মহাঐক্যের পথে বিএনপি

বিরোধী চলমান আন্দোলনে ইতিমধ্যেই যোগ হয়েছে ২২টি রাজনৈতিক দলের নাম। আগামীতে আরো রাজনৈতিক দল তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন এমন বিশ্বাস দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। তার মতে যতো দিন যাবে সরকারের ফ্যাসিষ্ট আচরণের প্রতিবাদে রাজনৈতিক দলের ঐক্য প্রক্রিয়ার তালিকা আরো দীর্ঘ হবে।

সরকারের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন প্রক্রিয়ায় বিএনপি একটি মহাঐক্য গঠনের কাজে হাত দেয় ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই। সে প্রক্রিয়ায় তারা তাদের ৪ দলীয় জোটের মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি তালিকা তৈরি করে। তালিকা অনুযায়ি যেসব দলকে তারা কাছে পাবে বলে মনে করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। তাদের সে যোগাযোগ কোনোটি প্রকাশ্যে মিডিয়ায় এসেছে কোনোটি রয়েছে গোপনে। তারই ধারাবাহিকতায় তারা গত ৪ আগস্ট শেরে বাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজন করে ইফতার পার্টির। সেখানে ২২টি দলের নেতারা অংশ নেয়। যদিও সে ইফতার পার্টিতে সরকারী দল আওয়ামী লীগসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৮টি রাজনৈতিক দলকেই আমন্ত্রন জানানো হয়েছিলো।  

যেসব দল অংশ নেন ইফতার পার্টিতে
বিএনপি, জামাতে ইসলামী, বিজেপি, ইসলামী ঐক্যজোট, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, এলডিপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, কল্যাণ পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি),খেলাফত মজলিস, জাগপা, এনডিপি, এনপিপি, নেজামে ইসলামী পার্টি, ইসলামীক পার্টি, লেবার পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, ভাষানী ন্যাপ, মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় পার্টি (এরশাদ)। কিন্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা বিএনপি নেতৃত্বাধীন মহা ঐক্যে জোগদানের এটা প্রাথমিক মহড়া।

ইফতারে অংশ নিয়ে যে যা বললেন  
ইফতার শেষে বিকল্প ধারা সভাপতি বি. চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ইফতার একটি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মুসলমান হিসেবে আমি এ ইফতারে অংশ নিয়েছি। জোটের প্রশ্নে বলেন, আলোচনা চলছে। সময়মত সবকিছু হবে।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, খালেদা জিয়া আমাকে দাওয়াত করেছেন। তার দাওয়াতে আমরা এসেছি। তার সঙ্গে কথা বলে আমি প্রীত, মুগ্ধ। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। এরপর আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত জানাবো।

মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমেদ বলেন, ইফতার একটি ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান। আমি আমাদের দলের চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে এসেছি। রাজনৈতিক জোটের প্রশ্নে বলেন, দলীয় ফোরামে এ ব্যাপারে আলোচনার পরে আমাদের চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত নেবেন।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রব বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি। ঈদের পরে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের ব্যাপারে আমরা চূড়ান্ত আন্দোলনে নামব। এ আন্দোলন যুগপত বা জোটবদ্ধ যে কোনো রূপ নিতে পারে।

মহাঐক্যে আরো যারা আসতে পারেন
২২ দলের বাইরে আরো অনেক দলের প্রতি বিএনপির আগ্রহ রয়েছে। তাদের সঙ্গেও কথা হচ্ছে বলে জানালেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার মতে অনেকের সঙ্গেই কথা হচ্ছে। কে কে আসবেন তা সময় হলেই আপনাদের জানানো হবে। যাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে তারা হলেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জাতীয় পার্টি (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, যাকের পার্টির চেয়ারম্যান পীরজাদা মোস্তফা আমীর ফয়সাল, ইসলামী আন্দোলনের আমীর চরমোনাইর পীর মুফতি রেজাউল করিম, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ও ফেরদৌস আহমদ কোরেইশির দল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি)।

বিএনপির পক্ষ থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও দলের প্রভাবশালী নেতারা এসব দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। যার সঙ্গে যে নেতার ভালো সম্পর্ক সে নেতাকেই ব্যবহার করা হচ্ছে যোগাযোগ প্রক্রিয়ায়।  

কবে আসছে ঘোষণা
ঈদের পরেই মহাঐক্যের ঘোষণা আসছে এমনটাই জানালেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার মতে শুধু মহাঐক্যই নয়, সরকার পতনের এক দফার ঘোষণাও আসবে ঈদের পরই। সব দলকে সঙ্গে নিয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করে শুরু হবে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এক দফার এ আন্দোলন। ধাপে ধাপে কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে আমাদের আন্দোলন আরো জোরদার করা হবে।

তিনি বলেন, প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে। আমাদেরকেও সে নিয়ম-নীতি মেনেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে। ইতিমধ্যে এ ব্যর্থ অযোগ্য সরকারের বিরুদ্ধে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও মাঠে নামতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, আন্দোলন সফল করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করেই তবে ঘরে ফিরবো। এর জন্য যা যা দরকার তার সবই করা হবে।

ফ্লাসব্যাক
গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্ববাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি বাদ দিয়ে সরকার পতনের একদফা দাবিতে দুর্বার আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। এরপর থেকেই হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিরোধী দলের পক্ষে পর পর দুই দফা লাগাতার হরতাল দেয়া হয়। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কা বেড়ে যায় দেশবাসীর মধ্যে।

পঞ্চদশ সংশোধনীর বিরোধিতা করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আগের চেয়ে অনেকটাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট।

গত নির্বাচনের পর তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কোন কর্মসূচি গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে একই সঙ্গে হরতালসহ বেশ কিছু অভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিল তারা। তাদের সঙ্গে নৈতিকভাবে সমর্থনের পাশাপাশি রাজপথে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সমমনা বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এদের বাইরেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসহ পঞ্চদশ সংশোধনীর বেশ কয়েকটি সুপারিশের বিরুদ্ধে যেসব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন অবস্থান নিয়েছে তাদের নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় বিএনপি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহালসহ অন্যান্য দাবিতে গত জুন ও জুলাই মাসে দুই দফায় লাগাতার ৮৪ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছিল বিএনপি। প্রথম দফায় গত ১২ ও ১৩ জুন ৩৬ ঘণ্টা এবং পরবর্তীতে ৬ ও ৭ জুলাই ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করে দলটি। গত জুন মাসের শেষের দিকে রোডমার্চ করারও সিদ্ধান্ত ছিল বিএনপির। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে তা স্থগিত করা হয়। এরই মধ্যে গত ১৩ জুলাই পালিত হয়, গণ অনশনের মত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও।

গণ অনশনের দিন বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার ভাষণে বোঝা যায়, যতটা ভাবা গিয়েছিল ঠিক এই মুহূর্তে দেশ ততটা উত্তপ্ত হচ্ছে না। কারণ, হরতালের মত কঠোর আন্দোলনের পথ থেকে সরে এসেছে বিরোধী জোট। এদিন হরতাল নয়, বরং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের কথা বলেন খালেদা জিয়া। তাই বিরোধী দলের নেত্রীর এই ভাষণসহ সব দিক বিবেচনা করে যা মনে হচ্ছে, এখুনি হয়ত বিরোধী জোট খুব বড় কোন আন্দোলনে যেতে পারছে না।

রোজা, ঈদ, হজ্ব, পরীক্ষা ইত্যকার কারণে এই মুহূর্তে বিরোধী দলের পক্ষে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার মত বড় কোন আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে ঈদের পর থেকেই মূলত সরকার বিরোধী দুর্বার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে বিরোধী জোট।

যদিও এর মধ্যে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন, রোডমার্চ বা এই ধরনের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দলের কর্মীদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের মনোবলকে চাঙ্গা রেখে সামনের বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার দিকে এগিয়ে যেতে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে কর্মীদের আন্দোলনের মাঠেই রাখা হবে।

তবে সত্যিকার অর্থে সরকারকে চাপে ফেলার মত আন্দোলন গড়ে তোলা হয়ত বিরোধী জোটের পক্ষে সম্ভবপর নাও হতে পারে। তাই সামনের ঈদের পরকে টার্গেট করেই এখন বিরোধী জোট তাদের আন্দোলন কৌশল নির্ধারণের কাজে ব্যস্ত রয়েছে।