের কার্পেটিং কাজ শুরু করেন। পুনরায় ৩২ মিলির স্থলে ১০/১২ মিলি উচ্চতা দিয়ে কাজ শুরু করলে এলাকাবাসি বাধা দিলে ঠিকাদার পুনরায় গত রোববার (৭ আগষ্ঠ) কাজ বন্ধ করে দেয়।

সরেজমিনে গিয়ে (৭ আগষ্ট) দেখা যায়, ঠিকাদার সড়কের দুই পাশে প্যালাসাইডিং করেছে কিন্তু কোথাও কোন মাটির কাজ করা হয়নি। বৃষ্টির মধ্যে কার্পেটিং কাজ শুরু করায় নির্মানের সাথে সাথে তা উঠে যাচ্ছে। রাস্তার কাজ করতে না করতেই সড়কের দুই পাশ ভেঙ্গে যাচ্ছে। এ সময় স্থানীয়রা জানান, প্রকল্পটির অর্ধেক কাজও বাস্থবায়ন হয়নি। অথচ কি করে উপজেলা প্রকৌশলী ঠিদাদারকে চূড়ান্ত বিল প্রদান করেছে। অভিযোগের ব্যাপারে ঠিকাদার ও যুবলীগ নেতা ক্ষিতিশ চন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, স্থানীয় কতিপয় লোকের অনৈতিক দাবি পুরন না করায় শুরু থেকেই তারা অসহোযোগীতা করে আসছেন। আমার বিরুদ্বে আনীত অভিযোগ সত্য নয়। এলজিইডি গৌরনদী উপজেলা প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেনর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তার বিরুদ্বে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পরে ঠিকাদারের বিরুদ্বে ব্যাবস্থা নেইনি এ কথা ঠিক নয়। কাজ শেষ করার আগে চূড়ান্ত বিল প্রদান প্রসংগে তিনি বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় চূড়ান্ত বিল দেয়া হয়েছে। তবে ঠিকাদারকে দিয়ে খুব শীঘ্রই বাকি কাজ করিয়ে নেয়া হবে। এ প্রসংগে এলটিইডি বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন স্বীকার করে  বলেন, অভিযোগের সত্যতা ও স্থানীয়দের ক্ষিপ্ততার যথেষ্ট কারন আছে। তবে ঠিকাদারকে দিয়ে সংশোধনের ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে।