ষ্টিভ জবসের কাছ থেকে আমি যা শিখেছি – গাই কাওয়াসাকি

প্রিয় টেক: গাই কাওয়াসাকি সিলিকন ভ্যালীর একজন সফল উদ‌্যোক্তা এবং লেখক। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম গ্যারেজ.কম, এবং অনলাইন ম্যাগাজিন অলটপ.কম। সরাসরি কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন ষ্টিভ জবসের সাথে, ম্যাকিন্টোশ প্রজেক্টে। তার লেখা বই অসংখ্য উদ্যোক্তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। গাই কাওয়াসাকি সিনেট-এ ব্লগে লিখেছেন, তিনি ষ্টিভ জবসের কাছ থেকে কি কি জিনিস শিখেছেন। বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তির উদ্যোক্তা এবং নতুন প্রজন্মের মানুষদের জন্য আমি সেই লেখাটি অনুবাদ করে দিচ্ছি। যারা বাংলাদেশে ষ্টার্ট-আপ দিতে চায়, কিংবা হাইটেকে নতুন কিছু করতে চায়, তাদের জন্য অবশ্যই শিক্ষনীয় এটি।

গাই কাওয়াসাকি বলেছেন, "আমি চাই না কোনও শিক্ষা হারিয়ে যাক। এই হলো আমার ১২টি শিক্ষা যা আমি ষ্টিভ জবসের কাছ থেকে শিখেছিলাম।" ষ্টিভ জবসের মতো গাই কাওয়াসাকিও আমার একজন খুব পছন্দের মানুষ। তাই তার ১২টি শিক্ষা থেকে আপনারাও কিছু কিছু বিষয় নিতে পারেন। আপনাদের কোনও প্রশ্ন থাকলে নীচে মন্তব্য লিখতে পারেন। আমি চেষ্টা করবো সেগুলোর উত্তর দিতে। আর লেখাটি উপকারী হলে, দয়া করে অন্যদের সাথে শেয়ার করুন। আমি চাই, বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েদের ধ্যান-ধারনা অনেক উচু হোক; বিশ্বকে জানুক তারা। লেখাটি কারো কাজে লাগলে, আমার পরিশ্রম সার্থক হবে; গাই কাওয়াসাকিও খুশি হবেন।

১. বিশেষজ্ঞদের কোনও আগামাথা নেই
বিশেষজ্ঞমহল – সাংবাদিক, বিশ্লেষক, কনসাল্টেন্ট, ব্যাংকার, এবং গুরুরা কিছু করতে পারেন না, তাই তারা উপদেশ দেন। আপনার পণ্যে কী সমস্যা আছে সেটা তারা বলতে পারেন, কিন্তু তারা নিজেরা কোনও পণ্য বানাতে পারেন না। তারা বলতে পারেন কিভাবে একটা কিছু বিক্রি করা যেতে পারে, কিন্তু তারা নিজেরা কিছুই বেঁচতে পারেন না। তারা বলতে পারেন, কিভাবে একটা চমৎকার টিম তৈরী করা যায়, কিন্তু তারা তাদের সেক্রেটারীকে ম্যানেজ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না। বিশেষজ্ঞরা কী বলেন, সেটা শুনুন; তবে সব কিছু পালন করতে যাবেন না।

২. কাষ্টমাররা আসলে বলতে পারে না, তারা কী চায়
আপনি যদি আপনার কাষ্টমারকে জিজ্ঞেস করেন, তারা কী চায় – তাহলে উত্তর আসবে, "আরো ভালো, দ্রুততর এবং কম মূল্য।" তারা কখনই নতুন উদ্ভাবনীর কথা বলতে পারবে না। তারা যা ব্যবহার করছে, কেবলমাত্র সেটার আলোকেই নতুন ফিচারের কথা বলতে পারবে যা হবে আরেকটু ভালো, আরো বেশি দ্রুত এবং দাম আগের চেয়ে কম।

৩. পরবর্তী কার্ভে ঝাপ দাও
যদি বড় ধরনের সফলতা চাও, তাহলে নতুন কার্ভে ঝাপ দাও। সবাই যা করছে, সেটার ভেতর হাত দিও না। এবং কেবলমাত্র নতুন কিছু ফিচার এনে নতুন পণ্য তৈরী করো না। উদাহরণ স্বরূপ, যখন সকল ডেইসী-হুইল প্রিন্টার কম্পানীগুলো আরো বেশি ফন্টের কথা ভাবছিল, তখন অ্যাপল নিয়ে আসে লেজার প্রিন্টার। একেবারে নতুন কিছু যা মানুষকে উদ্দিপ্ত করে। আবার যখন নকিয়ার মতো মোবাইল ফোন কম্পানী ভাবছিল নতুন ভার্সনের ফোন, তখন অ্যাপল নিয়ে আসে আইফোন – যা পুরো গেমটাই পরিবর্তন করে দেয়।

