আওয়ামী লীগ, তুমি কার?

সোহরাব হোসেনঃ সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, তাঁরা এখনো বিরোধী দলে আছেন। দেশে যেকোনো অঘটন ও সমস্যার দায় বিরোধী দল ও গণমাধ্যমের ওপর চাপালেই যেন তাঁদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়।

সরকারের কোনো ব্যর্থতা, দুর্বলতার কথা বললেই মন্ত্রীরা বিগত বিএনপি সরকারের উদাহরণ টানেন। ভাবখানা এমন যে, ‘ওরা দশটা মেরেছে, আমরা তো মাত্র পাঁচের চৌকাঠই পার হইনি, এখনই আমাদের সমালোচনা করা কেন?’ সন্ত্রাস ও দুর্নীতি এমনই ভয়ংকর সংক্রামক যে তা মুহূর্তেই মহামারিতে রূপ নিতে পারে।

সরকারের প্রথম বছরে মন্ত্রীরা বিরাট বিরাট প্রকল্পের তালিকা তৈরি করলেন, পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়া হয়ে যাবে বলে দেশবাসীকে খোয়াব দেখালেন। দ্বিতীয় বছরে এসে বললেন, বিএনপি-জামায়াত দেশটাকে শেষ করে দিয়েছে। দেশের জন্য কিছু করতে গেলেই ওরা ষড়যন্ত্র করে।

সরকারের জনপ্রিয়তা যত কমতে থাকে, ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব তত ডালপালা মেলতে থাকে। মন্ত্রীরা যখন বলেন, আমরা সবেমাত্র ক্ষমতায় এসেছি, সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার জন্য একটু সময় তো দিতে হবে। জনগণ তাতে আপত্তি করেনি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে যখন বললেন, ‘তিন বছরে আমি কিছু দিতে পারব না’, জনগণ কিন্তু তা হূষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের হা-ভাতে নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধুকে সেই সময় দেননি। তাঁরা দেশে ফিরেই ‘যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য’ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। খুনোখুনিতে মাতলেন। মহসীন হলে সাত খুন তার একটি উদাহরণ মাত্র।

এবারও শেখ হাসিনা যতই দিনবদল ও ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখান না কেন; ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মী-ক্যাডাররা দখলবাজি-টেন্ডারবাজিতে নিয়োজিত হলো। শেখ হাসিনা যাঁদের ‘নবীন ও নিষ্পাপ’ নেতা হিসেবে প্রার্থী করেছিলেন, নির্বাচনে জিতেই তাঁরা একেকজন মোগল সম্রাট হয়ে বসেন। বিএনপির আমলে বিএনপির সাংসদেরা যে ধরনের মাস্তানি, দখলবাজি করতেন; আওয়ামী লীগের আমলে আওয়ামী লীগের সাংসদেরাও তা-ই করছেন। তখন জাতীয়তাবাদী জনসেবকেরা রাজমুকুট পরতেন। এখন বঙ্গবন্ধুর সাচ্চা সেনারা সোনার নৌকা উপহার নিচ্ছেন।

সরকারের মেয়াদ ইতিমধ্যে প্রায় ৩৩ মাস পার হয়ে গেছে। কিন্তু বড় কোনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণেও তাদের চেষ্টা নেই। রুটিন-কাজ করছে মাত্র। আমরা কথা বলছি তথ্যপ্রমাণ সামনে রেখে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রথম পাঁচ অগ্রাধিকারে ছিল: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের সমাধান, দারিদ্র্য ঘুচাও ও বৈষম্য রুখো, এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এখন পাঠকই বিচার করুন, সরকার কোন কোন ক্ষেত্রে তার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করতে পেরেছে, কোন কোন ক্ষেত্রে পারেনি। সরকার এক শ ভাগ সফল হবে সেই দাবি কেউ করে না। কিন্তু মানুষ দেখতে চায় সরকার যা বলছে, তা করতে আন্তরিক কি না?

