শেখ হাসিনা : এক সাহসী নেত্রীর নাম

মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিনঃ আজ জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৬৫তম জন্মদিন। তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের পাঁচ সন্তানের জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা। বাবার আদর্শ লক্ষ করা যায় তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে। ছাত্রী থাকালীন সময়েই তিনি জড়িয়ে পড়েন এদেশের গণআন্দোলনের সাথে। আজিমপুর গার্লস হাইস্কুল, তৎকালীন গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ(বর্তমানে বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সদস্য এবং রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। ছাত্রীজীবনেই তিনি ছিলেন রাজনীতিতে সক্রিয়। প্রতিটি গণআন্দোলনে ছিলে অগ্র সৈনিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি দেশের খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘদিন তিনি দেশের বাহিরে ছিলেন। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। ওই বছরই তিনি সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার সময় তিনি নয়াদিল্লীতে ছিলেন। দলের সভানেত্রী হওয়ার পরেই তাঁর দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। দেশের মানুষের কথা ভাবতে লাগলেন। মানবসেবা জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে এগিয়ে যান এ নারীনেত্রী। গণমানুষের নেত্রী হিসাবে কম সময়ের ব্যবধানেই হয়ে উঠেন জননেত্রী। পিতার আদর্শকে বুকে ধারন করে এগিয়ে যান এ সাহসী নারীনেত্রী। শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের নেত্রী নন, বিশ্বের সেরা নারীনেত্রীদের মধ্যেও তিনি একজন। সম্প্রতি এমনি তথ্য জানিয়েছে বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন। প্রকাশিত তালিকায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টসহ নারীনেত্রীরাও রয়েছেন।

১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি তিনটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নব্বইয়ের ঐতিহাসিক গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং সংবিধানের ৫১ ও ৫৬ ধারা অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরের সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার ঘোষণা প্রদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ১৯৯৪-৯৫ সালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রক্রিয়া চালুর জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর আন্দোলনের ফলে সৃষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে নির্বাচিত হন এবং ২৩ জুন প্রথমবারের মতো শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত দেশে বেশ কিছু উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে।

শুধু পিতা-মাতা, ভাইদের হত্যা করে ঘাতকরা ক্ষান্ত হয়নি শেখ হাসিনাকে বার বার হত্যার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। তাঁর ওপর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হামলাটি হয়েছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শেখ হাসিনার জনসভায় একাধিক শক্তিশালী গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এতে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন এবং ৫০০ জনেরও বেশি আহত হন। শেখ হাসিনা নিজেও কানে মারাত্মকভাবে আঘাত পান। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক মামলা দিয়ে তাঁকে আটক করে জেলে পাঠানো হয়। গ্রেফতারের আগে শেখ হাসিনা জনগণের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, ‘ যে যেভাবে আছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথানত করবেন না। সত্যের জয় হবেই’ বঙ্গবন্ধু কন্যার সাহসী উচ্চারণে মানুষ অন্যায়ের কাছে মাথানত করেনি বরং প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তির কাছে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের মিশন বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। প্রায় এক বছর জেলে থাকার পর দেশ ও বিদেশে প্রবল জনমতের কারণে ২০০৮ সালের ১১ জুন তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

শান্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশে বিদেশে বেশকিছু সম্মানসূচক ডিগ্রি ও সম্মাননা প্রদান করে। ১৯৯৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটি তাঁকে ডক্টর অব ল’ ডিগ্রি প্রদান করে। জাপানের ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটি ১৯৯৭ সালের ৪ জুলাই তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ ডিগ্রিতে ভূষিত করে। ১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ‘বিশ্বভারতী’ থেকে তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ সম্মানে ভূষিত করে। ২০০০ সালে ৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিজপোর্ট ইউনিভার্সিটি শেখ হাসিনাকে মানবাধিকার বিষয়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সুদীর্ঘ ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধ অবসানের ক্ষেত্রে তাঁকে ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কো ‘হাটপাউয়েট-বোজনি’ শান্তি পুরস্কার প্রদান করে। তাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সাহসিকতা ও দূরদির্শতার জন্যও রয়েছে কিছু সম্মাননা। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তাঁর ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনোর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ শেখ হাসিনাকে সম্মানজনক ‘চেরেস’ মেডেল প্রদান করে। সর্বভারতীয় শান্তিসংঘ তাঁকে ১৯৯৮ সালে ‘মাদার তেরেসা’ পদক প্রদান করে। বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও গণতন্ত্র প্রসারে তাঁর অবদানের জন্য নরওয়ের ওসলোতে অবস্থিত মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ফাউন্ডেশন তাঁকে ‘গান্ধী পদক’ প্রদান করে।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। দিনবদলের অঙ্গীকার নিয়ে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে দেশের দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় এসেই প্রধানমন্ত্রী দেশের বন্ধ থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান চালু করার উদ্যোগসহ নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। গতবছর রংপুর বিভাগ ঘোষণা করা হয়। দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু নির্মাণেরও প্রস্তুতি চলছে। বেশকিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।  সাফল্যের ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা দেশ-বিদেশে নানা পুরস্কার গ্রহণ করেন। বর্তমান মহাজোট সরকার বাংলাদেশের শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস করার সাফলের জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য(এমডিজি) অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ থেকে বাংলাদেশের  পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে সাধারণ পরিষেদর ৬৬তম অধিবেশনে(ইউএনজিএ) যোগ দেয়ার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র সফরে আছেন। ১৬ সেপ্টেম্বর  তিনি ঢাকা থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করেন। সফরে তিনি বিশ্ব মহিলা ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নের অবদানের জন্য ‘সাউথ সাউথ এওয়ার্ড’ অর্জন করেন। ১১ দিনের সরকারি সফর শেষে ২৮ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরার কথা রয়েছে। তিনি ‘জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’এর সভাপতি। লেখক হিসেবেও রয়েছে তাঁর পরিচয়। ‘ওরা টোকাই কেন?’, বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’, ‘দারিদ্র বিমোচন’, ‘কিছু ভাবনা’, ‘আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম’, ‘আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি’, ‘সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র’, ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ এবং ‘বিপন্ন গণতন্ত্র লাঞ্ছিত মানবতা’ উল্লেখযোগ্য। প্রধানমন্ত্রীর ৬৫ তম জন্মদিনে রইলো অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা। শুভ জন্মদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

রিয়াজ উদ্দিন, সংবাদকর্মী ও শিক্ষার্থী (মাস্টার্স ১ম সেমিস্টার, ইংরেজি বিভাগ)
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।