৪. সর্বশ্রেষ্ঠ্য কাজটিকে অতিক্রম করা খুবই কঠিন
আমি সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম, কখন ষ্টিভ বলে বসে, আমি কিংবা আমার কাজ হলো ক্র্যাপ। এবং ষ্টিভ সেটা জনসম্মুখেই বলে দিতে পারে। আমার এই ভয়টাকে কাটানো ছিল বিশাল একটি চ্যালেঞ্জ। আইবিএম এবং পরবর্তীতে মাইক্রোসফটের সাথে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার জন্য আমাকে, আমার আগে যারা অ্যাপলে কাজ করেছেন, এবং আমার পরে যারা অ্যাপলে কাজ করেছেন – সবাইকে তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ্য কাজটি উপহার দিতে হয়েছে।

৫. ভালো ডিজাইন
প্রডাক্ট ডিজাইনের ব্যাপারে ষ্টিভ বিভিন্ন সহকর্মীর জীবন ছারখার করে ফেলেছেন – কালো রঙের একটি শেড তো সঠিক কালো নয়, তাই না? ষ্টিভ ছিল একজন পারফেক্টশনিষ্ট – কালো রঙটা কালোই হতে হবে। যখন পণ্য ডিজাইন করা হবে, সেটা যেন পারফেক্ট হয়। কোনও রকম জোরাতালিতে ভালো কিছু হয় না।

৬. বড় গ্রাফিক্স এবং বড় ফন্টে ভুল হতে পারে না
আপনি কি কখনও ষ্টিভের প্রেজেন্টেশন দেখেছেন? তার স্লাইড দেখেছেন? ওর ফন্ট হলো ৬০ পয়েন্টের। সে বড় বড় গ্রাফিক্স ব্যবহার করে। কিন্তু অন্যান্য বড় বড় প্রেজেন্টারের স্লাইড দেখুন। তাদের ফন্ট সাইজ হলো ৮ পয়েন্ট; কোনও গ্রাফিক্স নেই। মানুষ মনে করে, প্রডাক্ট প্রেজেন্টেশনে ষ্টিভ হলো এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। একবার কি ভেবে দেখেছেন, কেন অন্যরা ষ্টিভের এই ষ্টাইলকে কপি করছেন না?

৭. মন পরিবর্তন করাটা বুদ্ধিমত্তার চিহ্ন
প্রথম যখন আইফোন বাজারে ছাড়া হয়, তখন অ্যাপস (apps) বলে কিছু ছিল না। ষ্টিভ মনে করতেন, অ্যাপস হলো খারাপ একটি জিনিস – কে যে কী তৈরী করবে, আর সেগুলো চলবে মানুষের ফোনে! ষ্টিভ এই আইডিয়া প্রথমে বাদ দিয়ে দেন। প্রথম অ্যাপস ছিল সাফারি। সেখান থেকেই শুরু। তারপর মাত্র ছয় মাসের মাথায় ষ্টিভ রাজী হয়ে যান। কেউ একজন তাকে বুঝাতে পেরেছিল যে, অ্যাপস-ই হলো ভবিষ্যত।

৮. ভ্যালু আর মূল্য এক জিনিস নয়
ভ্যালু আর মূল্য এক জিনিস নয়। কখনই কেবলমাত্র দাম দিয়ে প্রতিযোগিতা করা ঠিক না। এটা বলা নিরাপদ যে, দাম কম বলে কেউ অ্যাপল পণ্য কেনে না। ভ্যালুর সাথে যোগ হয় ট্রেনিং, কাষ্টমার সাপোর্ট ইত্যাদি বিষয়গুলো।

৯. "এ" টাইপের খেলোয়ার "এ+" টাইপের খেলোয়ারদের নিয়োগ দেয়
ষ্টিভ বিশ্বাস করতেন যে, একজন ভালো খেলোয়ার যখন তার টিমে নতুন খেলোয়ার নিয়োগ দেবেন, তখন তিনি তার সমপর্যায়ের আরেকজন ভালো খেলোয়ারকেই নিয়োগ দেবেন। অনেক সময়, তিনি তার চেয়েও ভালো খেলোয়ারকে নিয়োগ দেবেন। কিন্তু "বি" টাইপের খেলোয়ারা "সি" টাইপের খেলোয়ার নিয়োগ দেবেন, যাতে তিনি নিজেকে সুপিরিয়র মনে করেন। আর "সি" টাইপের খেলোয়ার নিয়োগ দেবে "ডি" টাইপের খেলোয়ারদেরকে। আপনি যদি "বি" টাইপের লোকজন নিয়োগ দেন, তাহলে সেই কম্পানীটি হবে বোকাদের স্বর্গরাজ্য।