প্রথম দুই বছর সরকার কিছু কিছু ভালো কাজ করলেও তৃতীয় বছরের শেষ দিকে এসে সবকিছু ওলট-পালট করে ফেলছে। মনে হচ্ছে, সরকার যেখানে হাত দেয়, সেখানেই জট বাঁধে। ফলে মন্ত্রীরা আত্মরক্ষার জন্য বিরোধী দলকে গালমন্দ করতেই বেশি সময় ব্যয় করছেন। এর অর্থ এই নয়, বিএনপি-জামায়াত জোট দেশটা ভালো চালিয়েছিল। বরং তুলনা করলে এখনো অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ আগের সরকারের দুর্নীতি-সন্ত্রাসের রেকর্ড ভাঙতে পারেনি। কিন্তু মন্দ সূচক কমানোই সুশাসনের লক্ষণ নয়।

বিএনপি ২০০১-২০০৬ সালে দেশ ভালো চালাতে পারেনি, জনগণের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি বলেই মানুষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। ভালো কিছু পাবে—এই আশা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে। অথচ আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা সেই পুরোনো ভাঙা রেকর্ডই বাজিয়ে চলেছেন—বিএনপির আমলে এটা হয়নি-ওটা হয়নি। আমরা করব, করছি। এই করছি, করবর সরকার চাই না। আমরা এমন একটি সরকার চাই, যারা মুখে নয়, কাজ করে দেখাবে। জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা পূরণ করবে।

আওয়ামী লীগের নেতাদের বড় অভিযোগ, বিএনপি মৌলবাদী জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করেছে, ২০০১ সালে ১০ টাকা কেজি রেখে এলেও বিএনপি সরকার ৪০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। বিএনপি জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। নির্বাচন কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আজ্ঞাবহ করেছিল। এসব অভিযোগ জনগণের জানা এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে তার ফয়সালাও হয়ে গেছে। এখন ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে লাভ কী?

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনের আগেই উন্নয়নের একটি রূপকথা উত্থাপন করেছিল—যার নাম দেওয়া হয়েছিল দিনবদল। কিন্তু ক্ষমতার আড়াই-পৌনে তিন বছর পর মন্ত্রী, দল, নেতা-কর্মী, ক্যাডারদের ‘দিনবদল’ হলেও সাধারণ মানুষের দিনবদল হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের উন্নয়নে ও মানুষের কল্যাণে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু সেই কাজের ফল তো এখনো দৃশ্যমান নয়। মহাজোট সরকার মোটা দাগে যেসব প্রতিশ্রুতি জনগণকে দিয়েছিল, তার কটি পূরণ হয়েছে, কটি হয়নি, কেন হয়নি—এখন তার হিসাব দেওয়ার সময় এসেছে। আর হিসাব না দিলে জনগণ ভোটের সময় তা কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নেবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। দায়িত্ব নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছিলেন, সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, যোগাযোগমন্ত্রীই পদ্মা সেতুর প্রধান বাধা। বিশ্বব্যাংক সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এই মন্ত্রী থাকতে তারা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করবে না। বিশ্বব্যাংক না করলে এডিবি, জাইকাসহ অন্যান্য দাতা সংস্থাও পিছিয়ে যাবে। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ—বিতর্কিত ও অভিযুক্ত মন্ত্রীকে বহাল রাখা, নাকি কোটি কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন?

সরকারের আরেকটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখা। কিন্তু বাজার-পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এর পেছনে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটদের যেমন কারসাজি আছে, তেমনি আছে সরকারের খবরদারির অভাব। বাণিজ্যমন্ত্রী কথা বললেই পণ্যের দাম বাড়ে। তিনি ব্যবসায়ীদের ইমানের পরীক্ষা নেন, আর সাধারণ মানুষের পকেট কাটা যায়।

আওয়ামী লীগের আরেকটি প্রতিশ্রুতি ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং জনজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আওয়ামী লীগের নেতারা হয়তো বলবেন, বিএনপি-জামায়াতের আমলে গোটা দেশে জঙ্গিদের উৎপাত ছিল, বোমাবাজি ছিল। এখন সেই অবস্থা নেই। কিন্তু এখনো তো মানুষ খুন হচ্ছে, গুম হচ্ছে, অপহূত হচ্ছে, ক্রসফায়ারে মারা যাচ্ছে। এসব কি আইনশৃঙ্খলার উন্নতির লক্ষণ?

