কিসের অগ্রাধিকার, ল্যাপটপের না পাঠাগারের?

বদরুল ওপরঃ স্বার্থান্ধ হলে এবং আত্মপ্রচারের জন্য অর্থাত্ বলা চলে স্বার্থান্ধ আত্মপ্রচারের জন্য দুর্নীতিপরায়ণ নিম্ন সংস্কৃতির লোক কতকিছুই না করে। যারা শুধু ক্ষমতাচর্চা করার জন্যই রাজনীতি করে, ক্ষমতায় বসে থাকে অথবা ক্ষমতায় বসার জন্য প্রাণপাত করে, তাদের মধ্যেই এটা দেখা যায় সব থেকে বেশি। এই আত্মপ্রচারের একটা দিক হলো, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বেপরোয়া প্রতিশ্রুতি প্রদান এবং অন্যদিক হলো, এমন সব চটকদার কাজ করা যার কোনো প্রকৃত মূল্য না থাকলেও প্রচারমূল্য আছে। বাংলাদেশে এখন জনগণের জন্য করার কতকিছু আছে তার হিসাব নেই। যেদিকেই তাকানো যায় সেদিকেই সমস্যা। এই অন্তহীন সমস্যার সাগরে মানুষ এখন হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু যারা ক্ষমতায় আছে ও যারা ক্ষমতাচর্চা করে তাদের কোনো চেষ্টা নেই এইসব সমস্যা চিহ্নিত করা, তার কারণ নির্দিষ্ট করা ও তার সমাধানের চেষ্টা করার। অনেক সময় দেখা যায়, মানুষের জন্য যা বড় সমস্যা তার কোনো স্বীকৃতিই ক্ষমতাসীনদের কাছে নেই। উপরন্তু তারা জোরগলায় এইসব সমস্যাকে অস্বীকার করেই সমস্যা সমাধানের ভাব দেখিয়ে নিশ্চিন্ত থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু যাদের এ সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা আছে তারা এভাবে নির্লিপ্ত থাকলেও তাদের নিশ্চিন্তভাব জনগণের সমস্যার সমাধান করে না।

তাছাড়া প্রায়ই দেখা যায় তারা এমনভাবে কোনো সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যার মধ্যে তাদের আত্মপ্রচারণার একটা মুখোশ থাকে। কিন্তু প্রকৃত কাজ হয় না। প্রচলিত কথায় ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার ব্যাপারই এভাবে ঘটে থাকে। কয়েকদিন আগে সংবাদপত্রের সচিত্র রিপোর্টে দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী কিছু স্কুল-ছাত্রছাত্রীকে ল্যাপটপ উপহার দিচ্ছেন। এর ঘোষিত উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষার প্রসার! বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করার এক ‘সাহসী’ পদক্ষেপ!!

কিন্তু আসল ব্যাপার কী? সাধারণভাবে শিক্ষাব্যবস্থার দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে গুটিকতক স্কুলছাত্রের হাতে এই ল্যাপটপের শিক্ষাবিষয়ক কার্যকারিতা কতটুকু? কিছু স্কুলে বা ছাত্রদের সরকার কম্পিউটারও দিচ্ছে। অন্য এক সংবাদপত্রের রিপোর্টে দেখা গেল, এ বিষয়ে ঢাকার ঝিগাতলার এক বৃদ্ধ রিকশাচালক বলছেন যে, সরকার কম্পিউটার দিচ্ছে কিন্তু তার আগে সরকারের দরকার বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা। ঠিকই। বিদ্যুত্ সরবরাহে যেখানে বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে সেখানে কম্পিউটার নিয়ে লাভ কতদূর? একেই তো বলে ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া! সরকারি শিক্ষা প্রসার চেষ্টার এ তো গেল একটা দিক। কিন্তু এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক আছে। এর একটা হলো, বইপত্রের লভ্যতা। পাঠ্যপুস্তকের সমস্যা তো আছে কিন্তু তার সঙ্গে আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাগার বা লাইব্রেরির অভাব, এগুলোতে পাঠযোগ্য বইয়ের অভাব, বই থাকলেও তার সংখ্যাল্পতার সমস্যা। শিক্ষার অর্থ শুধু ক্লাসের বই পড়া বা মুখস্থ করা নয়। শিক্ষার প্রত্যেক স্তরে পাঠ্যতালিকা বহির্ভূত বই পড়ার গুরুত্ব ছাত্রদের প্রকৃত শিক্ষার জন্য খুব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ল্যাপটপ বা সাধারণ কম্পিউটার ছাত্রদের দেয়ার উদ্দেশ্য আপাতদৃষ্টিতে তা-ই। কিন্তু এর দ্বারা শিক্ষা কতদূর বিস্তৃত হতে পারে? সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নতুন কলেজের লাইব্রেরিগুলোর অবস্থা যে চরম দুরবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়, এটা ওয়াকিবহাল লোকদের ভালোভাবেই জানা। গ্রাম ও ছোটখাটো মফস্বল শহরের স্কুলগুলোতে লাইব্রেরি বলতে কিছু নেই বললেই চলে। অপেক্ষাকৃত বড় শহরে স্কুলে নামমাত্র লাইব্রেরি থাকলেও সেগুলোর জন্য উপযুক্ত ঘর, আসবাবপত্র, আলমারি নেই। বইপত্রও বিশেষ নেই, থাকলেও তার মান এতই নিম্ন যে সেগুলো পড়ে কোনো সুশিক্ষা হয় না। বইগুলো ঠিক ছাত্রদের পাঠযোগ্য কি না, শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কি না, এটা দেখার জন্য প্রধান শিক্ষক থেকে অন্য শিক্ষকদের কারও মাথাব্যথা নেই। সাধারণত এসব লাইব্রেরি এত ছোট যে, শিক্ষকদের মধ্যে একজনকে লাইব্রেরি দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়।

এ তো গেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থাত্ স্কুল-কলেজ লাইব্রেরির কথা। বিদ্যাচর্চা ও শিক্ষালাভ মানুষ শুধু স্কুল-কলেজে পড়ার সময়েই করে না। ছাত্রজীবন উত্তীর্ণ হয়ে কোন দেশের মানুষ কত পড়াশোনা করে তার ওপরই নির্ভর করে একটা দেশের মানুষের শিক্ষার মান ও জনগণের সংস্কৃতিচর্চার সব থেকে বড় শর্ত। দেখা যাবে যে, কয়েকজন ছাত্রকে ল্যাপটপ দিলেও সাধারণভাবে বাংলাদেশে কার্যকর লাইব্রেরি ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত কিছু কিছু লাইব্রেরি আছে। সরকারও রাজধানী এবং জেলাশহরসহ অন্য এলাকায় কিছু লাইব্রেরি পরিচালনা করে। বেসরকারি লাইব্রেরিকেও কিছু অনুদান দিয়ে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ লাইব্রেরিগুলোর অবস্থা ভালো নয়। এগুলোতে বই কেনার জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে সেটা হাস্যকর। হাস্যকর, কারণ এর দ্বারা একটি লাইব্রেরির জন্য প্রয়োজনীয় বইপত্র সামান্যই কেনা যায়।

কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় যে, লাইব্রেরির জন্য বরাদ্দকৃত টাকা লাইব্রেরিয়ান ও অন্য কর্মচারীদের বেতন দিতেই শেষ হয়। অন্য খুচরা কাজেও টাকা লাগে। তারপর বই কেনার জন্য টাকা আর বিশেষ থাকে না! এক্ষেত্রে আর এক সমস্যা হলো, বই কেনার টাকা দিয়ে যেসব বইপত্র কেনা হয় সেগুলো ছাত্রদের পাঠের উপযুক্ত নয়। সেগুলোর মধ্যে সস্তা উপন্যাস, গল্প ইত্যাদি এমনসব থাকে যা পড়ে ছাত্রদের শিক্ষালাভের উপায় থাকে না।

কিছুদিন আগে সরকার বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে সরাসরি বই কিনে কিছু স্কুলে বিতরণের একটা ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু চরম দুর্নীতি সেই ব্যবস্থাকে ভণ্ডুল করেছে। সত্ ও সুষ্ঠুভাবে এই কর্মসূচিকে কাজে লাগালে প্রকাশনা সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো উপকৃত হতো। কিন্তু দেখা গেল যে, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয় সরকারের সময়েই দলীয় ভিত্তিতে প্রকাশকদের থেকে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বই কিনতে শুরু করল, দলের সঙ্গে সম্পর্কিত লেখকদের বই ছাড়া অন্য কারও বই তাদের ক্রয় তালিকায় স্থান পেল না এবং এর সুযোগ নিয়ে প্রকাশকরাও আবর্জনাতুল্য দলীয় বইপত্র ছেপে সরকারকে বিক্রি করল। এই প্রক্রিয়ায় একদিকে দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু প্রকাশনা সংস্থা ও অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু দুর্নীতিপরায়ণ আমলা বিপুল পরিমাণ অর্থ পকেটস্থ করল। শেষ পর্যন্ত এটা এমন এক প্রকাশ্য কেলেঙ্কারিতে পরিণত হলো, যাতে সরকার এই ব্যবস্থা স্থগিত করতে বাধ্য হলো। সরকারি বই ক্রয়ের এই কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো যে, বাংলাদেশের মতো দুর্নীতিকবলিত দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হলো চরম দুর্নীতিবাজদের এক ঘৃণিত আখড়া।

ল্যাপটপ, কম্পিউটার শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। কিন্তু সবকিছু প্রয়োজনের ক্ষেত্রেই অগ্রাধিকারের একটা ব্যাপার আছে। সরকারের ওপর দেশের ছাত্রছাত্রী ও সাধারণভাবে নাগরিকদের শিক্ষার একটা দায়িত্ব আছে। এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সরকারের দেখা দরকার একজন ছাত্রকে ল্যাপটপ দেয়া বা সাধারণ কম্পিউটার দেয়া, না তাদের পাঠাগার সমৃদ্ধ করার প্রয়োজন বেশি। এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার যে পাঠাগারের এ বিষয়ে কোনো সুস্থ চিন্তা করা লোকের সংশয় থাকার কথা নয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হিসেবে লাইব্রেরির অগ্রাধিকার অবশ্যই আছে। কিন্তু এই অগ্রাধিকার প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবেচনার বিষয় নয়। তাদের বিবেচনার বিষয় কিসে তাদের আত্মপ্রচারণা বেশি হতে পারে। কী কাজ করলে এই আত্মপ্রচারণার মাধ্যমে ভোট পাওয়ার সুবিধা হয়। দেশের ও জনগণের জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা।