বরিশালে আইন শৃঙ্খলার অবনতি

শাহীন হাসান, বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বরিশাল তথা গোটা দক্ষিণাঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটছে। বেড়ে যাচ্ছে খুণ, ধর্ষনের মতো জঘন্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। পুলিশের ভূমিকাকেই দায়ী করছে সচেতনমহল। বিভিন্ন প্রাপ্ত তথ্য মতে, বরিশাল জেলায় বিগত দুমাসে কয়েকটি খুন, ধষর্ণ ও পুলিশের শ্লীলতাহানীর ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে আছে সাধারণ জনগণ। ধীরে ধীরে পুলিশের উপর আস্থা হারাচ্ছে তারা। গত ২২ সেপ্টেম্বর, গৌরনদীতে প্রকাশ্য দিবালোকে স্কুলের ক্লাশ থেকে ডেকে নিয়ে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে ফরিদ জমাদ্দার নামে এক প্রাইমারি স্কুল শিক্ষককে। হত্যাকান্ডের পর গৌরনদীর যুবলীগ নেতা নয়ন শরীফসহ কয়েকজনকে আসামী করে মামলা করে নিহতের বড় ভাই। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সন্ত্রাসীরা কোপানোর পর ফরিদকে যখন গৌরনদী হাসপাতালে আনা হয় তখন নিজেকে জনরোষ থেকে বাঁচাতে পুলিশের গাড়িতে চেপে নিহত ফরিদকে দেখতে আসে যুবলীগ নেতা নয়ন। মামলার পরও পুলিশের চোখের সামনে নয়ন ঘুরে বেড়ালেও তাকে ধরা হচ্ছে না। পুলিশের বিরুদ্ধে সরকারি দলের তাবেদারির অভিযোগ তুলছে গৌরনদী যুবদলের নেতৃবৃন্দ। সুশীল সমাজ মনে করেন, নয়ন খুনি কিনা সেটা তদন্ত সাপেক্ষে প্রমাণিত হবে। তবে খুনের মামলার প্রধান আসামি হিসেবে নয়নকে গ্রেফতার করা পুলিশের কর্তব্য। ফরিদের খুনের রেষ কাটতে না কাটতেই মাত্র ১৯দিনের মাথায় গত ১২ অক্টোবর প্রাণ দিতে হয় আগৈলঝাড়ার আরেক প্রাইমারি শিক্ষক ৭ মাসের অন্ত:সত্ত্বা শারমিন আক্তারকে। এখানে খুনের আসামি যুবলীগ কর্মী আবুল গোমস্তা। শারমিনের অপরাধ সে আবুল গোমস্তার লালসায় সায় দেয় নি। ঘটনার দিনই অবশ্য প্রত্যক্ষ খুনী আবুল গোমস্তাকে আটক করে আগৈলঝাড়া থানা পুলিশ। সচেতন মহলের মতে, গৌরনদীতে খুনের ঘটনায় পুলিশের একপেশে নীতির কারণেই প্রকাশ্য দিবালোকে খুনের সাহস পেয়েছে আরেক যুবলীগ কর্মী আবুল। তাদের মতে, এই খুনে পরোক্ষ কোনো মদদ কিংবা আবুলের কোনো গডফাদার জড়িত কিনা তা এখই খতিয়ে দেখা উচিত পুলিশ প্রশাসনের। নইলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে কিছুই করার থাকবে না। শারমিন হত্যার রেষ কাটতে না কাটতেই গত ২১ অক্টোবর আগৈলঝাড়ার রতœপুর ইউনিয়নের ছয়গ্রামে নাতীর হাতে খুন হয় দাদী। এলাকাবাসী জানায়, নাতী জাকিরুল (২৮) কে তার চাচাতো দাদা তোতা মিয়া একটি গাবগাছ কাটতে বাধা দিলে ধারালো দা দিয়ে দাদাকে কুপিয়ে জখম করে জাকির। তাকে বাঁচাতে গিয়ে তোতার স্ত্রী নুরজাহান বেগম (৬৫)কে দায়ের কোপে প্রাণ দিতে হয়। আগৈলঝাড়া-গৌরনদীর সাধারণ জনগণ এ ক্ষেত্রে পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা আর ফরিয়াদিদের আবেদনের গুরুত্ব না দেয়াকে দূষছেন। ভুক্তভুগী পরিবারের অভিযোগ মতে, গত ২২ অক্টোবর বাকেরগঞ্জে ঘটে আরেক নির্মম ঘটনা। রঘুনাথপুর চৈতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী সেঁজুতি ১৩ অক্টোবর রাতে এলাকার বখাটে সাইফুল প্যাদা, নয়নসহ ৬জনের দ্বারা উপর্যপুরী ধর্ষণের শিকার হয়। ১৪ অক্টোবর থানায় মামলা করতে গেলে বাকেরগঞ্জ থানার ওসি রবিউল ইসলাম তাকে ধমক দেয় ও ধর্ষকের সাথে মিমাংসার প্রস্তাব দেয়। অভিযোগ নিলেও ধর্ষকদের তো গ্রেফতার করেই নি বরং আসামীদের পক্ষ হয়ে বারবার বিষয়টি মিমাংসার জন্য সেঁজুতির পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করে। সেঁজুতির পরিবারের অভিযোগ, ওসি রবিউল আসামী পক্ষের থেকে মোটা অংকের ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিষয়টি ধামা চাপা দেওয়ার পায়তারা করে। আর আসামীরা ফের সেঁজুতিকে ধর্ষণের হুমকিসহ নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বলেও অভিযোগ ধর্ষিতার পরিবারের। অবশেষে আইনের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ব্যর্থ হয়ে ২২ অক্টোবর রাতে ক্ষোভে- অভিমানে আত্মহত্যা করে সেঁজুতি। ফেটে পড়ে এলাকার ছাত্রসমাজ। বিচার দাবীতে ফুঁসে ওঠে জনগণ। বিচার চাওয়া হয় ওসি রবিউল ইসলামের। ফন্দিবাজ রবিউল গত ২৪ অক্টোবর সেঁজুতির মা হাফিজা বেগমকে থানায় ডেকে এনে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে সাদা কাগজে কয়েকটি স্বাক্ষর আদায় করে বলে হাফিজা বেগম জানান।  পুলিশ প্রশাসন অবস্থা বেগতিক দেখে রবিউলকে ক্লোজড করে বরিশাল পুলিশ লাইনে নিয়ে আসে। এলাকার ক্ষুব্ধ জনগণ জানান, ওসি রবিউলকে জনরোষ থেকে বাঁচাতেই ক্লোজড করা হয়েছে। তারা দাবী করেন, শুধু ক্লোজড করলেই চলবে না, তার উপযুক্ত বিচার হতে হবে। আর বোদ্ধামহলও মনে করেন, সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষী সাব্যস্ত হলে ধর্ষকসহ ওসি রবিউলেরও শাস্তি হওয়া উচিত। নইলে পুলিশের প্রতি আস্থা হারাবে জনগণ। বরিশালের সচেতন মহল মনে করেন, কিছু উচ্ছৃঙ্খল পুলিশের কারণে গোটা প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। এমনই একটি ঘটনা ঘটে ২১ অক্টোবর। বরিশালে ওলামা মাশায়েখদের মিছিল থেকে আদালত পাড়ায় এক পথচারিকে আটক করে কোতয়ালি থানার এএসআই মহিউদ্দিন। তাকে বাঁচাতে গেলে তার বোনকেও টানাহেচড়া করে নিয়ে যায় পুলিশ। বোনের অভিযোগ, কোনো মহিলা পুলিশ ছাড়া তাকে আপত্তিজনকভাবে তুলে নিয়ে যায় এএসআই মহিউদ্দিন গং। মিডিয়ার কাছে অভিযোগ করলে কোতয়ালি থানার ওসি বিষয়টি চেপে যাওয়ার অনুরোধ করে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পুলিশের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির দায়ে আদালতে মামলার প্রস্তুতি চলছিলো। সর্বোপরী বরিশালের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ও উষ্মা প্রকাশ করছেন সাধারণ জনগণ। আর সুশীল সমাজ মনে করেন, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে পুলিশের যথার্থ আচরণ দিয়েই মানুষের আস্থায় ফিরে আসতে হবে তাদের। সে ক্ষেত্রে সমস্ত লোভ-লালসার উর্ধ্বে উঠে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করার দাবী জানিয়েছে আপামর জনতা।