এই সরকারের আমলে যে বিষয়টি জনগণকে মহা বিপাকে ফেলেছে, সেটি হলো শেয়ারবাজার। পুঁজিপাট্টা হারিয়ে হাজার হাজার খুদে বিনিয়োগকারী পথে বসেছেন। দুজন বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা করেছেন বলেও পত্রিকায় খবর এসেছে। কিন্তু সরকার এর প্রতিকারে কিছুই করেনি। বরং তদন্ত কমিটি যাঁদের প্রতি সন্দেহের তীর ছুড়েছিল, তাঁদের এসইসিতে জামাই আদরে বসানো হয়েছে। সরকার কি মনে করে আগামী নির্বাচনে এই লাখো লাখো খুদে বিনিয়োগকারীর দীর্ঘশ্বাসের প্রতিফলন পড়বে না? অবশ্যই পড়বে। এখন শেয়ারবাজার মানেই মস্ত বড় আতঙ্ক। এক দিন দাম বাড়লে এক সপ্তাহ ধরে কমতে থাকে।

সরকার খুব জোরের সঙ্গে বলেছিল, ভারতের সঙ্গে সব বিরোধের নিষ্পত্তি হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের জানুয়ারিতে দিল্লিতে গিয়ে যৌথ বিবৃতিতে সই করলেন, দুই দেশের মধ্যকার সমস্যাগুলোর সমাধানের রূপরেখাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই রূপরেখা অনুযায়ী কাজ হয়নি। বিশেষ করে, যে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে এত শোরগোল, এত আলোচনা—সেই চুক্তিটিও ঝুলে আছে।
গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী নীলফামারীর জনসভায় বলেছেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হবে। আমাদের প্রশ্ন—কবে হবে? এখন শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ পানি বণ্টনের সঙ্গে জ্বালানি খাতের উন্নয়নও যুক্ত করতে চায়। প্রশ্ন হলো, নতুন প্রেক্ষাপটে আলোচনা করতে গেলে তিস্তার সমস্যাটি আরও বেশি অনিশ্চিত হবে কি না?

এ রকম আরও অনেক খাত ও প্রকল্প আছে, যা ক্ষমতায় আসার পর সরকার বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেগুলো কবে বাস্তবায়িত হবে, কেউ জানে না।

গতকালের পত্রিকায় দেখলাম, দাতাদের সঙ্গে নির্ধারিত উন্নয়ন ফোরামের বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে। কারণ জানানো হয়নি। এর অর্থ কি উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আমাদের নানারকম ঝামেলা চলছে? না হলে নির্ধারিত বৈঠক পেছাবে কেন?

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ যে মহানাটক মঞ্চস্থ করল, তার রেশ এখনো শেষ হয়নি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুজন প্রার্থী ছিলেন—সেলিনা হায়াত আইভী ও শামীম ওসমান। দুজনই খ্যাতিমান, তবে দুই কারণে।

মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দলের পক্ষ থেকে জানানো হলো, দল কাউকে সমর্থন করছে না। কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দলের তিন সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম ওসমানের সভায় গিয়ে সমর্থন জানিয়ে আসেন।

এদিকে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, দলীয়ভাবে কাউকে সমর্থন দেওয়া হয়নি। যাঁরা একজন প্রতিনিধির পক্ষে বক্তৃতা দিয়েছেন, তাঁরা ব্যক্তিগতভাবেই করেছেন। শুক্রবার দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও একই বাণী দিয়েছেন।

আমাদের প্রশ্ন, আওয়ামী লীগের এই স্ববিরোধী ভূমিকা কেন? তারা যা বলে, কাজ করে তার বিপরীত। অথবা আওয়ামী লীগের ভেতরে এমন কোনো শক্তি আছে, যারা দলের সিদ্ধান্ত উল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

সবকিছু দেখে একটি প্রশ্নই মনে জাগে—আওয়ামী লীগ, তুমি কার?