১০. সিইও হিসেবে প্রডাক্ট ডেমো করা
ষ্টিভ জবস বছরে দু'তিন বার আইপড, আইফোন, আইপ্যাড ইত্যাদি প্রডাক্টগুলো ডেমো করতেন যা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ দেখতো। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, অন্য কম্পানীগুলোর সিইও-রা এটা না করে, তারা তাদের ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগের ভাইস-প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আসেন প্রডাক্ট ডেমো করতে। এর মূল কারন হলো, তাদের সিইও জানেন না তার পণ্যটি আসলে কী করে। কতটা দূর্ভাগ্যজনক এটি?

১১. প্রডাক্ট বাজারে ছাড়া
ষ্টিভ সব সময়ই প্রডাক্ট বাজারে ছাড়তে পারতেন। সব সময় হয়তো সব প্রডাক্ট খুব ভালো ছিল না। কিন্তু তবুও তিনি পণ্যটি বাজারে ছেড়েছেন। পণ্যগুলো হয়তো মোটামুটি ঠিকই ছিল। তিনি চাইতেন, বাজার রক্ষা করতে, নতুন বাজারে প্রবেশ করতে। অ্যাপল একটি ইঞ্জিনীয়ারিং-কেন্দ্রিক কম্পানী, গবেষণা কম্পানী নয়। আপনি কোন কম্পানীটি বানাতে চান? অ্যাপল নাকি জেরক্স পার্ক (যারা কেবল গবেষণাই করে যায়, কিন্তু বাজারে সেটা ছাড়তে পারে না)?

স্বাতন্ত্র + ভ্যালু = চমৎকার বাজার

১২. স্বতন্ত্র ভ্যালুটা খুজে বের করুন
একটা দুইxদুই ম্যাট্রিক্স নিন। উপর-নীচের রেখাটি বুঝায়, আপনার পণ্যটি অন্য পণ্যের তুলনায় কতটা স্বতন্ত্র। আর সমান্তরাল রেখাটি বুঝায় আপনার পণ্যটির ভ্যালু কেমন। ডান দিকের নীচের ঘরটি হলো – আপনার পণ্যটির স্বাতন্ত্র নেই, তবে ভ্যালু আছে। এক্ষেত্রে আপনাকে দাম দিয়ে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। এখানে আপনি টাকা বানাতে পারবেন না।

বা'দিকের উপরের ঘরটিতে – আপনার পণ্যটির স্বাতন্ত্র আছে, কিন্তু ভ্যালু নেই। আপনি এমন একটি মার্কেট পাবেন যার কোনও অস্তিত্ব নেই।

বা'দিকের নীচের ঘরটিতে – স্বাতন্ত্র নেই, আবার ভ্যালুও নেই। আপনি একটা বোকার হদ্দ।

ডান দিকের উপরের ঘরটিতে – স্বাতন্ত্র এবং ভ্যালু দুটোই আছে। এখানেই আপনি বানাতে পারবেন টাকা, মার্জিন, মুনাফা এবং ইতিহাস। উদাহরণ: আইপড – এটা ছিল স্বতন্ত্র প্রডাক্ট; এবং এটার মাধ্যমে বৈধভাবে ডিজিটাল মিউজিক ডাউনলোড করা শুরু হলো।

বোনাস: নিজের উপর বিশ্বাস থাকতে হবে
আপনি যখন পরবর্তী কার্ভের উপর ঝাপ দেবেন, আবার বিশেষজ্ঞদের কথা কানে নেবেন না, বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন, ডিজাইনের ব্যাপারে অবসেশন থাকবেন, এবং প্রডাক্টের স্বতন্ত্র ভ্যালু বের করতে চাইবেন – এতো কিছু করতে হলে অন্য মানুষকে বুঝাতে হবে যে আপনি যা করছেন সেটাতে আপনার বিশ্বাস রয়েছে। সবাই যে আপনাকে বিশ্বাস করবে তা নয়। তবে, এই পৃথিবীর কোনও কিছুর পরিবর্তন আনতে হলে প্রথমে কিছু সংখ্যক মানুষের মন পরিবর্তন করলেই চলে।

আমি এগুলোই ষ্টিভ জবসের কাছ থেকে শিখেছি। তার আত্মা এটা জেনে শান্তিতে থাকুক, এই পৃথিবীকে কতটা বদলে দিয়েছিল সে।

source : tech.priyo.com