কৃষক আহছান উল্লাহর এবারের উদ্ভাবন – গাছের পাতা তাড়াবে ইদুর, মশা ও ক্ষতিকারক পোকা

গৌরনদী ডটকম ॥ শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলে, কৃষকেরা জাতির হৃদপিন্ড। ফিরে চলো মাটির টানে, যে কোন দানই ভিক্ষার সমান বলছিলেন, বরিশালের আহসান উল্লাহগৌরনদী উপজেলার উত্তর পালরদী গ্রামের কৃষক মোঃ আহছান উল্লাহ। যিনি ক্যামিকেল ও বিষাক্ত রাসায়নিক সার আর কীটনাশকের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি একের পর এক উদ্ভাবন করেছেন বিভিন্ন পরিবেশ সম্মত সার, কীটনাশক ও প্রযুক্তি। বর্তমানে তিনি উদ্ভাবন করেছেন গাছের পাতা দিয়ে ইদুঁর, মশা ও ক্ষতিকারক পোকা তাড়ানোর পরিবেশ সম্মত প্রতিরোধক। এছাড়াও তার উদ্ভাবনার মধ্যে আকর্ষনীয় হচ্ছে দেশের একটি পরিত্যক্ত মাছ। যে মাছ কেউ খায়না অথচ সেই মাছ এডিস মশার লারভা নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। এরপূর্বেও তিনি (আহছান উল্লাহ) ভেষজ পদ্ধতিতে কৃষি কাজের একাধিক উদ্ভাবন করে দেশব্যাপী বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।

বহুমুখী গুনের অধিকারী কৃষক আহছান উল্লাহ সুযোগ পেলেই ছুঁটে চলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। আর সাধারন মানুষের মাঝে প্রচার করেন, ক্যামিকেলের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে। তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তৈরী করেছেন কৃষক সংগঠন। যারা এখন পরিবেশ সম্মতভাবে কৃষি কাজ করছেন। মসজিদ, মন্দির, গীর্জাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিনি বিনামূল্যে প্রায় ৫০ হাজার গাছের চারা বিতরন করেছেন। যার মধ্যে চন্দনসহ বিভিন্ন ঔষধি, বনজ ও ফলজ গাছের চারা রয়েছে। তবে সেগুলো তিনি শর্তসাপেক্ষ দান করেছেন। তার শর্ত হচ্ছে ভোক্তারা ওইসব গাছে কোন রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করতে পারবেন না।

তিনি নিজ বাড়িটিকে কৃষকদের জন্য পরিবেশ সম্মতভাবে কাজ করার জন্য একটি গবেষনাগার হিসেবে ব্যবহার করছেন। অর্থনৈতিক টানাপোরনের কারনে পৈত্রিকভাবে পাওয়া বাড়িটিকে উৎসর্গ করেছেন কৃষকদের জন্য। সপ্তায় একদিন বাড়িতে কৃষকদের নিয়ে আলোচনা সভা করেন এবং কৃষকদের বিষাক্ত কীটনাশকের ভয়াবহতা সম্পর্কে  বিভিন্ন পরামর্শ ও তার নিজের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। ইতিমধ্যে তিনি অনেক নারীকেও কৃষি কাজে সম্পৃক্ত করেছেন। তার নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় রয়েছে প্রায় দু’শতাধিক দুর্লভ প্রজাতীর ফলজ, বনজ ও ঔষধী গাছ। এসব গাছে তিনি কোন রাসায়নিক বা ক্যামিকেল ব্যবহার করেন না। কোন পৃষ্টোপোষকতা বা প্রতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়াই কৃষকদের মাঝে কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিভাবান কৃষক আহছান উল্লাহ। তার চিন্তা পরিবেশ সম্মত কৃষি আর কৃষিকে সম্মান জনক পেশায় পরিনত করার।

মানুষকে পরিবেশ সম্মত কৃষিতে আগ্রহী করার তার প্রচেষ্ঠা যেন এটি জীবন্ত  ইতিহাস। অথচ তার এ প্রচেষ্টার পাশে কেহই আজ পর্যন্ত এগিয়ে আসেননি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বিভিন্ন সময় আমাকে নিয়ে একাধিকবার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে বিভিন্নজন এসেছেন আমার প্রযুক্তি কিনতে। এ দেশের কৃষি আর কৃষকের জন্য প্রয়োজনে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেব, তবু প্রযুক্তি বিক্রি করবো না।  

