বরিশালে পেশাদার চামড়া ব্যবসায়ীরা বিপাকে ॥ চোরাই পথে ভারতে চামড়া পাচারের আশংকা

নিজস্ সংবাদদাতাঃ বরিশালের গৌরনদী, আগৈলঝাড়া ও উজিরপুর উপজেলার চামড়া ব্যবসায়ীরা চামড়া নিয়ে পড়েছে মহা বিপাকে। চমড়ার চাহিদা না থাকায় কোটি কোটি টাকার চামড়া সংরক্ষনের অভাবে নষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ঢাকার ট্যানারী মালিকদের চামড়া ক্রয়ের অভিনব কৌশলে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। এখানকার ব্যবসায়ীদের অভিযোগ তাদের সাথে এক প্রকার প্রতারনার আশ্রয় নিয়েই ট্যানারী মালিকরা অভিনব পন্থায় চামড়া ক্রয়ের জন্য এবার মাঠে নেমেছে। এ সুযোগে এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা ভারতে চামড়া পাচারের চেষ্ঠা চালাচ্ছে।

গৌরনদী উপজেলার টরকী বন্দরের হাওলাদার চামড়ার আড়ৎতের মালিক ফিরোজ হাওলাদারসহ একাধিক ব্যবসায়ীরা জানান, সারাবছর মাঠ পর্যায়ের চামড়া সংগ্রহ করে প্রসেসিং শেষে তারা ঢাকার ট্যানারী মালিকদের কাছে বিক্রি করে আসছে। সারা বছর কোটি কোটি টাকার চামড়া ক্রয়-বিক্রয় করতে গিয়ে প্রতি বছরই অনেক টাকা বকেয়া থাকে ট্যানারী মালিকদের কাছে। কিন্তু কোরবানী আসলে ট্যানারী মালিকরা ব্যাংক ঋণ পেয়ে বকেয়া পরিশোধের পাশাপাশি চামড়া ক্রয়ের জন্য অগ্রিম টাকা ব্যবসায়ীদের দাদন দিতো। যুগ যুগ ধরে বিশ্বস্ততার সাথে এ পদ্ধতিতে চামড়া ব্যবসা চললেও এবার ট্যানারী মালিকদের ভিন্ন রূপ দেখেছে এখানকার ব্যবসায়ীরা। অগ্রিম টাকা দেয়া তো দূরের কথা বকেয়া পরিশোধ না করেই ট্যানারী মালিকরা তাদের কর্মী ও দালাল নিয়োগ করে সরাসরি বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চামড়া ক্রয়ের জন্য বিপুল টাকা ধরিয়ে দিয়েছে। ট্যানারী মালিকদের কর্মী ও দালালরা সরাসরি চামড়া ক্রয়ের জন্য স্থানীয় ভাবে জনবল নিয়োগ দিয়েছে। অধিক মুনাফার আশায় এখানকার চামড়া ব্যবসায়ীদের পাশ কাটিয়ে বেকার যুবকদের টাকার প্রলোভনে নামানো হয়েছে চামড়া সংগ্রহের জন্য। প্রতি বছর কোরবানীর পক্ষকাল আগেই ট্যানারী মালিকরা এখানকার চামড়া ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করে টাকার প্রয়োজনীয়তা যাচাই-বাছাই এবং অতিরিক্ত টাকা সরবরাহ করতো। এবার ট্যানারী মালিকরা কোনো যোগাযোগ না করায় ব্যবসায়ীরা হতবাক। তারা সপ্তাহখানেক আগে ট্যানারী মালিকদের সাথে কোরবানীর পশুর চামড়া ক্রয় নিয়ে আলাপ করলেও তাদের কথাবার্তা ছিলো রহস্যজনক। কোরবানীর দিন-ক্ষণ ঘনিয়ে আসতেই তারা ট্যানারী মালিকদের কর্মী ও দালাল-ফড়িয়াদের সরাসরি উপজেলার আড়ৎ গুলোতে আনাগোনা করতে দেখে নিজেরাই পুনরায় যোগাযোগ করেন। কিন্তু নতুন চামড়া ক্রয় তো দূরের কথা বকেয়া টাকা পরিশোধ না করার জন্য তারা একের পর এক প্রতারণা করে যাচ্ছে। এখন এখানকার চামড়া ব্যবসায়ীদের ফোন পর্যন্ত রিসিভ করছেন না ট্যানারী মালিকরা।