দেশের কৃষি ভাবনা নিয়ে কিছু জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের রয়েছে খাদ্য সমস্যা। এ সমস্যার কথা ভাবলে দুটি দিক দেখা যায়। প্রথমতো খাদ্যের পরিমাণগত সমস্যা, খাদ্যের পুষ্টিগত সমস্যা। খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কৃষি দপ্তর গবেষণা ও পরিকল্পনা করে চলছে। তাছাড়া খাদ্যের উৎকর্ষ বৃদ্ধির দিকেও নজর দেয়া হচেছ। এর ক্ষেত্র আরো বহুগুন বাড়িয়ে দিতে হবে। ভিক্ষুকের রান্না ঘর থেকে রাজ দরবার পর্যন্ত কৃষকের বন্ধন করতে হবে বন্ধু সুলভ। পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ উৎপাদনকারীদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ তারা আমাদের নিকট অনেক মূল্যবান। এমনকি গবেষকদের চেয়েও বেশী, কেননা গবেষকরা যা দিতে পারেনা একজন কৃষক তা দিতে সক্ষম হয়েছে। যদিও শ্রেষ্ঠ কৃষিপন্য উৎপাদনকারীকে সরকারীভাবে পুরস্কৃত করা হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এগুলো আরো বাড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকদের বিভিন্ন উদ্ভাবন বা বিশেষ জ্ঞানকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করে প্রত্যেক গ্রামে শ্রেষ্ঠ উৎপাদনকারী দ্বারা তার আশপাশের অন্তত ১০ জন কৃষককে হাতে কলমে বাস্তব শিক্ষা দিয়ে শ্রেষ্ঠ উৎপাদনকারী হিসেবে তৈরি করতে হবে। আবার প্রথম বৎসরে হাতে কলমে বাস্তব শিক্ষাপ্রাপ্ত ১০ জনের দ্বারা পরবর্তী বৎসরে আরো ১০ জনকে একই নিয়মে হাতে কলমে বাস্তব শিক্ষা দিয়ে প্রত্যেকের জমিতে শ্রেষ্ঠ ফসল উৎপাদনে সাহায্য করার ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে প্রত্যেক চাষী তার প্রতিবেশী শ্রেষ্ঠ উৎপাদনকারী বলে প্রমানিত নিজেদেরই মতো একজন চাষীর নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত হবে বলে এ শিক্ষা খুবই ফলপ্রসু হবে। উপরোক্তভাবে কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম কয়েক বছর চালাতে পারলে দেশের সর্বত্রই শ্রেষ্ঠ ফসল ফলানো সম্ভব হবে। ধান, পাট ও অন্যান্য সব ফসলের উন্নয়ন একই নিয়মে এবং একই সময়ে করা যেতে পারে। তাহলে ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে আমাদের দেশে কোন কৃষকই উন্নত কৃষি ব্যবস্থায় অজ্ঞ থাকবে না এবং আমাদের দেশও কৃষি ব্যবস্থাপনায় একটি মডেল হবে। আমাদের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে। যেমন- ধান, গম, পাট ইত্যাদিতে স্বয়সম্বর হলে আমাদের কৃষির সব সমস্যা মিটে যাবে, কিন্তু এ ধারণা ভুল। ধান, গম, পাট এসবের পাশাপাশি ডাল, তেল, ফল, শাক-সবজি জাতীয় কৃষির উপর একই গুরুত্ব প্রদান করে, এগুলোর উৎপাদনও বাড়িয়ে দিতে হবে। মৎস্য ও পশু সম্পদের দিকে একই গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। দরকার শুধু আন্তরিকতা ও সম্মিলীত প্রচেষ্টা। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপশি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি কেন্দ্রীক পৃষ্ঠপোষকতা বাড়িয়ে দিতে হবে। কৃষকদেরও পরনির্ভশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যেকোন দানই ভিক্ষার শামীল। উদ্ভিদ, গাছ-পালা, লতা-পাতার ওপর সম্পূর্ন নির্ভরশীল হয়েও মানুষ যদি তা স্বীকার না করে তাহলে অকৃতজ্ঞ বা অজ্ঞ বলা কী বেশী হবে ? এরা যদি মানুষের মতো কথা বলতে পারতো, অনুভব করতে পারতো, ভাবতে পারতো তাহলে তারা আমাদের আনুগত্য ও সমীহ আদায় করে নিতো। তাই কৃষি ক্ষেত্র থেকে কীটনাশক, বালাই নাশক, রাসায়নিক সার ব্যবহারে জিন-প্রযুক্তির উচ্চ ফলনশীল শস্য পৃথিবীব্যাপী পরিতাজ্যের তালিকায় চলে যাচ্ছে। রোগে শোকে মানুষ প্রচলিত বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার পরিবর্তে বিকল্প ভেষজ চিকিৎসার দারস্ত হচ্ছে। সে কারনে এখন দুনিয়া জুড়ে জৈব কৃষি অর্গানিক খাবার, আর ভেষজ চিকিৎসার বিজয় কেতন উড়ছে নতুন করে।

বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমরা সৌভাগ্যবান কারণ মানবদেহে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত সকল ভেষজ বৃক্ষ, লতা, গুল্মর অবারিত জন্ম হয় বাংলাদেশের মাটিতে। আমাদের দেশের মানুষের প্রয়োজন শুধু এ সব গাছ-পালা, লতা-পাতা, ফুল-ফল চিনে নেয়া এবং আমাদের কৃষকজনকে আদি অকৃতিম প্রাকৃতিক জৈব চাষাবাদে ফিরিয়ে নেয়া। পাশাপাশি মরনমুখি রাসায়নিক প্রযুক্তিকে কৃষিজ উৎপাদন থেকে চিরতরে বিদায় দেয়া। এ কাজ খুব কঠিন কিছু নয়। প্রয়োজন শুধু একটি পদক্ষেপ।

সর্বপরি এ প্রতিভাবান কৃষক আহছান উল্লাহ তার বাড়ির পার্শ্বে একটি কৃষক স্কুলও চালু করে ছিলেন, কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যার কারনে সম্প্রতি স্কুলটি বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, যদি পৃষ্টেপোষকতা পেতাম তাহলে এ দেশের মানুষকে বুঝানো সহজ হতো, পরিবেশ সম্মত কৃষি আমাদের বাঁচার তাগিদে কতোইনা প্রয়োজন।