আগৈলঝাড়ার চামড়া ব্যবসায়ী মুকুল শরীফ, সাদ্দাম হোসেন অভিযোগ করেন, ট্যানারী মালিকরা সরকারের কাছে থেকে কোরবানীর মৌসুমে ব্যাংক লোন পেলেও এখানকার চামড়া ব্যবসায়ীরা কোনো ব্যাংক লোন পাননা। সারা বছরের চামড়া সরবরাহের জন্য বিপুল টাকা আটকা পড়েছে ট্যানারী মালিকদের কাছে। একদিকে পুঁজি সংকট অপরদিকে ট্যানারী মালিকদের সরাসরি চামড়া সংগ্রহের কৌশলের কাছে এখানকার ব্যবসায়ীদের হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। নগরীর চামাড়পট্টি এলাকার বংশপরস্পরায় যারা চামড়ার ব্যবসা করে আসছেন তাদের বক্তব্য ট্যানারী মালিকরা শুধু নগর কিংবা জেলা নয় তাদের চামড়া সংগ্রহের জাল বিস্তার করেছে উপজেলা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। ফলে পেশাদার চামড়া ব্যবসায়ীরা এবার তাদের মুল পেশার আসল মৌসুমেই ঘরে বসে না খেয়ে থাকতে হবে। ধারদেনা করেও এবার চামড়া ব্যবসার প্রতিযোগিতায় তারা ট্যানারী মালিকদের সাথে পেরে উঠবেন না। প্রথমত ট্যানারী মালিকরা দালাল-ফড়িয়াদের মাধ্যমে বাজার মূল্যের চেয়ে ২/৩শ’ টাকা বেশী দিয়ে চামড়া ক্রয় করবেন বলে জানতে পেরেছেন। এরপরও যদি এখানকার পেশাদার ব্যবসায়ীরা চামড়া ক্রয় করেন তা বিক্রি করার কোনো উপায় নেই। ট্যানারী মালিকদের যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে তাতে অনেকটা কালো তালিকাভূক্ত হয়ে পড়েছেন প্রকৃত চামড়া ব্যবসায়ীরা। ফলে তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।

গৌরনদী, আগৈলঝাড়া ও উজিরপুর উপজেলার চামড়ার আড়ৎ টরকী বাসস্ট্যান্ড এলাকা জুড়ে। এ খানে প্রতি বছর কোরবানীর সময় চামড়া প্রসেসিং করা হতো। ঢাকার ট্যানারী মালিকদের ২০/২৫ জন ব্যবসায়ী চামড়া প্রসেসিং করে সরবরাহ করলেও এর সাথে জড়িত রয়েছে শত শত পরিবার। আড়তগুলোর কাছে চামড়া সরবরাহ করা, প্রসেসিং ও ঢাকায় পাঠানোর জন্য এসব জনবল নিযুক্ত ছিলো। প্রতি বছর কোরবানী এলেই এসব পরিবারের সদস্যদের মুখে ছিলো হাসির ঝলক। এবার তাদের কপালে দুঃশ্চিন্তার রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অপর ব্যবসায়ী হায়দার আলী, সোহেল হাওলাদার বলেন, কোরবানীর দু’দিন আগে আমরা টের পেয়েছেন ট্যানারী মালিকদের অভিনব কৌশলের নামে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি। উজিরপুরের চামড়া ব্যবসায়ী স্ব্জল হোসেন জানান, পেশাদার চামড়া ব্যবসার সাথে জড়িত শত শত মানুষ সারা বছর ব্যস্ত থাকলেও মুল কোরবানীর মৌসুমে তারা একেবারেই বেকার হয়ে গেলেও। এতে তাদের আগামীর ভবিষ্যতও অনিশ্চিত বলে ব্যবসায়ী নেতারা জানান। ব্যবসায়ীরা ভূগছেন অর্থ সংকটে। আর কর্মীরা বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে চরম হতাশায় ভূগছেন।

টরকী বন্দরের ব্যবসায়ী সোহেল হাওলাদার বলেন, চামড়ার বাজার মন্দা ও চাহিদা না থাকায় রাস্তার পাশে প্রায় ৫ হাজার গরুর ও ২ হাজার ছাগলের চামড়া স্তুব করে রাখা হয়েছে যার আনুমানিক মূল্য ১ কোটি টাকা। এ চামড়া এক সপ্তাহের মধে বিক্রি না করতে পারলে নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি আরো জানান, এবার ঈদুল আযহার পশুর চামড়া নিয়ে ট্যানারী মালিকদের সাথে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে তাতে এ খাতের ভবিষ্যত সংকটের মুখে পড়বে। এখানকার পেশাদার চামড়া ব্যবসায়ীরা ট্যানারী মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে ঘরে বসে থাকবে না। সেক্ষেত্রে তারা বিকল্প পথে যদি চোরাই ভাবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চামড়া পাচারের কৌশল গ্রহণ করে সেক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।